সিন্ধু থেকে গঙ্গাঃ ভারতীয় চারুকলার ক্রমবিবর্তন- শেষ পর্ব
স্পস্টকরণ (Clarification of terms):
ক) ছদ্ধবাস্তবতা (Pseudo realism): দেবজ্যোতি রায় সুচনা করেন “ছদ্ধবাস্তবতা (Pseudo realism)”, যা ভারতের মাটি থেকে উঠে আসা একটি আদি শিল্পরীতি। এটি চলমান ভারতীয় জীবনের বিমুর্ততার প্রতীক।
খ) প্রাসংগিক আধুনিকতাবাদ (Contextual Modernism): উপনেবেশীক পরবর্তী কালে শান্তিনিকেতনের শিল্পীদের আলাদা ভাবে বুঝাতে শিব কুমার এ কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন। ১৯৯৭ সনে জন্ম নেয় শিল্পের দুটি দলঃ বরোদা এবং শান্তিনিকেতনি দল। পাশ্চাত্যে উপনেবেশিকতার সাথে বর্ণবাদ যুক্ত হবার জন্য পল গিল্রয় তার বিকল্প প্রাচ্যের প্রাসঙ্গিক আধুনিকতাবাদ কথাটি ব্যবহার করেন। শান্তিনিকেতনবাদীরা আন্তর্জাতিক আধুনিকতাবাদ এবং ঐতিহাসিক দেশীয়বাদের বিপরীতে সংবেদনশীল আধুনিকতাবাদের (Sensitive Modernism) জন্ম দেন।
গ) ভাস্কর্যঃ হরপ্পা-মহেঞ্জদারোতে ব্রোঞ্জ দিয়ে নির্মিত পুরুষ নৃত্যশিল্পির অবয়ব ছিল ভারতের প্রথম ভাস্কর্য। এ সময়ে গড়ে উঠেছিল পোড়া মাটির কাজ, পাথরের প্রাণী ও দেব-দেবীর মুর্তি। খ্রিস্টপুর্ব ২৬৮-২৩২ সনে অশোকের শাসনামলে“অশোক স্তম্ভে” সিংহের মাথায় প্রতিকৃতি ঠাই পায়। প্রথম দিকে বৌদ্ধ ও হিন্দু ভাস্কর্যে কাঠই ছিল মুখ্য উপাদান। আফগানিস্তানের বিখ্যাত গান্ধারান ভাস্কর্য বিদ্যালয়ের বৌদ্ধ ছিল নিখুঁত কাজের দৃষ্টান্ত। গান্ধারান স্কুলই বুদ্ধের মাথায় কোকরানো চুল, কাধের উপর কাপড়, পাদুকা ও বাসক পাতা ব্যবহার করে। ১ম ও ৩য় খ্রিস্টাব্দে ভারতের ভাস্কর্যে গোলাপী বালি, গ্রানাইট ব্যবহার শুরু হয়। ইলোরা গুহা এবং নটরাজ রুপি শিব তার উদাহরন।
ঘ) জুয়েলারি শিল্পঃ উপমহাদেশের জুয়েলারি শিল্পের ইতিহাস ৫০০০ বছরের পুরানো। ভারতীয় সমাজে স্বর্নের অলংকারকে মনে করা হয় একটি সম্পদ। সবচেয়ে পুরানো জুয়েলারি পাওয়া গেছে সিন্ধু সভ্যতায়।
ঙ) লোকজ এবং ট্রাইবাল চিত্রকলাঃ লোকজ এবং ট্রাইবাল চিত্রকর্মে মাধ্যম হিসাবে পোড়া মাটি, পেইন্টিং, ধাতব কাজ, কাগজের উপর চিত্র, বুনন শিল্প, খেলনা এবং জুয়েলারি নক্সা। মানুষের জীবনাচার, বিশ্বাস নিয়ে নির্মিত ভাস্কর্য, মুখোশ, চিত্র, কাপড়, বাস্কেট, রান্না ঘড়ের সরঞ্জাম, মানুষের দেহ প্রাধান্য পেতো।
চ) স্বদেশীয় চিত্রকলা (Vernacular Painting): স্বদেশীয় চিত্রকলা বলতে বুঝায় ঘটে যাওয়া বর্ণিত বিষয়ের (শ্রুতি, ঐতিহ্যগত এবং ধর্মীয়) উপর জীবন্ত চিত্র। একটি নির্দিস্ট নৃগোষ্ঠীর সমন্বিত স্মৃতিচারন থেকে তা তৈরি, যেমনঃ ট্রাইবাল পেইন্টিং, সাঁওতাল পেইন্টিং, লোকজ চিত্র, পট্টবস্থ চিত্র, মাটির পাত্রের চিত্র, দেয়াল চিত্র।
ছ) মহীশুর চিত্রকলাঃ মহীশূর হচ্ছে দক্ষিন ভারতের দ্রুপদি চিত্রকলার জন্মস্থান। সেখানকার চারুকলায় বিনম্রতা, চারুতা, নিঃশব্দ স্নেহময়ী রং এবং গভীর মনোযোগ মুর্ত। এ রীতির চিত্রে বিভিন্ন দেব-দেবী ও পৌরাণিক বিশ্বাস প্রাধান্য পায়। এ শিল্প রীতিতে প্রথমে একটি মাধ্যমের উপর স্কেচ করা হয়। জিঙ্ক অক্সাইড এবং এরাবিক গাম দিয়ে পেস্ট (গ্যাসো পেস্ট) বানিয়ে সুক্ষ ব্রাশ দিয়ে ধাতব দ্রব্য সাঝিয়ে জলরং দিয়ে গড়ে তোলা হয় চিত্র।
জ) তাঞ্জোর চিত্রকলাঃ ৯ম শতকে চোলা শাসকদের মাধ্যমে তামিল নাড়ুর তাঞ্জোরে এ রীতির যাত্রা শুরু। মহীশুরের মতোই এতে থাকে চারুতা, উজ্জ্বলতা ও প্রকাশ ভঙ্গি। দেব-দেবী ও পৌরাণিক বিশ্বাস মুল বৈশিস্ট।
তাঞ্জোর পেইন্টিং
টিপু সুলতানের আমলে করা মহীশুর রীতির চিত্র
ঝ) পট্ট চিত্রঃ পট্ট বা কাপড়ের উপর চিত্র ওরিশ্যা তথা পুর্ব-ভারতের বিশেষত্ব। ৬ম শতকে খান্দাগীরি, উদয়গীরি এবং সীতাভিঞ্জির গুহার ম্যুরালে কিছু পেইন্টিং আবিস্কৃত হয়, যেখানে চিত্রকররা কাপড়ের উপর চোখ ধাঁধানো চিত্রকর্ম করেছিলেন। বৈষ্ণব থিমে গড়া চিত্রে জগন্নাথ দেব ও রাঁধা-শ্রীকৃষ্ণ, বল্ভদ্র, সুভদ্রা, গীত গোবিন্দের বিষ্ণু, রামায়ন ও মহাভারত ছিল প্রধান চরিত্র। ওই সময় চিত্রকররা নিজেরাই খনিজ এবং ভেষজ ব্যবহার করে রং প্রস্থুত করতেন। যেমন শঙ্খের খোলসের পাউডার জ্বাল দিয়ে সাদা রং, হিঙ্গুলা নামে লাল খনিজ রং, হরিতলা পাথর দিয়ে হলুদ রং, রামরাজা থেকে নীল রং, পোড়ানো নারকেল থেকে কালো রং ইত্যাদি। গৃহপালিত পশুর চুল এবং পাখির পাখনা থেকে তাঁরা তৈরী করতেন তুলি। গুলারের কাংড়া চিত্রকলা, মিথিলায় মাধুবানি চিত্রকলা, ওডিসার “পট্টচিত্র” ভারতের নিজস্ব চিত্রকলার অনন্য দৃষ্টান্ত।
পট্টচিত্রে “গীত গোবিন্দ”
ঞ) ভারতীয় কিছু নামকরা চিত্রকর্মঃ 1. Lady with the Lamp – হেমেন মজুমদার; ২। চারুলতা সিরিজ- সুদীপ রায়; ৩। আত্ম-প্রতিকৃতি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; ৪। ভারত মাতা- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর; ৫। শকুন্তলা- রাজা রবি ভার্মা; ৬। হর্স সিরিজ- মকবুল হুসেন ফিদা; ৭। যিশু খ্রিষ্ট- যামিনি রায়; ৮। বাঙলার দুর্ভিক্ষ- জয়নাল আবেদিন।
ট) Fresco is a technique of mural painting executed upon freshly-laid, or wet lime plaster. Water is used as the vehicle for the pigment to merge with the plaster, and with the setting of the plaster, the painting becomes an integral part of the wall.
ঠ) Avant-garde or "vanguard" are people or works that are experimental, radical, or unorthodox with respect to art, culture, or society. It may be characterized by non traditional, aesthetic innovation and initial unacceptability, and it may offer a critique of the relationship between producer and consumer.
ড) অজন্তা গুহাঃ মহারাস্ট্রের আওরংগবাদ জেলায় অবস্থিত পাথর কেটে ২৯টি বুদ্ধ মুর্তি তৈয়ার করা হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে ৪৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এর কাজ চলে। অজন্তা গুহার কাজগুলোকে মনে করা হয় ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের অন্যতম সেরা পাথর কাটা ভাস্কর্য এবং রং’এর কাজ।
ম্যুরাল পেইন্টিং: অজন্তা গুহা চিত্র
ঢ) ইলোরা গুহাঃ মহারাস্ট্রে অবস্থিত এটিকে বলা হয় বিশ্বের বৃহত্তম পাথর খোদাই নির্মিত আশ্রম/ মন্দির। ৬০০-১০০০ খ্রিস্টাব্দে তা নির্মিত। এখানে বৌদ্ধ-হিন্দু-জৈন আরাধনা স্তম্ভ একসাথে আছে। এর ১৬ নম্বর গুহাকে বলে হয় বিশ্বের বৃহত্তম একশিলা বিশিষ্ট পাথরের কাজ। এর ভিতর অবস্থিত কৈলাশ মন্দির শিবের প্রার্থনার জন্য ব্যবহৃত হয়।ইলোরার মোট ১০০ টি গুহার মাত্র ৩৪ টি ব্যবহার করা যায়। এর ১২ টি বৌদ্ধদের, ১৭ টি হিন্দুদের এবং ৫টি জৈনদের। (লিখনঃ ১৩ মার্চ, ২০১৮, গণ-অরণ্য, গুএলফ, কানাডা)।
ইলোরা গুহা স্থাপত্য ; ডানে কৈলাশ মন্দির (ইলোরা)
ণ) বাঙলার চারুকলাঃ বাঙলা চারুকলা বিদ্যালয় প্রচলিত একাডেমিক চিত্ররীতির বিপক্ষে ইউরোপের এভান্ত গার্ড এবং জাতীয় আন্দোলনের স্বপক্ষে ভূমিকা রেখেছিল। ভারতের আধ্যাত্মিকত চিত্ররীতি পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ধারা থেকে ভিন্ন ছিল। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ভারত মাতা” নামে বিখ্যাত চিত্রকর্মে হিন্দু দেবীর আদলে চার হাত যুক্ত রমনীকে মনে করা হয়েছে ভারতের জাতীয় প্রেরনার উৎস। শিল্পীদের প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলনের আকাংখার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন নন্দলাল বসু, মুকুল দে, কালীপদ ঘোষাল, বিনোদ মুখার্জী সহ অনেকেই। আদি ভারতীয় শিল্পীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঐতিহ্য ছিল না। চারুকলা ছিল বংশানুক্রমিক কৌলিক শিক্ষার অংশ। প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা প্রবর্তনের মাধ্যমে ভারতীয় চিত্র বৈশিষ্ট্যগত পালাবদলের সূচনা করে। এভাবে বাংলার চারুকলার ইতিহাসে প্রাচীন ও মধ্যযুগের অবসান হয়ে আধুনিকতার সূত্রপাত হয়। বাকুড়ায় আবিরলাল প্রতিষ্ঠিত The Rednova Art Academy আধুনিক চিত্রকলা বিকাশে ভূমিকা রাখছে।
ত) পদ্মা-মেঘনার উত্থানঃ দেশ বিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে সৃজনশীল শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ, কামরুল হাসান ও শেখ মোহাম্মদ সুলতান চারুকলা প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা সুচনা করেন। চল্লিশের দশকের শিল্পীদের সাধারণ ঐক্যসূত্রটি ছিল স্বদেশ, প্রকৃতি ও জনজীবন। আমি আমার পরবর্তী পর্বে বাংলাদেশের চারুকলার কথা তুলে ধরবো।
ছবি কৃতজ্ঞতা- লেখক এবং আন্তর্জাল
-শিবব্রত নন্দী দুলাল
গুয়েলফ, কানাডা।
shibanandi@gmail.com
-
নিবন্ধ // মতামত
-
06-06-2018
-
-