একাত্তর অবিনশ্বর - খুরশীদ শাম্মী
প্রায় তিন দশকের অভিবাসী জীবন আমার। বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতিতে শতভাগ সবল না হওয়ায় কখনো কখনো পরাধীনতার যন্ত্রণা অনুভব করি। বহির্বিশ্বের কোথাও লাল-সবুজ পতাকা উড়তে দেখলে মনটা আনন্দে ভরে যায় তখন। শিকড়ের টান অনুভব করি। ভীষণ একটা ভালোলাগা জন্ম নেয়, যা ভাষায় ব্যক্ত করা কঠিন। 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' জাতীয় সংগীত গাইতে শুনলে শিহরিত হয় মন, ভাবনাগুলো তখন যেন আপন ভুবন খুঁজে পায়। মুহূর্তে বৈদেশিক শৃঙ্খলিত জীবনের দেওয়াল টপকিয়ে স্মৃতির দেওয়ালে এক্কা-দোক্কা, ওপেনটি বায়োস্কোপ খেলতে শুরু করে। স্বাধীন স্বতঃস্ফূর্ত একটা আমেজ সৃষ্টি হয় সেখানে। মন নিভৃতে জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের মতো মণিমাণিক্য অর্জনের কেন্দ্রবিন্দু সেই একাত্তর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করে। যতবার আমার মনোজগৎ একাত্তর খুঁজে বেরিয়েছে, ততবার-ই আমি একটা স্বচ্ছ দর্পণ খুঁজে পেয়েছি, যেখানে স্পষ্ট দেখা যায় উষালগ্নের টকটকে রক্তলাল উদিত সূর্যের মতো বাংলাদেশের অর্জিত স্বাধীনতার নেপথ্যের ত্যাগ ও তিতিক্ষা।
পাটিগণিতের হিসাব অনুসরণ করলে একাত্তরের বীজ বপন করা হয়েছিল তো সেই সাতচল্লিশে। সাতচল্লিশের দেশ ভাগের পর পাকিস্তান মূলত মাথা কাটা জামার মতো পরিধান করে রেখেছিল পূর্ব পাকিস্তানকে। পশ্চিম পাকিস্তানই ছিল পাকিস্তানের মাথা। মাথা বলে দেশের শাসনভারটা ছিল তাদের। অন্যদিকে, হাত-পা কাজে লাগিয়ে খেটেখুঁটে পেটেভাতে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা হয়তো ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের, কিন্তু মেধার মূল্যায়ন হতো যৎসামান্য। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অধিকার ও ক্ষমতার অসম বণ্টন ছিল চরম পর্যায়ে। দুই অঞ্চলের জনগণের ভাষা, শিক্ষা, খাদ্যাভ্যাস, ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতিতেও ছিল ভিন্নতা। দুই অঞ্চলের জনগণের ভিন্নতা গোঁছাতে গঠনমূলক মধ্যস্থ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বরং সবকিছুতে পূর্ব পাকিস্তানকে অধস্তন করে রাখার প্রবণতা ছিল শাসকদের আচরণে। সাধারণ জনগণ অসহ্য হয়ে উঠেছিল। নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার আদায়ে সদাই সোচ্চার ছিলেন। জনগণ তা মনে রেখেছিল। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণ ভোট দিয়েছিল আওয়ামী লীগকে। হ্যাঁ, সত্তরে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসনে জয়লাভ করার পরও শাসকেরা বিজয়ী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা শুরু করেছিল। একাত্তরের ৩রা মার্চের নির্ধারিত জাতীয় অধিবেশন হঠাৎ করে স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছিল মার্চের এক তারিখ। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে তাদের কুচক্র উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল তখন আরেকবার। পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেলে, অবলাও আগুনশক্তি হয়ে ফিরে আসে, বাস্তব মোকাবিলা করে। পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জনগণ সকল ভয়ভীতি উপেক্ষা করে রাজপথে নেমেছিল আবারও। অন্যদিকে, শাসকগোষ্ঠী শুরু করেছিল কড়া নিধন। তাজাপ্রাণ বিনাশে তাদের হাত কাঁপত না মোটেও। প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানে জনসভা, মিছিল, সাংবাদিক সম্মেলনও চলছিল প্রতিদিন। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি ওই ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন,’ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ হ্যাঁ, তিনি পুরো ভাষণেই বাঙালিদের মনে সাহস জুগিয়েছিলেন, মানসিকভাবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন।
বিশ্ব রাজনীতি তখনও প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো দ্বারা পরিচালিত হতো। প্রভাব খটিয়ে তারা যেকোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ দলগুলোর মাঝে প্রতিহিংসার বীজ রোপণ করত, কিংবা সূক্ষ্ম একটা কূটচাল খাটিয়ে যেকোনো দুই প্রতিবেশি রাষ্ট্রের মধ্যে সাপ নেউলে সম্পর্কের পটভূমি তৈরি করত। তবে, বর্তমানের সঙ্গে তখনকার দিনের পার্থক্যটা ছিল প্রযুক্তিতে। তখন প্রযুক্তির এত ঝনঝনানি ছিল না বিধায়, ছিল না প্রযুক্তিগত গুজবের মিছিল। রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিটি পদক্ষেপ বিচার করতে পারত সচেতন জনগণ।
শাসক যখন দানব হয়ে ওঠে, তখন নরক নেমে আসে ধরণিতে। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে গজব নেমে এসেছিল পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে বীভৎস সামরিক অভিযান চালিয়েছিল। সেই কালোরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেত, রাজারবাগ পুলিশলাইন, পিলখানাসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে মেশিনগানের গুলি ছুড়ে গণহারে মানুষ হত্যা করা হয়েছিল, আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট। ফুটপাতে ঘুমিয়ে থাকা গৃহহীন নিরীহ মানুষেরাও রেহাই পায়নি। জগন্নাথ হলে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল সারারাত, রোকেয়া হলের ছাত্রীদের উপর জঘন্যতম আক্রোশ। মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পূর্বনির্ধারিত তালিকা ধরে শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল এবং ধরে নেওয়া হয়েছিল। শুধু ঢাকা নয়, পুরো দেশেই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ধরণা করা হয়, শুধু মার্চের এক তারিখ থেকে ২৫ তারিখ রাত পর্যন্ত এক লক্ষের বেশি মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। সেই ২৫শে মার্চের শেষরাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করেছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। অবশ্য গ্রেফতারের পূর্বেই (২৫শে মার্চ মাঝরাতের পর/২৬ মার্চ সূচনালগ্নে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন এবং শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের নেতা এম.এ. হান্নান ও জেনারেল জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন, যা বেতারে প্রচারিত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার পর আওয়ামী লীগের আরেকজন অন্যতম নেতা তাজউদ্দীন আহমদ পরিকল্পিতভাবে দায়িত্ব নিয়ে মুজিবনগর (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার) সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। তখন মুক্তিকামী জনগণ বিবেকের তাড়নায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। দেশপ্রেমিকেরা স্বাধীনতার জন্যে জীবন বাজি রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পেরেছিলেন। হ্যাঁ, একাত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজর হেনরি কিসিঞ্জারের সকল মন্তব্য ও শত্রুতা ভ্রুক্ষেপ না করে পাকিস্তানের অবৈধ শাসকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন বাংলাদেশের সর্বস্তরের খেটে খাওয়া মানুষেরা, শিক্ষার্থীরা, এমন কি রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুসারীরাও। তবে, জামায়াতে ইসলাম, জামাতপন্থী ও একদল সুবিধাবাদী উচ্চ মর্যাদাবান মানুষেরা পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়ায়, সাধারণ জনগণের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল মাত্রাতিরিক্ত। তারা-ই মূলত রাজাকার। তারা আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর অনুচর ও গুপ্তচর হয়ে দেশের জনগণের সাথে প্রতারণা করেছিল। প্রতারক শত্রুর থেকেও ঘৃণিত, তারা তা প্রমাণ করেছিল তাদের আচরণে সেই একাত্তর সালেই।
পাকবাহিনীর হিংসাত্মক আক্রমণ ছিল বুদ্ধিজীবী, রাজনীতি সচেতন জনগণ, অমুসলিম জনগণ, মুক্তিবাহিনী ও তাদের মিত্রদের উপর। তাদের ধরে নিয়ে অমানবিক অত্যাচার করার পর হত্যা করা হতো। সারাদেশে শতশত বধ্যভূমি একাত্তরে গণহত্যার সাক্ষী। গণহত্যার পাশাপাশি গণধর্ষণ হয়েছিল ওইসব প্রতারকদের সহায়তায়। পাকসেনারা পৈশাচিক কামনা মেটাতে ধর্ম, গোত্র, পক্ষ-বিপক্ষ যাচাই বাছাই করত থোড়াই, তাদের প্রয়োজন ছিল বাঙালি যুবতী। ঘৃণিত ওইসব কর্মের ঠিকাদার ছিল ধর্মের লেবাস পরিহিত প্রতারকেরা।
সদ্য গর্ভজাত বাংলাদেশ যখন মৃত্যুপুরী, তখনও পশ্চিম পাকিস্তানের দালাল ও মৌলবাদী চাটুকারেরা মহান মুক্তিযুদ্ধকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ওদের প্ররোচনায় হিন্দুদের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। মানুষ হিন্দুদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে শঙ্কিত ছিল কেবলমাত্র তাদের ধর্মের কারণে। যে কারণে প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি ও ভিটেমাটি ফেলে শুধু প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল অসংখ্য হিন্দু।
একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন জনতার যুদ্ধ যখন সংকটাপন্ন অবস্থায় ছিল, অনিশ্চয়তায় সীমানা রেখা এঁকে দিয়েছিল ভারত। সকল প্রকার সহোযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল দেশটি। তারা বাংলাদেশের জনগণকে আশ্রয় দিয়েছিল, বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল, অবশেষে মুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশ।
একথা সত্য, একাত্তরে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত যদি সর্বপ্রকার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দিতো, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন আরো কঠিন হতো। আরো ধ্বংসাত্মক হতো। ভারতের সহযোগিতা ব্যতীত বাংলাদেশ একাত্তরে আদৌ স্বাধীন হতে পারত কি না, এই সন্দেহটা অবশ্য পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করা জামাতের দলনেতাদের ভারত বিরোধী মন্তব্যে চলে আসে।
দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বিশ্বমানচিত্রে যুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশ নামটি। সেই থেকে সগৌরবে লাল-সবুজের পতাকা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মাটিতেও পপতপত করে ওড়ে। তবে, কখনোই শতভাগ শত্রুমুক্ত হতে পারেনি বাংলাদেশের মাটি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের হত্যা, জেলহত্যা, ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলাসহ অন্তত কুড়ি বার বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করার চেষ্টা, ২০০৫ সালে বাংলা ভাই নামে পরিচিত সন্ত্রাসীর মাত্র একঘণ্টায় প্রতিটি জেলায় বোমা হামলা, ২০১৬ সালে হলি-আর্টিজান হামলা, সর্বশেষ ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র প্রমাণ করে তা। প্রতিবারই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে মূল্য দিতে হয়েছে, ধৈর্য ধরতে হয়েছে, সংঘবদ্ধ হতে হয়েছে।
ত্রিশ লক্ষ তাজা প্রাণ ও দুই লক্ষ বীরাঙ্গনার সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা নিয়ে এই ২০২৪ সালেও যখন প্রমাণিত রাষ্ট্রদ্রোহী দল উপহাস করে বলে, তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল, তখন ইতিহাস আপনা-আপনি বিকৃত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ বড় ধরণের ষড়যন্ত্রের শিকার। সেই রাজকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী ও তাদের অনুচর ও গুপ্তচরেরা রং বদলিয়ে সমন্বয়ক, উপদেষ্টা ও তাদের লাঠিয়াল লাল বাহিনী রূপে ফিরে এসেছে। সংগ্রামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে ক্ষমতা দখল করে রাতারাতি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, প্রমাণাদি নিশ্চিহ্ন করার পাশাপাশি সেই পূর্ব তালিকা অনুসরণ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ মুক্তমনা লেখক, পেশাজীবী, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক, সনাতনী ধর্মাবলম্বী, ব্যবসায়ী ও সাধারণ খেটে খাওয়া জনগণের উপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এখনো তাদের সেই মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা অটুট। বাদ যাচ্ছে না মুক্তিযোদ্ধা কিংবা তাঁদের কবর। ওরা প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধার পথ আগলে জনসম্মুখে মারধর করে, সমাধিতে আগুন জ্বালিয়ে দীর্ঘ তেপান্ন বছর পুষে রাখা হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। বর্তমানে বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলার এতটাই বেহাল অবস্থা যে জবাই করার হুমকি প্রচার করা হয়; মিথ্যা মামলায় আটক সাধু আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারে না; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল বাদেও নারীদের পথ আটকিয়ে পর্দা করার টোটকা-আদেশ দেওয়া হয়; পুলিশ কাজে যোগ দিতে ভরসা পায় না; গণহারে মিথ্যা হত্যামামলায় জড়িয়ে প্রতিহিংসা বাস্তবায়ন করা হয়; কাউকে গ্রেফতার করার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কর্মীর উপস্থিতিতে তাকে অসাংবিধানিক সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী মারধর করে; সারাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য নিম্নমুখী; বিনিয়োগকারী বিনিয়োগে ভরসা পায় না বলে রপ্তানি বানিজ্য থমথমে। মৌলবাদের আস্ফালন ও সাধারণ জনগণের জীবনের মৌলিক চাহিদার অনিশ্চয়তা ঠিক একাত্তরের পূর্বাবস্থায়। পাকিস্তানের জয়গান বাজে বাংলার বুকে, তাদের জাহাজ ভিড়ে চট্রগ্রাম বন্দরে, তাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। তেপান্ন বছর পূর্বের ঠিক সেই পাকিস্তানের অস্তিত্ব ফুলে-ফেঁপে একাত্তরে অর্জিত স্বাধীনতাকে অপমান করে নতুন করে। ২০২৪ এ এসে হোঁচট খাই। একাত্তরকে আরেকবার নতুন করে আবিষ্কার করি। একাত্তর যেমন বাংলাদেশে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল, একাত্তর তেমন কিছু দেশদ্রোহীরও জন্মদিয়েছিল। যে দেশদ্রোহীরা স্বাধীনতার সকল সুযোগসুবিধা ভোগ করার পরও পুরো সময় ধরে অত্যন্ত মন্থর গতিতে জনগণের আবেগ, বোধ ও বুদ্ধি নিয়ে খেলেছে, কৌশলে বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবনে বিপর্যয় ঘটিয়েছে এবং বংশবৃদ্ধি করে নিজেদের দল বৃহত্তর করেছে।
স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। হ্যাঁ, তিপ্পান্ন বছর পরেও স্বাধীনতা রক্ষা করতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। দেশপ্রেম ও হৃদয়ে একাত্তর ধারণ করা ব্যতিরেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। যারা দেশ ভালোবাসেন, তারা প্রত্যেকে হৃদয়ে একাত্তর সমানভাবে ধারণ না-ও করতে পারেন। কিন্তু বর্তমান চলমান ষড়যন্ত্র থেকেও মুক্তির উপায় ওই একাত্তরে-ই নিহিত। একাত্তর ব্যতীত আমাদের উপায় নেই। হ্যাঁ, একাত্তর এড়িয়ে যাওয়ার কিছু নয়। একাত্তর বাংলার জন্মকাল। একাত্তর বাংলার গৌরব। একাত্তর মুক্তিকামী জনতার মনোবল। একাত্তর অবিনশ্বর। একাত্তরই বাংলাদেশ।
খুরশীদ শাম্মী
টরন্টো, অন্টারিও
ডিসেম্বর ২,২০২৪
-
নিবন্ধ // মতামত
-
14-12-2024
-
-