অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
সিন্ধু থেকে গঙ্গাঃ ভারতীয় চারুকলার ক্রমবিবর্তন (দুই)

৮) আধুনিক সময়ের প্রাক্কালে উপনিবেশিক অধ্যায় (১৪০০-১৮০০ শতাব্দি): দশম শতকের মাঝামাঝি ভারতে মুসলমানদের আগমন ঘটলেও মুঘলরাই প্রথম চারুকলার উপর পৃষ্টপোষকতা শুরু করেন। সম্রাট আকবরের সময়কে (১৫৫৬-১৬০৫) বলা হয় চারুকলায় উন্মেষকাল। তিনি তাঁর রাজধানী ফতেপুর সিক্রির রাজসভায় নিয়ে এলেন প্রথিতযশা দুই পার্সি চিত্রকর মীর সাইয়েদ আলী ও আব্দুল সামাদ’কে। প্রতিষ্ঠা করলেন শিল্পশালা( Atelier)। গুজরাট, গুয়ালিয়র এবং কাশ্মিরের শতাধিক হিন্দু চিত্রশিল্পিকে তিনি তাঁদের সাথে যুক্ত করে জন্ম দিলেন ইতিহাসের বিখ্যাত Mughal School of Miniature Paintings । স্কুলের প্রথম সিরিজ চিত্রকর্ম ছিল মীর সাইয়েদ আলির চিত্রনে “হামজানামা”। এটির কাজ ১৫৬৭ থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় ১৫৮২ সনে। ‘পারসিয়ান সাভাবি’ রীতিতে কাপড়ের উপর আঁকা চিত্রটি প্রফেটের চাচা আমির হামজার গল্পের উপর নির্মিত। এতে প্রধান রং হিসাবে ব্যবহৃত হয় উজ্জ্বল লাল, নীল এবং সবুজ। আকবরের সময়েই চারুকলায় পার্সিয়ান রীতির সাথে রাজপুত ও পাহাড়ি ঘরানার রীতি যুক্ত হয়। তাঁরা চিত্রে প্রথমবারের মত যুক্ত করেন জীবজন্তু, গাছপালা। আকবরের মৃত্যুর পর তার পুত্র জাহাঙ্গীর (১৬০৫-১৬২৭) তার বাবার আমলের এক সাথে বসে ছবি আঁকার রীতির পরিবর্তে একক ভাবে আলাদা আলাদা ছবি আঁকার উপর গুরুত্ব দেন। এর ফলে শিল্পীদের স্বাতন্ত্র রীতির উন্মেষ ঘটে। আত্মপ্রকাশ করেন বিষান দাস, মনোহর দাস, আবু আল হাসান, গোবর্ধন এবং দৌলতের মত শিল্পীদের। তাঁরা মহাভারতের অনুকরনে তৈরী করলেন গল্পভিত্তিক চিত্র ‘রাজনামা’ ও ‘তাজুক-ই-জাহাংগির’। আর সম্রাট শাহ্‌জাহান (১৬২৮-১৬৫৮) তো অমর হয়ে রইলেন “তাজমহল” দিয়ে। আওড়ঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭) ছিলেন গোঁড়া সুন্নি মুসলমান। তিনি বলপূর্বক তার পিতা শাহজাহানের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করে ১৬৮০ সনে সঙ্গীত এবং চিত্রকলার উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। অবসান ঘটে চিত্রকলার উপর মুঘলদের পৃষ্টপোষকতার।


মীর সায়ে আলীর করা “হামজানামা”, ১৫৮২ ও মুঘল চিত্রকলা 

৯) উত্তর ভারতের মুঘল চিত্রকলা (১৬০০ শতাব্দি পরবর্তী):  পনেরশ শতকের শেষ দিকে বিজাপুর, গোল্কুন্ডার সুলতানরা চিত্রকলায় যুক্ত করেছিলেন ধাতবের ঢালাই, পাথর বাঁকানো এবং পেইন্টিং। তখন পার্সি রীতির সাথে সংযোজন হয় ভারতীয় রীতির। স্থাপত্য রীতিতে যুক্ত হয় দুর্গ ও সমাধি। ১৬০০ শতাব্দিতে মুঘলদের আহমদনগর বিজয়ের পর টার্কো-মংগল-মুঘল-পার্সি চিত্রকলা আবার যাত্রা শুরু করে; Deccan school of Painting এর প্রভাবে গোলকুন্ডায় ক্ষুদ্রচিত্রের প্রসার ঘটে। এ সময়েই পার্সি, ভারতীয় এবং ইসলামিক ধারার সমন্বয়ে শুরু হয় আরেক নতুন ধারার। শিল্পীরা তুলির আচরে তুলে আনেন বন্য শিকার, বিজয় গাঁথা, বিবাহ উৎসব। 
১০) রাজপুত ঘরানাঃ ১৮ শতকে ভারতের রাজপুতানায় রামায়ন, মহাভারত, শ্রীকৃষ্ণের জীবনী, চমৎকার ভূদৃশ্য (Landscape) ও মানুষদের নিয়ে কারুশিল্পে নবযুগের সুচনা হয়। ওই সময়ে চিত্রকলায় প্রধান বৈশিস্ট ছিল ক্ষুদ্র ও বৃহতাকার দেয়াল চিত্র এবং ভাস্কর্য। সুক্ষ তুলির কাজে রং হিসাবে খনিজ, ভেষজ, মুল্যবান পাথর, সোনা, রুপা ব্যবহৃত হয়েছিল।

 
রাজপুত ঘরানার চিত্র, ১৮শ শতক

১১) ব্রিটিশরাজ (১৮৪১-১৯৪৭ শতাব্দি): ১৮৫৭ সনে পলাশীর প্রান্তর থেকে ভারতের ক্ষমতা নিয়ে নেয় ব্রিটিশরাজ। ব্রিটিশরাজ কায়েম হবার পর সম্পদশালী রাজন্যবর্গ চিরায়ত ভারতীয় চিত্রকলার উপর প্রভাব বিস্তার শুরু করে। তাঁরা ভারতের বড় বড় শহরে চারুকলা বিদ্যালয় গড়ে তুলে। ১৮৮৮ সনে মুম্বাইয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় Bombay Art Society। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পৃস্টপোষকতায় স্বদেশী শিল্পীরা হালকা মাধ্যমের উপর জলরং’দিয়ে রোমান্টিক কাজ শুরু করেন। রাজা রবি ভার্মা’র “শাড়ি পরা নারী” তৈলচিত্রে তার দৃষ্টান্ত। 
১২) কারুকলার পুনরুজ্জ্বীবন কাল (১৯০০ শতাব্দি থেকে বর্তমান): ১৯০৫ সনে শুরু হওয়া স্বদেশী আন্দোলনের শিল্পীরা আত্মপরিচয়ের সন্ধানে আত্মমগ্ন হন। তাঁরা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৭১-১৯৫১) নেতৃত্বে গড়ে তুলেন Bengal School of Arts। এশীয় রীতির সাথে যোগ হলো জাতীয়তাবাদী চেতনা। অবনীন্দ্রনাথকে বলা হয় আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার জনক।  ঠাকুর বাড়ির রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬৭- ১৯৩৮) এবং বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকের নতুন শিল্পী অমৃতা শের-গীল (১৯১৩- ১৯৪১)রা ভারতীয় চিত্ররীতির সাথে পশ্চিমাদের এভান্ত-গার্দে চিত্ররীতির পরিচয় ঘটান। যামিনি রায়, এস এইচ রাজা তাঁদের চিত্রে লোকজ ঐতিহ্যকেই প্রাধান্য দিলেন। ১৯৪৪ সনে মাদ্রাজে পানিকরের নেতৃত্বে গঠন হলো প্রগতিশীল পেইন্টার এসোসিয়েসন, যা পরে মাদ্রাজ আন্দোলন নামে পরিচিতি পায়।

 
যামিনি রায় এবং অবনিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা চিত্র  

১৩) খোলা বাতাস (১৯৪৭ এর পর): স্বাধীনতার পর ভারতের শিল্পকলায় আধুনিকতার সাথে প্রযুক্তিও প্রবেশ করে। চিরায়ত ভারতীয় থিম এবং ইমেজকে ধারন করে পাশ্চাত্য ধারার অনুকরনে গড়ে উঠতে শুরু করে চারুকলা গ্যালারী। এর ফলে বিশ্বে ভারতীয় শিল্পীদের স্বীকৃতি আসতে শুরু করে। ১৯৫২ সনে ৬জন শিল্পী মিলে গঠন করলেন Bombay Progressive Artists’ Group । সেখানে ছিলেন K H Ara, S K Bakre, H A Gade, M F Husain, S H Raza, Franzis Newton Souza । তাঁদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন প্রথম সারির শিল্পি Bal Chapda, Manishi Dev, Krishen Khanna, Ram Kumar, Tyeb Mehta, Akbar Padamsee, সহ অনেকেই। তারাই ছিলেন ভারতীর চিত্রকলার আইকন। স্বপ্রতিভায় আত্মপ্রকাশ করেন বসু কৃষ্ণমাচারি, বিকাশ ভট্টাচার্য, নলিনি মালিনি, সুবোধ গুপ্ত’রা। ভারতি দয়াল তার নিজস্ব কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করে ঐতিহ্যবাহী মিথিলা ঘরানায় নিয়ে এলেন আধুনিকতা। অনিষ কাপুর এবং চিন্তন’রা স্বাধীনতা পরবর্তী দুই মহৎ শিল্পী যারা আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের শিল্প নিয়ে দাপটের সাথে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁদের সময়ে আমেরিকা এবং ইউরোপের শিল্প গ্যালারি গুলোতে ভারতীয় চিত্রকর্ম প্রসংশিত হয়। তাছাড়াও চিমন ডেংগি, ভুপাল দুধি, সুবোধ গুপ্ত, পিউ সরকার, ভগরাম চৌধুরী, অমিতাভ সেনগুপ্ত এবং ছায়া ঘোষ বিশ্ব চিত্রকলার ভুবনে সৃষ্টি করেছিলেন চোখ ধাঁধানো যাদু।
চলবে…
ছবি কৃতজ্ঞতা- লেখক এবং আন্তর্জাল

শিবব্রত নন্দী দুলাল
গুয়েলফ, কানাডা।
shibanandi@gmail.com