জনকের জন্মগ্রাম যাত্রা - মিঠুন চৌধুরী
ধানমন্ডি ৩২ থেকে টুঙ্গিপাড়া। হ্যাঁ, যাত্রাটা এরকমই। তারও আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জানার আগ্রহের সূত্রপাত কৈশোরে। ‘মুজিবের রক্ত লাল’- এম আর আখতার মুকুল রচিত ইতিহাসের সত্য সন্ধানী রচনাটি যখন হাতে আসে, এর পর থেকে। আমরা যারা বড় হয়েছি ‘বাপের বেটা এরশাদ’র কালে, তাদের অধিকাংশের কাছেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পূর্বাপর কোনো ইতিহাসই তখনো পৌঁছেনি। চরমপত্র খ্যাত এম আর আকতার মুকুলের হাত ধরে পথচলা শুরু বিস্ময়ে ভরা এক অজানা জগতে।
দৈনিক পত্রিকার ক্রোড়পত্র ও সাময়িকীতে মাঝে মাঝে দুয়েকটা লেখা প্রকাশিত হতো। তাতে কেউ কেউ মুজিবরের কথা লিখতেন। কিন্তু যে শিশু-কিশোররা দেশের জন্মের ইতিহাস জানে না তাদের পক্ষে কাগজের কলাম পড়ে ইতিহাসের সত্যাসত্য নির্ণয় দু:সাধ্য। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে হাতে আসে ‘অপাঠ্য’ বই, যার একটি ওই ‘মুজিবের রক্ত লাল’। এরমধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতায় পালাবদল ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি যখন দেশ পরিচালনায় তখন গুপ্তধনের মত একেকটি রচনা, ভিডিও চিত্র এবং বই আলোর মুখ দেখতে শুরু করলো।
আমরা জানতে শুরু করলাম- ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ছাত্র আন্দোলন, অসহযোগ, ১১ দফা, ছয় দফা, সত্তরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। তখনো খবরের কাগজে আর আলোচনার আবরণে পুরোদমে চলছে নানা কূট তর্ক। যেমন- স্বাধীনতার ঘোষক কে? শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন, তিনি স্বাধীনতা চাননি। জিয়াউর রহমানের ঘোষণার পরই প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু কেন ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন? প্রচারণা এতটা মিথ্যের মিথে ঢাকা ছিল যে, ‘বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ যুদ্ধে যায়নি’- এই মিথ্যেও অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। একাত্তর থেকে পঁচাত্তরের আগস্ট পযর্ন্ত সময়ের নানা ঘটনাকে মিথ্যের আবরণে উপস্থাপন করা চলতেই থাকে। এমনকি মিথ্যে প্রচার আর ভয়ের সীমানার আড়ালে ঢাকা পড়ে বাঙালির মুক্তির স্লোগান ‘জয় বাংলা’, অভিহিত হয় শুধু আওয়ামী লীগের স্লোগান বলে।
নতুন সহস্রাব্দের প্রথম বছরে কোন এক বিষন্ন বিকেলে ধুরু ধুরু বুকে গিয়ে দাঁড়াই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সামনে। শুরুতে ওই বাড়িতে ঢোকার সাহস সঞ্চয় করতে পারছিলাম না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আতুর ঘর যে বাড়ি, যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাংলার মহানায়ক দেখতেন তাঁর ‘বাংলার মানুষকে’, যে বাড়িতে স্বপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে- সে বাড়িতে প্রবেশের সাহস সঞ্চয় করা কঠিনই বটে। তবু প্রবেশ করলাম ইতিহাসের সে বাতিঘরে।
যেমনটা ভেবেছিলাম তেমন কিছুই নয়। মনে করেছিলাম বাংলার অবিসংবাদিত নেতা প্রধানমন্ত্রীর বিশাল জাকজমকে ভরা একটা বাড়ি দেখব। অথচ ধানমন্ডির সে বাড়িটি ছিমছাম আর দশটা পুরনো বাড়ির মত। আশেপাশে সব অট্টালিকা সম। তার মাঝে সবুজে ঘেরা একখন্ড বাংলাদেশ যেন। ঘুরে ঘুরে দেখি- বঙ্গবন্ধুর বাড়ি।
সেই টেলিফোন, উত্তাল রেসকোর্সের ছবি। রিডিং রুম। দোতলার ঘর। ছোট্ট খাবার টেবিল। অতি স্বাভাবিক আকারের আসবাব। সেই বিখ্যাত পাইপ। দেয়ালে সারি সারি ছবি। দেয়ালে বুলেটের দাগ। বিশ্বাসঘাতকদের নাম যে দেয়ালে লেখা কলঙ্কের কালিতে। তিনতলায় ওঠার সিঁড়িটা দেখে মনে হয় কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হয়ত এই সিঁড়ি বেয়ে উঠতেন একাকী। কেমন ছিল ঘরভরা মানুষের সেই ৩২ নম্বর? কতটা আয়েশে বঙ্গবন্ধু পাইপ হাতে চেয়ারে পা তুলে বসে মুচকি হাসতেন। সেই সব ভেবে ভেবে দেখি কাঁচ ঘেরা সেই সিঁড়ি। মাত্র তো কয়েকটা ধাপ। জনকের বুকে রক্ত গোলাপ, কালো কোটে লাল সূর্য, মুখে কেমন বেদনা লেপটে আছে।
‘‘তোমার নিষ্প্রাণ দেহখানি সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে,
গড়াতে, গড়াতে
আমাদের পায়ের তলায় এসে হুমড়ি খেয়ে থামলো।
– কিন্তু তোমার রক্তস্রোত থামলো না।
সিঁড়ি ডিঙিয়ে, বারান্দার মেঝে গড়িয়ে সেই রক্ত,
সেই লাল টকটকে রক্ত বাংলার দূর্বা ছোঁয়ার আগেই
আমাদের কর্ণেল সৈন্যদের ফিরে যাবার বাঁশি বাজালেন।”
সেই রাত্রির কল্প কাহিনী, নির্মলেন্দু গুণ
ফিরে ফিরে যাই সে বাড়িতে। যখনই রাজধানীতে যাওয়ার সুযোগ হয়, তখনই একবার যাওয়ার চেষ্টা করি। যতবার দেখি ততবার টানে। পেছনের বারান্দায় কপোতের ওড়াওড়ি খুঁজি। জন্মেরও বহু আগের মার্চ খুঁজি। শেখ রাসেলের দুষ্টুমি ভরা হাসি যেন কোনো এক আড়াল থেকে উঁকি দেয়। নির্মলেন্দু গুণের কবিতা প্রতিধ্বণিত হতে থাকে মনের গহীনে।
ইচ্ছে হয় জনকের জন্মগ্রাম দেখব। সুযোগ হয়ে ওঠে না। ২০১৬, অবশেষে আসে সেই সুবর্ণ সুযোগ। চট্টগ্রামের জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ মাঠে ১৪ অগাস্ট বিকেলে জড়ো হন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের আয়োজনে টুঙ্গিপাড়ায় শোক দিবসের মেজবান অনুষ্ঠিত হয় ফি বছর। সংবাদকর্মী হিসেবে আমন্ত্রণ মেলে। মুক্তিযোদ্ধা চট্টলবীর খ্যাত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী সেই মেজবানের আয়োজক। বাসে চড়ে বসি আওয়ামী লীগের কর্মীদের সাথে। সে যাত্রায় অনুপ্রেরণা দিয়ে সঙ্গী হয়েছিলেন গণজাগরণ মঞ্চ চট্টগ্রামের প্রাণপুরুষ অগ্রজ শরীফ চৌহান। রাজনৈতিক আলোচনা আর নেতাদের মুখে টুঙ্গিপাড়ার অতীত স্মৃতি শুনে শুনে চলে যাত্রা।
মাঝরাতে ফেরিতে ওঠে গাড়ির বহর। প্রমত্তা পদ্মা। ঝির ঝির বৃষ্টিও হচ্ছে। ঢাকা থেকে গাড়ি নিয়ে এসে ফেরিতে বহরের সাথে যোগ দেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর বড় ছেলে ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। ফেরির সামনের দিকে মহিউদ্দিন চৌধুরীর গাড়ি। তিনি দরজা খুলে বসে আছেন। পুত্র গিয়ে ওঠেন বাবার গাড়িতে। ফেরি চলতে শুরু করে। অন্যদের মত আমরাও হাঁটাহাঁটি করি, সামনে এগোই। গাড়ির সামনে যেতেই অন্ধকারে ঠাহর করার ভঙ্গিতে তাকান মহিউদ্দিন চৌধুরী। বলেন- অনারা আইস্যুন না, অ কাঅ । থাকন থাকন, কালিয়া বালা গরি খাইয়ুন। (আপনারা এসেছেন, কাকা। থাকুন থাকুন, কাল ভালো করে খাবেন।)
ভোর হতে হতে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পৌঁছাই টুঙ্গিপাড়া। ছিমছাম বাংলার গ্রাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলেজ মাঠে তখন সামিয়ানা টাঙানো হয়ে গেছে। চেয়ার-টেবিল পাতা আছে। স্বেচ্ছাসেবকরা আসতে শুরু করেছেন। মাথায় লাল টুপি পড়া ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা গোল হয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। কলেজের মূল ফটক ধরে সোজা এগিয়ে গিয়ে যেখানটায় পাকা রাস্তা ডান দিকে বেঁকে গেছে সেখানে চেয়ার পেতে বসে পড়লেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। এখানে বসেই সব তদারক করবেন তিনি। কলেজের পুকুরে ডুব দিয়ে পেট ভরে খেয়ে মাঠে ঘুরে ফিরে দেখি। কলেজের মসজিদে গামছা পেতে একটু বিশ্রাম নিই।
‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সমাধি’ দেখব বলে বেরিয়ে পড়ি। সঙ্গী হন এক ও অদ্বিতীয় শরীফ চৌহান। টুকটুকে চড়ে সবুজ ঘাসের মাঠ, ছোট ছোট পুকুর, পাটের ক্ষেত, বয়সী বট পেরিয়ে এগিয়ে যাই। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সমাধি ক্ষেত্রের বিশাল ফটক। কিন্তু এখন তো ভেতরে যাওয়া যাবে না। রাষ্ট্রীয় আয়োজন তখনো শুরু হতে বাকি। তাই রিকশা ভ্যানে চড়ে আশেপাশে ঘুরি। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ চারপাশে। শিশুরা ছোটছুটি করে। ভ্যানের চালক অমলিন হেসে জানতে চায় কোথা থেকে এসেছি আমরা। আবার ফিরে আসি। বাজার ঘুরে দেখি। মানুষের আড্ডায় কান পাতি। দৈনন্দিনের আলোচনায় মাঝে ভেসে আসে মুক্তিযুদ্ধের কথা। তাদের ‘খোকা’কে নিয়ে গৌরবের নানা গল্প।
টুঙ্গিপাড়ার আকাশে কপ্টারের আওয়াজ। মুজিব কন্যা আসেন পিতার মাজারে। মাইকে ঘোষণা ভেসে আসে। মাজার জিয়ারত করেন প্রধানমন্ত্রী। আবার ফিরেও যান। সাধারণের জন্য খুলে যায় সমাধির দুয়ার। মানুষ বাড়তে থাকে। আমরা যাই কলেজের মাঠের দিকে। খাবার পরিবেশন শুরু হয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষেরা মেজবান খেয়ে প্রাণ ভরে দোয়া করতে করতে বাড়ির পথ ধরেন। বেলা একটু পড়ে এলে আমরা আবার রওনা হই সমাধির পথে। এবার প্রবেশের দ্বার অবারিত। মূল ফটকে পৌঁছে সবার যেন দ্রুত দৌড়ে যেতে ইচ্ছে করে। আমরা একটু পিছিয়ে পড়ি। ধীরে চারপাশে তাকাই। পুকুর পাড়, ফলের গাছ, গাছের ছায়া- যে গাছের তলায় হয়তো কখনো দাঁড়িয়েছিলেন শেখ মুজিব; সেসব দেখতে দেখতে যাই। কে একজন বললেন, দেয়ালের ওপারে টিনের চালা দেয়া বাড়িটিই জনকের জন্মভিটা। দেখি, ছোট্ট সে ঘর কি বিশাল এক মানুষকে ধারণ করেছিল।
সমাধিতে সবাই চুপচাপ। কালো গ্রানাইট যেন সব শোক বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুকে তার জলের ছায়া। আলো আসে, সব অলিন্দ বেয়ে আলো আসে। আলো ছিটকে পড়ে কালো পাথরের উজ্বল বুকে। যেখানে সব কথা নিরবতা হয়ে যায়। সব মুখ মৌন। সব ভাষা খুঁজে ফেরে শুধু একটি নাম- সেই নাম জনকের….
“যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ অশ্রুমাল রক্তগঙ্গা বহমান
তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।” – অন্নদাশঙ্কর রায়
জনকের জন্মগ্রামের মাটি ছুঁয়ে ফেরার পথ ধরি। বাস ছুটে চলে শ্যামল বাংলার পথ ধরে। দু’ধারে পাটের ক্ষেত। শালিকেরা উড়ি যায়। সন্ধ্যে নামার মুখে সোনালী আলোয় যেন ভরে উঠে চারপাশ। বেজে ওঠে সেই গান-
‘জয় বাংলা’ বলতে মনরে আমার এখনো কেন ভাবো,
আমার হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাবো,
অন্ধকারে পুবাকাশে উঠবে আবার দিনমণি।।
শোনো একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।। -শোনো একটি মুজিবরের থেকে, গৌরি প্রসন্ন মজুমদার
মিঠুন চৌধুরী
সংবাদকর্মী, চট্টগ্রাম
১৪ অগাস্ট, ২০১৮
-
নিবন্ধ // মতামত
-
15-08-2018
-
-