অটোয়া, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪
আকাশের ধ্রবতারা ও একলা আমি - মোবারক মন্ডল

বিকেলে বদ্ধ ঘরে মন টেকে না। ছাদে উঠি। বিশাল আকাশ দেখি। সূর্যাস্ত দেখি। আকাশের দ্রুত রঙ বদলানো দেখি। আজও তাই ছাদে উঠলাম। সূর্যাস্তের ছবি তুললাম। প্রিয় মানুষদের পাঠালাম। তারপর মাগরিবের আজান হলো। গোধূলির নরম আলোয় ছাদেই ফরজ নামাজ শেষ করে আল্লাহর কাছ হাত তুলে প্রার্থনা করবার সময় চোখ পড়ে গেল লালচে আভায় ঢাকা আকাশের ধ্রুবতারার দিকে। আশে পাশে কেউ নেই। সে একা। বৃহৎ হিরক খণ্ডের মতো জ্বল জ্বল করছে। ছেলে বেলার অনেক কথা মনে পড়ে গেল। বুঝলাম, প্রার্থনা হলো না আজ। আল্লাহর দিকে আমার মন নেই। রুটিন নামাজ হলো। 

তাকিয়ে রইলাম ধ্রুবতারার দিকে। বহুদিন পর যেন তাকে এত যত্ন ভালোবাসা নিয়ে দেখছি। মনে হচ্ছে আরে এতো আমার সেই সাথী ধ্রুবতারা। ছোট বেলা থেকে বড় বেলা আমার একাকী চলার পথের চিরকালীন সাথী। আজও একা আছি ছাদে। আবার কখনও কখনও সকলের মাঝে, ভিড়ের মাঝে থেকেও নিজেকে খুব একা মনে হয়। অদ্ভুত সব চিন্তা মাথায় ভিড় করে। খুব সাধারণ জিনিস ভুল করি। ভয়ও লাগে। কারণ আমার দাদো আহমাদ মন্ডল দুবার হাফ পাগল হয়েছিল।

এবার পাতলা অন্ধকার আমায় ঘিরে ধরলো। রুপালি তরুণী চাঁদ পূব আকাশের অনেকটা উপরে। পরিষ্কার আকাশ। পশ্চিমে ধ্রুবতারা আরও উজ্জ্বল এবং স্পষ্ট। তার আশে পাশে কেউ নেই। আমিও একা। মনে পড়লো, সেই ছোটবেলা থেকে ধ্রুবতারার সাথে আমার নিবিড় সখ্যতা। ইদানীং বহুদিন ওর দিকে ভালো করে তাকাই নি। বড় হয়েছি। ব্যস্ত হয়েছি। বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা নামলে গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে দিই। এক সময়ের সাথীর দিকে ঘুরে তাকাই না। সে কিন্তু আমায় রোজ দেখে। সে জানে আমার দৌড় কতদূর। তাই সে মুচকি হাসে আমার ব্যস্ততা দেখে। 

ছোট বেলায় আমাদের মাঠের জমিতে বোরো ধান লাগানো হতো। বাড়িতে থাকলে এই রকম চৈত্র মাসের বিকেলে রোজ ধানে জল দিতে যেতে হতো। (ডিজেল মেশিন চালিয়ে) বাড়ি থেকে এই জমিটা দুই কিমি দূরে ছিল। মাঠে জল দিয়ে ফেরার সময় সন্ধ্যা নেমে যেত। একা একা আল পথ দিয়ে ফেরার সময় গোধূলির রঙে রাঙা আকাশে এই ধ্রুবতারা আমায় রোজ সঙ্গ দিত। ওর উজ্জ্বলতা আমায় এত আকৃষ্ট করতো যে সরু আলপথের দিকে না তাকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সরু ফালি চাঁদ এবং ধ্রুবতারা যখন গোধূলি বেলায় এক সঙ্গে থাকতো, তখন আরও ভালো লাগতো। নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হতো না। মনে হতো সেও আমার সাথে সাথে চলছে। 
একদিন ফেরার সময় ওই ধ্রুবতারার দিকে তাকাতে তাকাতে হাঁটছি সরু আল পথ দিয়ে। আলের পাশে ছিল নতুন বেগুনের জমি। আলের ধারে খেজুরের কাঁটার ডাল ঘন করে দেওয়া ছিল। এটা খেয়াল করি নি। তখন আকাশে লাল আভা থাকলেও নীচে পাতলা অন্ধকার ঘিরে ধরেছে। উপরের দিকে তাকাতে গিয়ে ডান পা হড়কে গেল। দু তিনটে খেজুরের কাঁটা ঢুকে গেল ডান পায়ে। কি যন্ত্রণা বোঝাতে পারবো না। যাঁরা খেজুরের কাঁটা খেয়েছেন তারাই একমাত্র বুঝবেন এর বিষ কত। তখন টর্চ ছিল না কাছে। চিৎকার করতেও পারলাম না। কাছে পিঠেও কেউ নেই। কোন রকমে টান মেরে কাঁটা বের করলাম। পা সোজা করতে পারলাম না। খুব কষ্টে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ি ফিরলাম। একবারও মাকে বলিনি ধ্রুবতারা দেখতে পায়ে কাঁটা বাঁধিয়েছি। সেবার ওই কাঁটা খুব কষ্ট দিয়েছিল।
মোল্লাতলার মাঠ, হড়িগাড়ির মাঠ থেকে ফেরার সময় কত শতবার এই ধ্রুবতারা যে আমার সাথী হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
হোস্টেলে থাকার সময় স্কুলের মাঠে কতদিন সে আমার মন খারাপের সঙ্গী হয়েছে। 
কলেজর সময় হোস্টেলের ছাদে যখন উঠতাম, দেখতাম ঠায় চেয়ে রয়েছে সেই ছোট বেলার আমার একাকিত্বের সঙ্গী। 
কত শত লক্ষ মানুষকে যুগ যুগ ধরে তুমি ভরসা দিয়ে এসেছো ধ্রুবতারা। সঙ্গ দিয়েছ। একাকিত্বের সঙ্গী হয়েছ। মাঝ দরিয়ায় প্রচন্ড ঝড়ে যখন হাজার হাজার নাবিক দিকভ্রান্ত হয়েছে, তুমি তাদের মনে ভরসা জাগিয়ে, আশা জাগিয়ে সঠিক পথে পরিচালিত করেছো। 

ধ্রুবতারা, তুমি চিরকাল অবিচল, স্থির। তুমি তোমার রূপ বদলাও না। চরিত্র বদলাও না। আশাহত করো না। অথচ আমরা, প্রেমিক প্রেমিকারা প্রিয়জনকে যখন কথা দিই, তখন তোমার উদাহরণ টেনে বলি, 'আমি ধ্রুবতারার মতো রবো তোমার জীবনে। সবাই বদলাবে, সব কিছু বদলাবে। আমি ধ্রুবতারা হয়েই থাকবো।' আমরা ধ্রুবতারা হয়ে থাকতে পারি না। কথা রাখিনা।
কত প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকি। কিন্তু কটা পূর্ণ করতে পারি? সততার পথে, ন্যায়ের পথে, মানুষকে সেবার পথে চলার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু পথ পাল্টে যায়। নিজের সাথে প্রতিনিয়ত তঞ্চকতা করি। লোকের সামনে নিজেকে ভালো দেখানোর অভিনয় করি। মিথ্যা, স্বার্থপরতা, হিংসা, লোভ, রিপু ইত্যাদির পলি  মনের উপর পড়তে পড়তে শৈশবের পবিত্র মনটা কোথায় হারিয়ে যায়। শুধুই দীর্ঘশ্বাস পড়ে তখন! না, ধ্রুবতারা কিছুই শেখাতে পারে নি আমায়!

হালকা রুপোলি আলোর নীচে আমি এখনো আছি। ধ্রুবতারা রয়েছে সেখানেই যেখানে প্রতিদিন তার থাকার কথা। ধ্রুবতারা বদলায় নি। শৈশবে তাকে যেমন দেখেছিলাম, আজও সে তেমনি আছে। শুধুমাত্র আমিই বদলে গেছি। শৈশব চলে গেছে, তারুণ্য এসেছে,  আমি বদলে গিয়েছি। একদিন বার্ধক্য আমায় জড়িয়ে ধরবে। তারপর একদিন মাটির সাথে মিশে যাবো। ধ্রুবতারা রয়ে যাবে। একই রকমভাবে। আবার কোনো হাবলা ভ্যাবলা ছেলের সাথী হবে সে। হয়তো আজ কোন গাঁয়ের পথে সে কোন একলা ছেলের সঙ্গী হয়েছে!!

মোবারক মন্ডল 
নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ