অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ করতে হবে - মো.ওসমান গনি

শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতির শিখরে আরোহন করতে পারে না। তাই বলা হয়েছে, পৃথিবীতে যে জাতি যত শিক্ষিত-সে জাতি তত উন্নত। তাই আমাদের সরকার দেশে শতভাগ শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কিছু পদ্ধতি চালু করেছে। এর ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন ও এসেছে। উপবৃত্তি, বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ ও স্কুল ফিডিং এর মতো বড় কর্মসূচি চালুর ফলে প্রাথমিক স্তরে শিশুদের অংশগ্রহণ প্রায় শতভাগ। এ স্তরে শিশুদের পঞ্চম শ্রেণি শেষ করার হারও মোটামুটি ভালো। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় এদের মাধ্যমিক স্তরে ধরে রাখা যাচ্ছে না। সরকারের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার ৪০ শতাংশের মতো। এর মধ্যে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার আরও বেশি।  

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রদের চেয়ে বেশি ভর্তি হয় ছাত্রীরা। এদের ঝরে পড়ার হারও বেশি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া ৪০ দশমিক ১৯ শতাংশ ছাত্রী ঝরে পড়ছে দশম শ্রেণি শেষ করার আগেই। ঝরে পড়ার এই হারকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্নিষ্টরা।   

এ স্তরে ঝরে পড়ার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে শিক্ষাবিদরা বলছেন, এর মধ্যে দারিদ্র্য ও মেয়েদের বাল্যবিয়ে অন্যতম। এর বাইরে দুর্বোধ্য সৃজনশীল পদ্ধতির কারণে শিক্ষার্থীরা তাল মেলাতে পারছে না। এতে অনেকে পড়ালেখা ছেড়ে দিচ্ছে। ছাত্রদের ক্ষেত্রে অতি দারিদ্র্য আর ছাত্রীদের ক্ষেত্রে ‘বাল্যবিবাহ’ প্রধান বাধা। এসব বিষয়ে নজর দেওয়ার এখনই সময় বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।     

মাধ্যমিকে গত ছয় বছরে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমেছে সাড়ে পাঁচ শতাংশ। যাকে সামান্য অগ্রগতি বলে শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে মেয়ে শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার হার ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ কমেছে।  যাকে মোটামুটি পরিবর্তন বলে দাবি করছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্নিষ্টরা।  বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) শিক্ষা তথ্য প্রতিবেদনের খসড়ায় এ তথ্য উঠে এসেছে। 

মাধ্যমিকে ছেলে-মেয়ে মোট শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার গড় হার ৩৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। এর মধ্যে ছাত্রদের ঝরে পড়ার হার ৩৬ দশমিক ০১ শতাংশ আর ছাত্রীদের ৪১ দশমিক ১৯ শতাংশ। গত বছর মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ৩৭ দশমিক ৮১ শতাংশ। সে হিসেবে সম্মিলিতভাবে এবার ঝরে পড়ার হার শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে গতবারের চেয়ে এবার ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেড়েছে। 

প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাধ্যমিক স্তরে ২০০৮ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ৬১ দশমিক ৩৮ শতাংশ, ২০০৯ সালে ৫৫ দশমিক ৩১ শতাংশ, ২০১০ সালে ৫৫ দশমিক ২৬ শতাংশ, ২০১১ সালে ৫৩ দশমিক ২৮ শতাংশ, ২০১২ সালে ৪৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৪৩ দশমিক ১৮ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৪১ দশমিক ৫৯ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৪০ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ৩৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। সে হিসেবে গত ছয় বছরে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমেছে সাড়ে পাঁচ শতাংশ। আর গতবার থেকে এবার মাত্র ঝরে পড়ার হার শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ কমেছে।      

মাধ্যমিকে ৬২ দশমিক ৩৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রী শিক্ষাস্তর শেষ করছে। এদের মধ্যে ছাত্র ৬৩ দশমিক ৯৯ আর ছাত্রীরা ৫৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। তবে মাধ্যমিক পেরিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পৌঁছালে শিক্ষার্থীর এই হার কমে আসে। উচ্চ মাধ্যমিকে ১৯ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০০৮ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ৪৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ, ২০০৯ সালে ৪২ দশমিক ১১, ২০১০ সালে ৩৭ দশমিক ৩৬। ২০১১ সালে ৩৭ দশমিক ১৩, ২০১২ সালে ২১ দশমিক ৮০, ২০১৩ সালে ২১ দশমিক ৬০, ২০১৪ সালে ২১ দশমিক ৩৭, ২০১৫ সালে ২২ দশমিক ৭০, ২০১৬ সালে ২০ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং ২০১৭ সালে ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ।  

প্রাথমিকে মেয়ে শিশুদের ভর্তির হার ছেলেদের তুলনায় বেশি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে একই অবস্থা বিদ্যমান থাকে। কিন্তু মাধ্যমিকের পাবলিক পরীক্ষা পর্যন্ত এরা আর টিকে থাকতে পারে না। এর একটা বড় কারণ মেয়েদের বাল্যবিয়ে। আবার মেয়েরা বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছলে অনেক পরিবারই নিরাপত্তার কারণে আর স্কুলে পাঠায় না। আর আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে টয়লেট ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ। ফলে সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে গিয়ে মেয়েদের সংখ্যা কমতে থাকে। ছেলেদের ক্ষেত্রে পরিবারের অনীহা অন্যতম কারণ। স্কুলে না গিয়ে জমিতে কাজ করলে পরিবারের আর্থিক সহায়তা হয়, তা ভেবেই অনেক ছেলে স্কুল বাদ দেয়। এ ছাড়া শিক্ষাব্যয় নির্বাহ করতে না পেরেও অনেক পরিবার সন্তানের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এটি হচ্ছে দারিদ্র্যের কারণে।         

২০৩০ সালের মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা তুলে ধরে এতে বলা হয়, ২০২০ সালের মধ্যে মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার কমিয়ে ৩৩ দশমিক ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে, ২০২৫ সালে ২৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ আর ২০৩০ সালের মধ্যে ঝরে পড়ার হার ২০ দশমিক ১৭  শতাংশে নামিয়ে আনা হবে।     

অন্যদিকে উচ্চ মাধ্যমিকেও হার কমানোর পরিকল্পনা তুলে ধরে বলা হয়, ২০২০ সালের মধ্যে ঝরে পড়ার হার উচ্চ মাধ্যমিকে ১৯ দশমিক ৩২ শতাংশ কমিয়ে আনা হবে। আর ২০২৫  সালে ১৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ২০২৬ সালে ১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ঝরে পড়ার হার কমিয়ে ১৭ দশমিক ৪২ শতাংশে আনা হবে। 

এদিকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমাতে সরকার প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন স্তরে দেওয়া হচ্ছে মেধাবৃত্তিও। শিক্ষাক্ষেত্রে গত দশ বছরে অনেক উন্নতি ও অগ্রগতি হয়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা ক্রমান্বয়ে ভাল করছে। শিক্ষা বিষয়ক তথ্য সঠিকভাবে সন্নিবেশ, তথ্যের বিশ্লেষণ এবং সঠিক কাজে লাগানোর মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব হবে।  নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তথ্যকে কাজে লাগানো সম্ভব হবে।    

শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য শুধু পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান অর্জন নয়, নৈতিকতা, আদর্শসহ পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, জীবন-যাপন পদ্ধতি নিয়ে হীনমন্যতার কোন কারন নেই। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থারও সুদীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। মানসম্মত শিক্ষার জন্য মানসম্মত শিক্ষক প্রয়োজন। শিক্ষার উন্নয়নে সঠিকভাবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। 

মো.ওসমান গনি
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
কুমিল্লা, বাংলাদেশ। 

Email-ganipress@yahoo.com