অটোয়া, সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার ও মিডিয়া - ড. ফজলুল হক সৈকত

রও এক পুলিশ অফিসারের (ডিআইজি জামিল হাসান) বিপুল অবৈধ সম্পদের হদিস মিলেছে। গত ঈদে প্রকাশ পেয়েছে একজন রাজস্ব কর্মকর্তার অবৈধ টাকার কাহিনি। এসব খবরের নেতিবাচক দিকের পাশাপাশি ইতিবাচকতা আছে। অনন্ত জনগণের কাছে কিছুটা হলেও জবাবদিহিতার প্রশ্নে সম্মানের জায়গা তৈরি করে নিতে পারছে মিডিয়া এবং সরকার। এভাবে বিভিন্ন ক্ষমতাধর ব্যক্তির অপকর্মের তথ্য প্রকাশ হতে থাকলে দুর্নীতিবাজরা যেমন সাবধান হবেন, তেমনই জনগণের মাল-জানের সুরক্ষাও অনেকটা নিশ্চিত করা যাবে। - এটি একটি সামাজিক ব্যাখা বা দর্শন। আবার এর অপরপিঠ বা ভিন্ন মতও রয়েছে। আজ সেনাবাহিনী, কাল পুলিশ, তো পরশু অন্য কোনো বাহিনি-সংস্থা বা বিভাগের লোকেদের সম্পদের পাহাড় বের হতে থাকলে এক সময় সব দুর্নীতিবাজ ধরা পড়বে - এমন আশা যারা করছেন, তারা কি ঠিক ভাবছেন? পত্রিকাগুলো সরব হয়েছে- এটা নিশ্চয় ভালো কথা; কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, সাংবাদিকরা কেন এতোদিন এসবের খবর পেলেন না - কিংবা জানলেও কেন তা প্রকাশ করলেন না? তাহলে খবরের ভেতরের খবর কী? এর পেছনে অন্য কোনো রাজনীতির খেলা কাজ করছে কি-না, তাও ভেবে দেখার সময় হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিপন্ন গণতন্ত্রে অসহায় জনগণকে নিয়ে লুকোচুরি খেলার বিচিত্র ধরন দৃষ্টিগোচর হয়। উন্নয়নের গণতন্ত্র যখন আর মানুষকে সবকিছু ভুলিয়ে রাখতে পারে না, যখন ভোটারটা প্রায় ঘর থেকে বের হওয়া ছেড়ে দেয় - মুখ ফিরিয়ে নেয় সমকালীন-চলমান রাজনীতি থেকে, তখন হঠাৎ দুর্নীতিবাজ ধরার রাজনীতি সত্যিই ভেবে দেখার মতো। আজিজ অথবা বেনজির কি জানতেন তাদের ক্ষমতা না থাকলে সরকার বা মিডিয়া এভাবে তাদের বিরুদ্ধে যাবে? তারা যখন পদে ছিলেন, তখন তো দেশে একই দলের সরকার এবং এইসব ‘দায়িত্বশীল’ মিডিয়াই কাজ করছিল। তো তখন কেন তারা আজিজ-বেনজিরদের কথা তুলতে পারেননি? তাহলে কি ওসব পক্ষ এদের পদের ক্ষমতাকে ব্যবহার করেছে? না-কি ভয় পেয়েছে? 

এভাবে একজন, দুইজন করে ধরে ধরে কতোদিনে দেশ দুর্নীতিমুক্ত করা হবে? কোরবানির বাজারে কি কেবল ওই একটা ছাগলই কেনা-বেচা হয়েছে? সমস্ত হাটে হাটে কি প্রতিবছর এমন লক্ষ-কোটি টাকার পশু কেনার বাহাদুরি চোখে পড়ে না? জনগণের সামনেই তো ঘটছে এসব। এলাকার লোকেরা তো এদেরকে চেনে। প্রশাসনও চেনে। নির্বাচিত বা ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ জনপ্রতিনিধিরাও জানেন এগুলো। তাহলে, সকলে একটু সতর্ক হলেই তো হয়। দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অভিযানের কথা শোনা যায়। তাহলে শুরু করা হোক না দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘নতুন ধরনের’ কোনো অভিযান। প্রশাসন এবং মিডিয়া সাধারণ জনগণের সহযোগিতা নিয়ে অগ্রসর হতে পারে। সরকার দুর্নীতিবাদের তালিকা চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করতে পারে। ফোন, ই-মেইল, প্রচারপত্র প্রভৃতির মাধ্যমে জনতা নিজ নিজ এলাকার দুর্নীতিবাজদের ব্যাপারে তথ্য প্রদান করতে পারে। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত প্রচার হতে পারে তথ্যভিত্তিক পোস্ট। নির্দিষ্ট সংস্থা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মনিটরিং করে তথ্য যাচাই করতে পারে। অনেক লেখক-শিক্ষক-সমাজসেবি তাদের নিজ নিজ ফেসবুক টাইমলাইনে নিয়মিত লিখছেন এসব বিষয়ে - তাদের বক্তব্য ও বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেও অনেক তথ্য পাওয়া সম্ভব। ইউটিউবসহ ভিজ্যুয়াল মিডিয়াও হতে পারে তথ্য-সংগ্রহের উৎস। 

বর্তমানে যে দল ক্ষমতায় রয়েছে, তাদের আছে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ঐতিহ্য। দলটি যদি সত্যি চায় যে, দেশ থেকে দুর্নীতি অপসারণ করবে, জনগণের কল্যাণে কাজ করবে, তাহলে তা করে দেখানো সম্ভব। সরকার বা ক্ষমতাশীন দল যদি বলতে চায় যে, দুর্নীতিবাদেরকে তারা প্রশ্রয় দেয়নি বা কোনো সহযোগিতা বা পারস্পরিক বোঝাপড়া নেই তাদের সাথে, তো তারা অনায়াসে সমাজের সকল শ্রেণির অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। যদি পুলিশ বিভাগকে অপেক্ষাকৃত বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত মনে হয় এবং যদি ধারণা করা হয় যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানে সরকারকে তারা সহযোগিতা করবে না, তাহলে অন্য কোনো বিভাগকে এই দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। এক এক করে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ও প্রমাণাদি নজরে আসার পর সরকারের জন্য এখন বিশেষ অভিযানের বিষয়টি সত্যিই জরুরি হয়ে পড়েছে। জননিরাপত্তার জন্যও বিষয়টি বেশ কার্যকর হতে পারে।

তবে শুধু বাহিনিগুলোর দিকে বা সরকারি আমলা ও কর্মকর্তাদের দিকে মিডিয়ার সাম্প্রতিক যে নজরদারি, তাও যথেষ্ট যৌক্তিক নয়; কেননা, অপরাধ ও দুর্নীতি বর্তমানে সমাজের সকল স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে এবং ব্যাপকভাবে তা বিস্তৃত। চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবি, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, সমাজকর্মি, ছাত্রনেতা, অধিকারকর্মি, সংবাদকর্মি - কাকে বাদ দেওয়া যায়? এখন প্রয়োজন সত্যিকারের ‘চিরুনি অভিযান’। বিশেষ করে সরকারি দল তাদের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত এবং সৎ রাজনৈতিক নেতা ও কর্মিদেরকে এই শুদ্ধি অভিযানে কাজে লাগাতে পারে। এছাড়া সত্যিকারের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও সরকারকে সহযোগিতা করতে পারে। যে অঞ্চলে জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের বা অন্যান্য অপকর্মের অভিযোগ নেই, তারা স্ব-উদ্যোগে শুরু করতে পারেন নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার শুদ্ধি অভিযান। সরকার বা দল তাদেরকে দায়িত্ব দিতে পারেন এ ব্যাপারে। সরকার ও মিডিয়াকে তারা দুর্নীতির সঠিক তথ্য পরিবেশন করতে পারেন। আর যে সব এলাকার জনপ্রতিনিধিরা বিতর্কিত, তাদের নির্বাচনী এলাকায় সরকার বা ক্ষমতাশীন দল তাদের বিশ্বস্ত ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা-কর্মি, স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান আরম্ভ করতে পারে। এ ভাবনাগুলো জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা, সমাজ যখন অপরাধের অভয়ারণ্য হয়ে পড়ে, তখন জনগণ বাঁচবার বা পালানোর পথ পায় না। 

শুধু যে দুর্নীতিবাজ বা অর্থপাচারকারীরা দেশ ত্যাগ করছে, তা কিন্তু নয়। দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে টিকতে না পেরেও লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ দেশ ছাড়ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশে কোনো নির্ভরযোগ্য গবেষণা আজও হয়নি। গত ৪-৫ দশকে কী পরিমাণ শিক্ষিত-যোগ্য-অভিজ্ঞ লোক দেশ ছেড়েছে, তার হিসাব কি সরকার বা রাজনৈতিক দল বা মিডিয়ার কাছে আছে? শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, মিডিয়াকর্মি, শিল্পী-সাহিত্যিক হাজারে হাজারে দেশ ছেড়ে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছেন বা খুঁজছেন ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ও অঞ্চলে। বিরোধী দলগুলোও এসব ক্ষেত্রে কেন নীরব ভূমিকা পালন করছে? তারাও তো বিভিন্ন গবেষণা বা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এসব তথ্য প্রচার করতে পারে। যারা দেশ ত্যাগ করছেন - একা বা পরিবার-পরিজন নিয়ে, তারা সকলে দুর্নীতিবাজ নয়; অন্তত ১ কোটি বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন জীবিকা বা লেখাপড়ার জন্য। কর্মজীবিরা নিয়মিত প্রতি মাসে হাজার হাজার কোটি টাকা রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন। তাদের কথাও বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশ থেকে যারা টাকা বিদেশে পাচার করছে, তাদের কারণে এই রেমিটেন্স পাঠানো কর্মিদের ওপরও প্রভাব পড়ছে। উন্নত দেশে এসব কর্মিদের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে অর্থ পাচারকারীরা। 

সমাজ একদিনে পরিচ্ছন্ন করা সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই এর জন্য সময় দরকার। কিন্তু এও মনে রাখতে হয় যে, ঝড়ের দিনে আম কুড়াতে হয়; সময় ফুরালে কোনো কাজই সমাধা হয় না। কোনো কোনো সময় বিশেষ কিছু কাজের জন্য সহায়ক হয়ে আসে। বর্তমানে বাংলাদেশের যে সামাজিক অবস্থা, মিডিয়া ও জনমতকে কাজে লাগিয়ে সরকার সত্যি সত্যি দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র গড়ার কাজ এখনই আরম্ভ করতে পারে। অবশ্য যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকে। সময় অনুকূলে বটে। এখন শুধু দেখার পালা সরকার ও জনগণ কীভাবে এই সময়কে কাজে লাগায়।

ড. ফজলুল হক সৈকত: শিক্ষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।