অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য বনাম আধুনিক সভ্যতা - বটু কৃষ্ণ হালদার

নিজেদের বানানো অস্ত্রে নিজেরাই বধ হচ্ছি দিন দিন। এই ভারতে তৈরি হচ্ছে প্লাস্টিকের ব্যাগ আর তা অবাধে ব্যবহার করছি আমরা। প্লাস্টিক দূষণে পরিবেশের অবস্থা নাজেহাল জেনেশুনেও হুঁশ ফেরেনি কারো। আসেনি সচেতনতা। সাধারণ জনগণের কি কোনো দায়িত্ব নেই প্লাস্টিক দূষণ রোধ করতে? অবশেষে প্লাস্টিক মুক্ত হতে নতুন করে দাওয়াই আবিষ্কার করলেন রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। প্লাস্টিকের প্যাকেট ফেরালেই মিলবে টাকা। টাকার টোপ দিয়ে, প্লাস্টিক বর্জন করার প্রয়াস কতটা কার্যকর হবে তা বলা যাচ্ছে না এই মুহূর্তে। এর অর্থ হলো প্লাস্টিকের কারখানা গুলো বেঁচে থাকুক। এই ভারতের মুদ্রাদোষ স্বাধীনতার পর থেকে আজ ও সমস্যাগুলোকে কখনোই গোড়া থেকে নির্মূল করার চেষ্টা করা হয় নি। এমন ব্যবস্থা না করে যদি ভারতে সমস্ত প্লাস্টিকের কারখানাগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয়, তবে প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে মিলবে রেহাই এ বিষয়টা কিন্তু পরিষ্কার। যদি প্লাস্টিকের ব্যাগ উৎপন্ন না হয় তাহলে জনগণ ব্যবহার করবে কি করে? তবুও কোন সরকার প্লাস্টিক কারখানাগুলোকে বন্ধ না করে এমন এক অমানবিক উদ্যোগ নিয়েছে।

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। পৃথিবীতে মানব সভ্যতা শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে আসছে যুগের পর যুগ। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগত বিদ্যায় একধাপ উচুঁতে অবস্থান করেছে এই সভ্যতা। প্রতিনিয়ত মানুষ ছুটে চলেছে কিছু নতুন সৃষ্টির আশায়। বিমুখ করেনি বিজ্ঞানীরা। তাই বিশ্ব আজ তালুবন্দি। যে কোন সমস্যার  সমাধানের সূত্র বের করে বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ দিয়ে চলেছে। কিন্তু প্রশ্ন একটাই সত্যি কি সব সমস্যার সমাধান সূত্র বের করতে সক্ষম হয়েছে? এত কিছুর পরেও কোন না কোন দিক দিয়ে আমরা অসহায় বোধ করছি প্রতিনিয়ত।

উত্থান আছে যার পতন নিশ্চিত। কিন্তু প্রশ্ন হল সেই সভ্যতা পতনের কারণ যদি আমরা নিজেরাই হই তাহলে কেমন হবে ব্যাপারটা। এই অত্যাধুনিক সভ্যতার যুগে ও পৃথিবীর বয়স যত বাড়ছে ততোই অমীমাংসিত সমস্যার সম্মুখীন হয়ে চলেছি আপনার। এ সমস্যার সমাধান বের করতে আমাদের অনেক জটিল বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এ পৃথিবীতে বিজ্ঞান সত্যিই আশীর্বাদ, কিন্তু দিন দিন সেই আশীর্বাদ অভিশাপে পর্যন্ত হচ্ছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যার চাপে পৃথিবীর জীবন নাভিশ্বাস হয়ে উঠছে আর তার জন্য দায়ী আমরা নিজেরাই। দুনিয়ার মানুষ জীবনধারণের তাগিদে পরিস্থিতি চাপে অনেক ভারী দ্রব্য বহন করে নিয়ে চলে কিন্তু একটা বাজারের ব্যাগ হাতে নেবার সময় হয়ে ওঠে না অনেকেরই, তার বিকল্প হিসাবে আসে প্লাস্টিকের ব্যাগ। প্লাস্টিকের ব্যাগ বোতল কিংবা যাবতীয় জিনিসপত্র আছে পৃথিবীর ধ্বংসের অন্যতম কারণ হিসেবে রচনা করতে পারে নতুন ইতিহাস। বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশগুলি নিজেদের অস্তিত্ব টুকু বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসে হাত মেলাচ্ছে বারবার। খুঁজে বেড়াচ্ছে সমস্যা থেকে চিরতরে মুক্তির উপায়। যে সমস্যা প্রতিনিয়তঃ পৃথিবী দরজায় কড়া নাড়ছে তা হলো "জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা"।

জলবায়ু পরিবর্তনের একাধিক কারণ আমাদের সামনে আসছে। প্রকৃতি নয় এজন্য বেশি তাই মানব সভ্যতা। মানব সভ্যতা দূষণের অন্যতম কারণ হলো প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য। সবার প্রথমে আমাদের জানতে হবে প্লাস্টিক কি? প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ তৈরি হয় মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। যেমন তেল বা প্রাকৃতিক গ্যাস কে ব্যবহার করে। ভূগর্ভস্থ থেকে খনিজ পদার্থ নিষ্কাশন করার সময় বিপুল পরিমাণে দূষিত পদার্থের নির্গমন ঘটে। উল্লেখযোগ্য পদার্থ গুলি হল কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, ওজন, বেনজিন এবং মিথেন। এর সবকটা পদার্থ গ্রীনহাউস প্রক্রিয়ার জন্য দায়ী। এই গ্রীনহাউজ প্রক্রিয়ার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। যার ফলে বেড়ে চলেছে AC  চাহিদা। এই গ্রীনহাউজ প্রক্রিয়ার ফলে হিমালয়ের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে। তার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের থেকে নিচে অবস্থানরত দেশগুলোর প্রায় অনেক অঞ্চল সমুদ্রের তলদেশে বিলীন হয়ে যাবে সেটা কিন্তু নিশ্চিত। আবার  প্লাস্টিকের বোতল কিংবা দৈনন্দিন জীবনে সৌন্দর্যয়নের জন্যে ব্যবহৃত সবই পদার্থ বিষাক্ত পয়জন। বিশ্ব সৌন্দর্যায়নের মধ্যে লুকিয়ে আছে মৃত্যু পুরীর রহস্য। যে সমস্ত প্লাস্টিকের বোতল গুলো ব্যবহার করি তার মূল উপাদান পলিইথিলিন। একটি গবেষণায় দেখা যায় এক আউন্স পরিমাণ পলিইথিলিন প্রস্তুত করতে প্রায় পাঁচ আউন্স পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হচ্ছে। যার মানে হল যতটা প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহার করছি তার থেকে বহু গুণ বেশি দূষিত  ছড়াচ্ছি পরিবেশে। আবার শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বাজার জাতকরণের জন্য প্লাস্টিকের চাহিদা ব্যাপক। বাবুল শিল্পোন্নয়নের নামে কি পরিমান পরিবেশ দূষণ করে চলেছে এই সমস্ত দেশগুলো?

এ প্লাস্টিক শুধুমাত্র মানবজীবনে নয় এমনকি সামুদ্রিক প্রাণীদের জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক জীব বিলুপ্ত হচ্ছে। ২০১০ সালের ১৯ শে এপ্রিল "দ্য সিটল স টাইমস" নামক দৈনিক একটি খবর খুব সারা জায়গায়। শীতল সমুদ্র সৈকতে মৃত পড়ে থাকতে দেখা যায় একটি বিশাল আকৃতি তিমিকে। পরে মৃত্যুর কারণ নিয়ে গবেষণায় দেখা যায় সেই তিমির মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো পাকস্থলীতে উপস্থিত ও বহুজাতিক প্লাস্টিক দ্রব্য। এমনিভাবে জলজ প্রাণীর মৃত্যু খবর সুখদায়ক নয়। এমন বহু জলজ প্রাণীর মৃত্যু সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে বারবার। এরপর জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে ভয়াবহ তথ্য তুলে ধরা হয় সেখানে বলা হয় প্রতি বছর প্রায় ৮০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী সমুদ্রের বর্জ্য পদার্থ দ্বারা আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য যা নিতান্তই আমাদের দায়বদ্ধতা। তাই আসুন সবাই মিলে প্লাস্টিক মুক্ত সমাজ গড়ার শপথ গ্রহণ করি। তা না হলে যে সুন্দর পৃথিবী কে বাসযোগ্য গড়ে তোলার অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলাম, সেই পৃথিবীতে খুঁড়তে হবে কফিনের গর্ত।

বটু কৃষ্ণ হালদার । কবর ডাঙ্গা, কোলকাতা