অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রুখতে প্রয়োজন পরিবেশ বান্ধব কার্যকরি পদক্ষেপ - রতন কুমার তুরী

গ্রীণ হাউজ এফেক্ট, পৃথিবীব্যাপি সবুজ গাছপালা ধ্বংস, উন্নত বিশ্বের কলকারখানার সমূহের অনিয়ন্ত্রিত কালো ধোঁয়া, উন্নয়নশীল দেশ সমূহের অপরিনামদর্শী পরিবেশ নিধন সর্বোপরি মনুষ্য সৃষ্ট অতিরিক্ত প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহারের পর তা যত্র- তত্র ফেলে দেয়ার কারণে পুরো পৃথিবীর পরিবেশ আজ হুমকির সম্মুখীন। পৃথিবী জুড়ে সাত শ কোটি মানুষের নিঃশ্বাসে  ধরিত্রী   আজ যেনো বিষে নীল হয়ে যাচ্ছে।  এমন পরিবেশ বিরোধী কার্যকলাপ বছরের পর বছর চলমান থাকায় প্রকৃতি আর তাদের ভার বইতে পারছেনা ফলে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। আর তাই আমরা আজকাল পৃথিবীর প্রতিটি দেশে প্রকৃতিকে ভয়াল রূপে  ঝড়, বৃষ্টি, দাবানল, বন্যা, খড়া এবং ভূমিকম্প সংঘটিত হতে দেখি। প্রকৃতির এমন বিরূপ আচরণের কারণে অনেক সময় ব্যাপক প্রাণ হানির চিত্রও আমাদের অজানা নয়।  এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রকৃতি এমন আচরণ করছে কেনো?  প্রাচীন যুগ এবং মধ্য যুগেও তো প্রকৃতির এমন রুদ্র মূতি দেখা যায় নাই। প্রকৃতপক্ষে  সৃষ্টি থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত পৃথিবী নামক গ্রহটির অধিকাংশ জুড়েই জঙ্গল- পাহাড় এবং নদ- নদীতে ভরপুর  যা প্রকৃতির এবং পরিবেশের জন্য যথোপযুক্ত ছিলো। এমনকি মরুভূমির মতো জায়গায়ও মানুষ সারি সারি খেজুর গাছ লাগাতো তাদের খাদ্য আর পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য। বর্তমানে মানুষের প্রয়োজনে মানুষ গ্রামের গাছগাছালিতে ভরা জায়গাকে আবাদের মাধ্যমে জনবসতি গড়ে তুলেছে। আবার কোনো জায়গা নগর সভ্যতা এতো বেশি জায়গা দখল করে নিয়েছে যে, সেখানে তিল ধারণে   ঠাঁই নাই। ফলে সেখানে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধিতো হয়েছে। 
মূলত প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক যুগে এসে মানুষ ইট-পাথরের দালান-কোঠা বানাতে বানাতে প্রকৃতিকে ভুলেই গেছে।  বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার এই যুগে এসেও কেনো মানুষ প্রকৃতিকে নিজেদের আয়ত্তে আনতে পারছেনা এমন প্রশ্ন সব মানুষের মনেই উঁকি দেয়। কিন্তু এমন প্রশ্ন মাথায় না এনে, আমরা যদি কেনো প্রকৃতি রুষ্ট হয় এবং তার সমাধানইবা কোথায় লুকিয়ে আছে তা খুঁজি তাহলে তার একটা সমাধান আসবে বলে আমারা মনে করি। যদিও প্রকৃতিকে পুরোপুরি মানুষের আয়ত্তে আনা প্রায় অসম্ভব তবে পরিবেশের কিছু উপাদানকে যত্ন সহকারে ব্যবহার করলে এর ক্ষয় ক্ষতি থেকে অনেকটা রেহাই পাওয়া সম্ভব। আমাদের সবার মনে রাখা উচিত আমাদের জীবন জড়িয়ে আছে পরিবেশের সাথে।  আমরা বেঁচে থাকার জন্য প্রত্যহ যে নিঃশ্বাস নিই  তার সবই আসে প্রকৃতি থেকে। আমরা নিত্যদিন যে অক্সিজেন গ্রহন করি তা আসে প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা বৃক্ষরাজি থেকে আর আমাদের ত্যাগকৃত কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রকৃতির বৃক্ষরাজিরা গ্রহণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। এর মধ্যে কোনো একটা কম বেশি হলেই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা বেশ কষ্টকর হয়ে যায় আর এই কারণেই প্রকৃতি বিরূপ আচরণ করতে থাকে।  প্রকৃতি তার ভারসাম্য রক্ষা করতে অপারগ হলে তার আচরণ পাল্টাতে বাধ্য হয় এতে সারা পৃথিবীতে ঋতু প্রকৃতি বদলে যায় আর এর ক্ষতিকর প্রভাব সারা পৃথিবী দৃশ্যমান হয়। এমন পরিস্থিতিতে পুরো পৃথিবীর জলবায়ু  পরিবর্তিত হয়ে একের পর এক বিভিন্ন দেশে বন্যা, খড়া, সুনামি ইত্যাদি দেখা দেয়। প্রকৃতপক্ষে কোনো দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হলে ঐ দেশে কমপক্ষে ২০% বনভূমি সংরক্ষিত থাকা বাঞ্ছনীয়। এতে দেশটির জলবায়ু  ঠিক থাকবে এবং পরিবেশেরও কোনো অসুবিধা হবেনা কিন্তু দেখা গেছে পৃথিবীর কিছু কিছু দেশে সঠিক মাত্রায় বনভূমি সংরক্ষিত থাকলেও বেশিরভাগ দেশেই নাই। 
আফ্রিকা মহাদেশে বলতে গেলে কোনো প্রাকৃতিক পরিবেশগত কোনো ঘাটতি নেই কারণ আফ্রিকা মহাদেশে এখনও যে পরিমান বনভূমি রয়েছে তাতে করে তাদের বহু শতাব্দী চলে যাবে তবে মহাদেশটি এখনও শিক্ষা দীক্ষায় পিছিয়ে আছে কারণ সেখানে এখনও বিভিন্ন কুসংস্কার রয়ে গেছে। তাছাড়া মহাদেশটির কোনো কোনো দেশে এখনও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব থেকে যাওয়ায় যুদ্ধ বিগ্রহ দৃশ্যমান হয়, এতে দেশ গুলোতে  দুর্ভিক্ষ লেগেই থাকে।  অন্যদিকে আর ৬টি মহাদেশের মধ্যে এশিয়ার বেশ কিছু দেশে বনাঞ্চল থাকলেও তা সংরক্ষণের অভাবে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে ফলে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এশিয়ায় বড় বেশি দৃশ্যমান হয়। আমেরিকা মহাদেশের মতো অতি উন্নত মহাদেশেও আমরা প্রায় সময় বন্যা হতে দেখি। এমনকি বিশ্বের সুপার পাওয়ার দেশ হিসেবে খ্যাত আমেরিকাতে প্রতিবছর বন্যায় ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হয়। তাদের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিও  বন্যার পানিতে ভেসে থাকে। অর্থাৎ যেহারে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে তাতে  ধনি গরিব সব দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 
এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বিশ্বের প্রতিটি দেশকে এগিয়ে আসতে হবে। যেহেতু বিষয়টিতে পুরো পৃথিবীর অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে এবং পুরো বিশ্বের মানুষের বেঁচে থাকার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে সেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি জাতিসংঘের মাধ্যমে একটি দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহন করে এগিয়ে যাওয়া উচিত। যদিও আমরা প্রায় প্রতিবছরই বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন হতে দেখি এবং বিশ্ব পরিবেশ রক্ষায় সম্মেলনগুলোতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতেও দেখি কিন্তু দেখা যায় জলবায়ু সন্মেলনের অনেক পদক্ষেপই উন্নত দেশগুলো মানেনা ফলে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন প্রতিবারই প্রায় ব্যর্থ হয়। মূলত উন্নত দেশ সমূহের কলকারখানায় অতিমাত্রায় কার্বণ নিঃসৃত হওয়ার ফলে ভূপৃষ্ঠের ওপরিভাগের জলবায়ু প্রতিনিয়তই উষ্ণ হচ্ছে  আর  এই উষ্ণ জলবায়ুই বিশ্ব পরিবেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এমন জলবায়ুর প্রভাব থেকে ধরিত্রীকে বাঁচাতে পৃথিবীবাসীদের এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিটি দেশে সবুজ বনায়ন সংরক্ষণ বাধ্যতামূলকসহ পরিবেশ দূষণ রোধে কঠিন আইন প্রনয়ন করতে হবে। কলকারখানা ধোঁয়া এবং অপরিশোধিত বর্জ্য একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবেশ বান্ধব মানদণ্ডে নিয়ে আসতে হবে। এর বাইরে জাতিসংঘের মাধ্যমে প্রতিটি দেশে পরিবেশ বিষয়ক তহবিল গঠণ করে ভবিষ্যৎ জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে হবে।  আমাদের সবার মনে রাখা উচিত পৃথিবীর দেশে দেশে   পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা  করতে পারলে বিশ্ব জলবায়ু তার সঠিক গতিতে অগ্রসর হতে পারবে আর বিশ্ব জলবায়ু সঠিক গতিতে অগ্রসর হতে পারলে পৃথিবীর প্রাণিকূল তাদের অনুকূল পরিবেশে বসবাস করতে পারবে। তাই   আসুন আমরা সবাই  বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আমাদের চারিপাশে সবুজ   বেষ্টনী গড়ে তুলি। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব রোধে বিশ্বময় সবুজ বিপ্লব গড়ে তোলা আমাদের আপনাদের নৈতিক দায়িত্ব  কারণ সবুজ বিপ্লব গড়ে তুলতে না পারলে আগামী শতাব্দীতেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরো বেশি প্রকট হবে। 
তখন পৃথিবীর দেশে দেশে আরো কিছু নতুন  সমস্যা দেখা দেবে তাই সময় থাকতেই এবিষয়ে সবাইকে চিন্তা ভাবনা করে এগিয়ে যেতে হবে।  
নগর সভ্যতাকে একটি পরিবেশ বান্ধব কাঠামোতে আবদ্ধ করার মাধ্যমে পরিবেশকে আরো বেশি মনুষ্য উপযোগি করে তোলা যায়। 
আসুন সবাই মিলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধে সচেতন হই এবং পৃথিবীর মানুষদের বাঁচাই। 

রতন কুমার তুরী
কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী, 
বাংলাদেশ।