অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
সিন্ধু থেকে গঙ্গাঃ ভারতীয় চারুকলার ক্রমবিবর্তন (এক)

শিল্পকলায় নান্দনিক বা ভাব-বিনিময়ের উদ্দেশ্যে মানুষের দ্বারা নির্মিত দৃশ্যমান বস্তুর ইতিহাসকে বোঝায়। বিংশ শতাব্দীতে কলার প্রধান শাখা হিসেবে নয়টি বিদ্যাকে চিহ্নিত করা হয়ঃ স্থাপত্য, নৃত্য, ভাস্কর্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, কাব্য, চলচ্চিত্র, ফটোগ্রাফি এবং গ্রাফিক্স। এর প্রত্যেকটি শাখা ক্রমবিবর্তনের ধারার সামনে অগ্রসরমান। 
ভারতীয় চিত্রকলার পরিধি আজকের ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্থান এবং আফগানিস্থানের পুর্বাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। খ্রিষ্টপুর্ব তিন সহশ্র বছর আগেই ভারতীয় চিত্রকলার জন্ম। এতে যুক্ত হয়েছে মানুষের সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় প্রভাব। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-জৈন সংস্কৃতি মিলে এখানে গড়ে তুলেছে চিত্রকলার মহান ঐতিহ্য। ভারতের জলবায়ু, আবহাওয়ার সাথে সঙ্গতি রেখে শিল্পকলায় ব্যবহৃত হয়েছে মাটি, পাথর, ধাতব পদার্থ, কাঠ এবং স্থানীয় প্রাকৃতিক উপাদান। বিশ্বের অন্যান্য স্থানে যেখানে ছিল পেইন্টিং মুল মাধ্যম, ভারতে তার পরিবর্তে এসেছে শক্ত উপকরন। চারুকলা দুই ভাগে বিভক্ত; ১) স্থানুধর্মী (Arts of Space / Plastic Arts)- চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য, স্থাপত্য এবং ২) ধ্বনিময় (Arts of Time) – সঙ্গীত, কাব্য, নৃত্য, চলচ্চিত্র। শিল্পকর্মের বীজ নিহিত শিল্পীর সৃষ্টিশীল কল্পনায়। 
বৈশিস্টঃ ভারতীয় চিত্রকলার দুটো প্রধান বৈশিস্টঃ ১) বৃহৎ দেয়ালচিত্র (Mural): প্রাচ্যের শিল্পরীতিতে করা রেখাচিত্র দেয়ালচিত্রের অন্যতম বৈশিস্ট। প্রাগৈতিহাসিক কালে ফ্রেসকো* রীতিতে প্রাকৃতিক রং দিয়ে আঁকা এ সমস্ত বিশালাকার চিত্রে চুনাপাথরের মিশ্রন ব্যবহার করা হয়েছিল। খ্রিস্টপুর্ব ২-১০ম শতাব্দি পর্যন্ত নির্মিত ম্যুরাল, যেমন অজন্তা, ইলোরা, কৈলাশ মন্দির, তামিলনাড়ুর আরমা মালাই গুহায় সংরক্ষিত আছে। এ সমস্ত দেয়াল চিত্রে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। ২) ক্ষুদ্র চিত্র (Miniature): হাতে আঁকা পেইন্টিং’এ ভারী রং যেমন খনিজ, ভেষজ, পাথর, নীল, কালো, হলুদ, লাল, সোনালি, রুপালি রং ব্যবহৃত হতো। চিরায়ত রীতিতে আঁকা বেশ কিছু ক্ষুদ্রচিত্র, বৌদ্ধ এবং জৈন আমলে তালপাতার উপর আঁকা চিত্র ঐসময়ের বৈশিস্ট। শিল্পকর্মে পোর্ট্রেট, জীবজন্তু, গাছ-পালা ও অন্যান্য ভৌত পৃথিবীকে ফুটিয়ে তোলা হতো।    
ঐতিহাসিক বিবর্তনে ভারতীয় শিল্পকলাঃ  প্রায় ৩০,০০০ বছর আগে ডিকান মালভূমির ভিমবেক্টার গুহায় আবিস্কৃত প্রস্তরে অংকিত চিত্র এবং পাথরের গায়ে উতকীর্ণ খোদাই কারুকাজ ভারতীয় চিত্রকলার প্রাগৈতিহাসিক কালের সাক্ষী। আফ্রিকার মত একদিন ভারতও গুহা চিত্রের পথ ধরে আদিমতম পর্ব থেকে প্রবেশ করে মধ্যযুগে (medieval period)। সিন্ধু সভ্যতার আতুর ঘর থেকে জন্ম নেয় আধুনিকতার। সে আত্মস্থ করে ধর্মীয় ভাব, মানুষ, প্রকৃতি, জাতি, রাজন্য, মুঘল, ব্রিটিশ, পারস্যে চিত্রকলার ক্ষুদ্রলয় (fusion)। খ্রিষ্টপূর্ব ১ম শতক থেকেই ভারতীয় চারুকলার নীতিমালাকে আলোকিত করে “সাদাংগা” নামে ছয়টি অবয়ব । খ্রিষ্টপুর্ব ৩য় শতকে বাৎসায়ন তার কামসুত্রে  নীতিমালা গুলো প্রকাশ করেনঃ ১) রূপবেদ-চেহারা সম্পর্কীত ধারনা; ২) প্রমান-সঠিক ধারনা, মাপ এবং গঠন; ৩) ভাবঅনুভুতির রুপকল্প; ৪) লাবন্যতা-কমনীয়তার শৈল্পিক প্রতিনিধিত্ব; ৫)  সাদৃশ্যতা; ৬) বর্ণিলতা-রং, তুলির শৈল্পিক আঁচর। এ সমস্ত নীতিমালাই চারুকলার ভিত্তি। বর্তমানে চারুকলার যে প্রধান নয়টি শাখাকে প্রধান হিসাবে বিবেচনা করা হয়, তা হচ্ছে স্থাপত্য, নৃত্য, ভাস্কর্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, কাব্য, চলচ্চিত্র, ফটোগ্রাফি এবং গ্রাফিক্স। এসবের সুরে বাজে আদি ছয়টি ধারার আওয়াজ। এর প্রধান ধারাবাহিক অধ্যায় গুলো হচ্ছেঃ  
(১) আদিপর্বঃ প্রায় ৭৫,০০০ বছরের ভারতের ইতিহাসে পাথরে খোদিত এবং অংকিত চিত্রকর্ম ছিল আদি শিল্পকলা। মনে করা হয় তখন ভারতের চিত্রকররা ১৩০০ স্থানে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষের প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন। পাথরে উতকীর্ণ কাজ এ অঞ্চলে আবিস্কার হয়েছিল স্পেনের Cave of Altamira আবিষ্কারের ১২ বছর আগে। ঐ সময়ের অবয়বে প্রাধান্য ছিল মানুষের জীবন, পশু এবং শিকার। তখনকার চিত্রে আয়রন অক্সাইড (হিমাটাইট) থেকে তৈরী জেরু নামে এক প্রকার পাউডার ব্যবহৃত হতো। 


(২) সিন্ধু অববাহিকার সভ্যতা (খ্রিস্টপুর্ব ৫০০০-১৫০০): চিত্রকলার দিক থেকে সিন্ধু সভ্যতা পৃথিবীর অন্যান্য আদি সভ্যতা থেকে ভিন্ন ছিল। নৃত্যকলার প্রতি তাঁদের সহজাত অনুরাগ ফুটে উঠে স্বর্ন, টেরাকোটা এবং পাথরের নির্মিত কাজে। টেরাকোটার কাজে পাওয়া গেছে গরু, ভাল্লুক, বানর ও কুকুরের প্রতিকৃতি। মহেঞ্জোদারোর পিতলের নৃত্যরত বালিকার অবয়বকে মনে করা হয় বিশ্বের আদিমতম দ্রুপদি শিল্পকর্মের নমুনা। 

       

(৩) ময়ূর আমল (খ্রিস্টপূর্ব ৩৪০-২৩২): উত্তর ভারতের ময়ূর সাম্রাজ্যে স্মৃতিস্তম্ভ উল্লেখযোগ্য। পাটুলিপুত্রে কাঠ নির্মিত স্তম্ভে পারস্যে রীতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে (২৬৮-২৩২ খ্রিস্টপূর্ব) ময়ুরান শিল্পরীতিতে বুদ্ধের উপর বেশ কিছু স্থাপত্য গড়ে উঠে। তার নমুনা দেখা যার অশোক স্তম্ভেও।

 
(৪) বৌদ্ধ এবং মথুরা অধ্যায় (১-৫০০ খ্রিস্টাব্দ): ময়ূর রাজত্বের পর সাচী, বারহুত এবং অমরাবতীতে বৌদ্ধ রীতিতে বেশ কিছু ভাস্কর্য গড়ে উঠে। পরে তার কিছু নমুনা পৃথিবীর নানা স্থানে পাচার হয়ে যায়। মথুরা ছিল এমন একটি শিল্পকেন্দ্র, যেখানে হিন্দু, জৈন এবং বৌদ্ধ সংস্কৃতি একসাথে মিলেমিশে কাজ করেছে। এসব স্থাপত্যে বন্ধনহীন স্থায়ি গঠন বিন্যাসের বৈশিস্ট দেখা যায়। বৌদ্ধ চিত্রকলায় বুদ্ধের মুর্তি প্রধান হলেও হিন্দু এবং জৈন চিত্রকর্মে তার প্রভাব দেখা গেছে। গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডারের ভারত বিজয়ের পর (৩২৭-৩২৫ খ্রিস্টপূর্ব) গ্রীক-বৌদ্ধ শিল্পরীতি উত্তর-পশ্চিম ভারত তথা আফগানিস্থান ও পাকিস্তানের গান্ধারা অঞ্চলে ছড়িয়ে পরেছিল। বামিয়ান যুগের ২০০০ বছরের পুরানো বিশ্বের বৃহত্তম বুদ্ধমুর্তি ২০০১ সনে মৌলবাদী তালেবানদের দ্বারা দ্ধংশপ্রাপ্ত্য হয়। 
(৫) গুপ্ত যুগ (৩২০-৫৫০ শতাব্দি): গুপ্ত যুগকে বলা হয় দ্রুপদি হিন্দু চিত্রকলার স্বর্ণালি সময়। তখন দৃশ্যমান চিত্র এবং ভাস্কর্যে প্রধান ধর্মীয় দর্শনকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। মথুরা এবং গান্ধারা ছিল দুটি প্রধান শিল্পকেন্দ্র। আদি হিন্দু মন্দিরের স্থাপত্য ছিল অত্যন্ত সহজ রীতিতে গড়া পবিত্র স্থান। সেখানে পুন্যার্থিরা বারান্দায় বসে ধর্ম চর্চা করতেন। পরে মন্দিরের চূড়া এবং প্রার্থনাঘর গুলো অলংকরন করা হয়। 
(৬) মধ্য ভারতের মধ্যযুগের শেষ ভাগ (৬০০-১৩০০ খ্রিস্টাব্দ): অশোক স্তম্ভের মত উত্তর এবং দক্ষিন ভারতেও একই ধারার স্থাপত্য রীতি অনুসরণ করা হয়েছিল। ওই সময়ে রাজন্যবর্গের উত্থান-পতন সত্বেও বেশ কিছু মন্দির এবং ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মামালাপুরমে বঙ্গোপসাগরের উপকুলে “তট মন্দির” দ্রাবির স্থাপত্যের নমুনা। নতুন স্থাপত্য রীতি অনুসরণ করে চোলা সাম্রাজ্যে আবির্ভাব ঘটে বিখ্যাত পিতলের মুর্তি, মোমের ঢালাই এবং ফেসকো রীতির চিত্রকর্ম।
(৭) খাজুরাহো স্তম্ভ চারুকলা (৮০০-১০০০ খ্রিস্টাব্দ): চান্দিলা রাজপুত বংশ খাজুরাহো স্তম্ভ স্থাপত্যের আদি রূপকার। মধ্যযুগে জন্ম নেয়া শিল্পরীতিতে আলিঙ্গন বদ্ধ মানব মানবীদের খোলামেলা ভাবে দেখা যায়। হিন্দু রাজত্বে খাজুরাহো রীতির মন্দির স্থাপত্য বিকাশ হলেও ১৩ শতকে দিল্লীর মসনদে আসেন মুসলিম সুলতানরা। ফলে ১৮ শতক পর্যন্ত অধিকাংশ খাজুরাহো রীতিতে গড়া মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

                             বিষ্ণু মন্দিরঃ খাজুরাহো স্থাপত্যের নিদর্শন ও জয়পুর স্থাপত্যকলা
চলবে...
ছবি কৃতজ্ঞতা- লেখক এবং আন্তর্জাল 

শিবব্রত নন্দী দুলাল
 গুএলফ, কানাডা।

shibanandi@gmail.com