অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
ভাষা আন্দোলনে সিলেট - অপূর্ব শর্মা

ভাষা আন্দোলনে সিলেটের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সূচিত আন্দোলনের সূচনাপর্ব থেকেই সোচ্চার ছিলেন এই অঞ্চলের মানুষ। বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন দৃঢ়প্রত্যয়ী। বাংলা না উর্দু, কী হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, এ-নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলে বাংলার পক্ষে নিজেদের অবস্থানের কথা জানান দিতে সিলেটের বুদ্ধিজীবীরা সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে আয়োজন করেন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক আলোচনা সভা। ১৯৪৭ সালের ৯ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সভা থেকে মাতৃভাষা বাংলার প্রাধান্য কমানো হলে জেহাদ ঘোষণার হুমকি দেওয়া হয়। ৩০ নভেম্বর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আরও একটি সভা কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়।১ এই সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মতিনউদ-দীন আহমদ। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বহুভাষাবিদ, পণ্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলী। সভার আলোচ্য বিষয় ছিলো :‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু হওয়া উচিৎ’। তবে, সেই সমাবেশ স¤পন্ন করা যায়নি। সমাবেশকে সামনে রেখে মুসলিম লীগ শহরে নানা অপপ্রচার চালায়। পকিস্তান রক্ষার জন্য উর্দুর পক্ষে অবস্থান নিতে সভায় যোগ দিতে হবে-এমন প্রপাগান্ডাও চালানো হয়। মুসলিম লীগের এধরনের প্রচারণায় তাদের অনুগতরা ৩০ নভেম্বর সমাবেশে যোগদান করে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে। মুসলিম লীগের ক্যাডারদের আক্রমনে সভা প- হয়ে যায়। এ কারণে মুজতবা আলী তাঁর বক্তব্য সমাপ্ত করতে পারেন নি। বক্তব্য অসমাপ্ত রেখেই তিনি সভাস্থল ত্যাগ করেন। তবে, ভাষণের পুরোটা লিখে তা প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দেন মুজতবা আলী। কথা অনুযায়ী কলকাতার ত্রৈমাসিক পত্রিকা চতুরঙ্গ এবং সিলেটের মাসিক আল-ইসলাহ পত্রিকায় এ-সংক্রান্ত তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়, যা পরে চট্টগ্রাম থেকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা শিরোনামে বই আকারে বের হয়েছিল। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে পাক সরকারের রোষানলে পড়ে সেই সময় দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন মুজতবা আলী।২ 

উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে সারা দেশের ন্যায় সিলেটেও প্রচারণা চালায় মুসলিম লীগের কর্মী-সমর্থকরা। তাদের এমন তৎপরতার বিপরীতে সোচ্চার ছিলেন সিলেটিরা। নিজেদের দাবি বাস্তবায়নে নানামুুখী তৎপরতা চালান এই অঞ্চলের নেতৃস্থানীয়রা। ১৯৪৮ সালের ১১ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকারের যানবাহন ও যোগাযোগমন্ত্রী আবদুর রব নিশতার সিলেটে এলে আবদুস সামাদের নেতৃত্বে ছাত্র নেতৃবৃন্দ তার সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পাশাপাশি শিক্ষার মাধ্যম এবং অফিস আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহার নিশ্চিত করার দাবি জানান। ওই দিন জোবেদা খাতুন চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি মহিলা প্রতিনিধি দলও মন্ত্রীর সাথে দেখা করে একই দাবি উত্থাপন করেন। 
এদিকে, ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজির পাশাপাশি পরিষদে বাংলায় বক্তব্য রাখার প্রস্তাব করলে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন তার ঘোর বিরোধিতা করেন। মুখ্যমন্ত্রীর এমন বিরোধিতার প্রতিবাদে ঢাকার ছাত্রÑজনতা আন্দোলনে নামে। সিলেটেও এর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। এখানকার একদল বিশিষ্ট মহিলা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি পেশ করেন। সেই স্মারকলিপিতে যারা স্বাক্ষর করেছিলেন তারা হচ্ছেন সিলেট জেলা মহিলা মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট জোবেদা রহিম চৌধুরী, ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দা শাহার বানু, সেক্রেটারি সৈয়দা লুৎফুন্নেছা খাতুন, সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী রাবেয়া খাতুন প্রমুখ।
এদিকে, ২৬ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট এবং ১১ মার্চ সারাদেশে ধর্মঘট কর্মসূচি আহ্বান করা হলে সিলেটের ছাত্রÑজনতা এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। প্রাক্প্রস্তুতি হিসেবে শুরু হয় প্রচার অভিযান। কর্মসূচিকে সামনে রেখে শহরের গোবিন্দচরণ পার্কে (বর্তমান হাসান মার্কেট এলাকায়) ৮ মার্চ আহ্বান করা হয় জনসভা। তমদ্দুন মজলিশ ও মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের উদ্যোগে আয়োজিত এই সভার সভাপতি ছিলেন মাহমুদ আলী। সভা শুরুর কিছুক্ষণ পরই মুসলিম লীগের ক্যাডাররা এসে হামলা চালায়। তারা মঞ্চ দখল করে নেয়। তাদের হামলায় গুরুতর আহত হন মকসুদ আহমদ। সভাস্থলের পাশে পুলিশের অবস্থান থাকলেও তারা ছিলো নির্বিকার। এ ঘটনার প্রতিবাদে সিলেটের মুসলিম মহিলা লীগ ১০ মার্চ প্রতিবাদ সভা আহ্বান করে। কিন্তু প্রশাসন ২ মাসের জন্য সিলেট শহরে ১৪৪ ধারা জারি করার কারণে সেই সভা করতে পারেনি তারা। নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে প্রকাশ্যে সভা সমাবেশ থেকে বিরত থাকতে হয় আন্দোলনকারীদের। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকা। সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পত্রিকাটিতে একের পর এক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হতে বাংলা ভাষার পক্ষে। 

১৯৪৮ সালের পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বস্তুত গতিহীন হয়ে পড়ে। তবে, নওবেলাল দাবির পক্ষে অনঢ় থাকে। কেটে যায় চার বছর। ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ঢাকা সফরে এসে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে আন্দোলনে নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ৩১ জানুয়ারি গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি।৩ শুরু হয় দুর্বার আন্দোলন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকায় বের হয় ছাত্রদের মিছিল। মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার শহিদ হন। এ খবর সিলেটে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে রাজপথে শোকার্ত মানুষের ঢল নামে। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠে সিলেটবাসী। সিলেট রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয় নানান কর্মসূচি। ২২ ফেব্রুয়ারি সিলেটে হরতাল আহ্বান করা হয়। ‘ভাষা আন্দোলনে সিলেট’ প্রবন্ধে তাজুল মোহাম্মদের ভাষ্যে ফুটে উঠেছে সেদিনের চিত্র। তিনি লিখেছেন :
‘১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সিলেট সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ ধারণ করে। সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, অফিস-আদালত কর্মচারি শূন্য, রাস্তায় কোনো যানবাহন নেই; স্কুল কলেজে পূর্ণ ধর্মঘট। মিছিলের পর মিছিল বের হচ্ছে। সম্পূর্ণ শহর শোকে মোহ্যমান এবং প্রতিবাদমুখর। মুসলিম লীগ সরকারের এই জুলুমের প্রতিবাদে সমগ্র সিলেটবাসীই সোচ্চার। মুসলিম লীগের ভেতরেও এর প্রতিক্রিয়া কম হয়নি। সিলেটের জননন্দিত মুসলিম লীগ নেতা মাহমুদ আলী,  সরেকওম এ জেড আবদুল্লাহ ও আবদুর রহিম (লাল বারী) এবং মতসির আলী (কালা মিয়া) দল থেকে পদত্যাগ করেন। 

২২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০ টায় আবার বসে সংগ্রাম কমিটি। গৃহীত হয় পরবর্তী কর্মসূচি। বিকেল ৩ টায় গোবিন্দচরণ পার্কে অনুষ্ঠিত হয় জনসভা। জেলা বার এসোসিয়েশন সভাপতি মোহাম্মদ আবদুল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি করে পরের দিনও হরতাল আহ্বান করা হয়। সভা শেষে একটি প্রতিনিধি দল স্থানীয় এমএলএ ও মুসলিম লীগ সরকারের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি দেওয়ান তৈমুর রাজা চৌধুরীর বাড়িতে গিয়ে তাঁর পদত্যাগ দাবি করে। আর একটি দীর্ঘ মিছিল রাত ৮ টা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন রাস্তা ও পাড়ামহল্লা প্রদক্ষিণ করে। ঐ দিনই পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে যায় শহর। সমানভাবে চলছে মাইকিং। সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচি মাইকে প্রচার করা হচ্ছে অবিরত। গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় হযরত শাহজালালের মাজার প্রাঙ্গনে। তারপর সেখান  থেকে বের হয় এক বিশাল গণমিছিল। কারো কারো মতে সাতচল্লিশের গণভোটের পর এত বড় মিছিল আর দেখেনি কেউ সিলেটে।’৪  

সিলেটে এরপর থেকে প্রতিদিনই সভাÑসমাবেশ অনুষ্ঠিত হতো রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে। প্রায় মাসাধিক কাল ধারাবাহিকভাবে নানা কর্মসূচি পালন করেছেন সিলেটবাসী। ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে শুধু শহরেই নয়, গ্রামে গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলনের বহ্নিশিখা। সিলেটে যাদের নেতৃত্বে বেগবান হয়েছিল মায়ের ভাষা রক্ষার আন্দোলন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন আবদুল আজিজ, আসাদ্দর আলী, আবুল মাল আবদুল মুহিত, আবু জাফর আবদুল্লাহ, আবদুর রহিম, আবুল বশর, আবদুল মজিদ, আবদুস সামাদ আজাদ, আবু নছর মনির বখত মজুমদার, আখলাকুর রহমান, আবদুল হক, আবদুল হাই, আবদুল হামিদ, আবদুল মালিক, আবুল হাসনাত সাদত খান, উবেদ জায়গীরদার, এনামুল হক, ওয়ারিছ আলী, খন্দকার রুহুল কুদ্দুস, জালাল উদ্দিন আহমেদ খান, তারা মিয়া, তসদ্দুক আহমদ, দেওয়ান আহমদ কবির চৌধুরী, দেওয়ান ফরিদ গাজী, কবি দিলওয়ার, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, দবির উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, নাইয়ার উদ্দিন আহমদ, নূরুল ইসলাম, নূরুল হক, নূরুর রহমান, নির্মল চৌধুরী, পীর হাবিবুর রহমান, প্রসূনকান্তি রায়, ফখরুদ দওলা, ফারুক আহমদ চৌধুরী, বাহাউদ্দিন আহমদ, মকসুদ আহমদ, মতছির আলী, মতিনউদ্দিন আহমদ, মনিরউদ্দিন আহমদ, মনির উদ্দিন, মহিবুর রহমান, মাহমুদ আলী, মুসলিম চৌধুরী, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, জোবেদা খাতুন চৌধুরী, রিয়াছদ আলী, রাবেয়া খাতুন, রাবেয়া আলী, লুৎফুন্নেছা খাতুন, লিয়াকত আলী, শরফ উদ্দীন আহমদ চৌধুরী, শাহেদ আলী, শাহেরা বানু, সখাওতুল আম্বিয়া, সাফাত আহমদ চৌধুরী, সৈয়দ মুজতবা আলী, সৈয়দা নজিবুন্নেছা খাতুন, সৈয়দ মোতাহির আলী, সোনাওর আলী, সিরাজউদ্দিন আহমদ, শামসুদ্দিন আহমদ, হাজেরা মাহমুদ ও হিমাংশু ভট্টাচার্য্য।৫ 

১. তাজুল মোহাম্মদ, প্রবন্ধ : ভাষা আন্দোলনে সিলেট, বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাস, দ্বিতীয় খ-, বৃহত্তর সিলেট ইতিহাস প্রণয়ন পরিষদ, সিলেট ২০০৬
২. তাজুল মোহাম্মদ, ভাষা আন্দোলনে সিলেট, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯৪
৩. তাজুল মোহাম্মদ, প্রবন্ধ: ভাষা আন্দোলনে সিলেট, প্রাগুক্ত
৪. তাজুল মোহাম্মদ, প্রবন্ধ: ভাষা আন্দোলনে সিলেট, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৪৩
৫. তাজুল মোহাম্মদ, প্রাগুক্ত

অপূর্ব শর্মা
সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক
সিলেট, বাংলাদেশ।