অটোয়া, বৃহস্পতিবার ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪
মা মাফ চাইলো -জাকির সোহান

য়স কত হবে?  চার মাস হবে। চারদিকে আনন্দ। খুশি সবাই। ঘর আলোকিত হবে। আর ক’দিন পর দেখব পৃথিবীর মুখ।

একটা লোক সকালে নিয়মিত হাটে- একই জায়গায় বেশ ক’বছর ধরে। তাকে সেখানে গাড়ি চাপায়  মরতে হলো। যে মারা গেল সে ছিল আমার বাবা। মায়ের মুখে শুনেছি। রাজপ্রাসাদে জন্মাবার আয়োজন ছিল। একটা মৃত্যু- যে মৃত্যু কারো জন্ম ঠেকাতে পারে না সেই মৃত্যু সব আনন্দ আয়োজন তছনছ করে দিলো। 
জন্মাবার আগেই মাথায় অনেক দেনা! আমাকে পেটে নিয়ে মা একটার পর একটা সম্পত্তি বেঁচে দিয়ে ধার দেনা আর দাবী মেটাচ্ছিল। যত ফ্যাক্টরি ছিল ক’মাসে লোকসানে পড়ল। চালু রাখলে ঋণ করতে হবে। কাক মরলেও তো চেনা অচেনা কাক সমবেদনা জানায়। একটা মানুষ হঠাৎ মরল তার যেনো কোন আত্মীয়ই নেই! ব্যাংকে মাত্র দশ লাখ টাকা। অথচ বাবা মারা যাওয়ার সময় ছিল কয়েক কোটির মতো! তদন্ত করার প্রয়োজন নেই। সহজ সরল মা কেন যেনো সব ছেড়ে দিয়েছে। আমি নাকি তার সব! 
শোক মানুষকে ফতুর করে দেয়- এটা আমার আবিষ্কার। আমার জন্মের একবছর পর মা’র এক বন্ধুর সাথে মায়ের দেখা। মায়ের মন বদলে গেল। হাসি খুশি ভাব। লোকটা খুব ভাল মানুষ। সন্তান আছে তারপরেও সব জেনে শুনে মা-কে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। অবাক বিষয়- মা রাজি নয়। কিন্তু তার একান্ত আপন কাউকে দরকার। লোকটা মাকে সময় দিলো। মায়ের বয়স ছাব্বিশ। লোকটার বয়সও তেমনি হবে। লোকটা অবিবাহিত। মায়ের যত ধন সম্পত্তি আছে তার চেয়ে অনেক গুণ ধনী লোকটা। পাত্রী নাকি পাচ্ছে না। মা-কে তার পছন্দ। ভদ্্র, সম্ভ্রান্ত লোকটা বিনয়ের সাথে সবার সঙ্গে কথা বলে। মা- তার সাথে কথা বলে নিসংকোচে। ছ’মাস পর মায়ের মন গলে গেল। বিয়ের দিন ঠিক। বিয়ে হলো। বাসর লোকটার বাড়িতে। লোকটা একা বিশাল বাড়িতে থাকে। পাশের একটা ঘরে আমাকে রেখে মা তার বাসর ঘরে গেল। এই প্রথম আমি একা থাকছি। বাসর ঘরে লোকটা ওয়াশ রুমে যখন ঢুকলো মা হঠাৎ লোকটাকে না জানিয়ে চুপি চুপি আমার ঘরে আসলো। আমাকে কোলে নিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে এ্যামেরিকায় চলে এলো। সেই থেকে আমি এ্যামেরিকায়। 

মা বিষন্ন হলেও কারো প্রতি আর অনুরক্ত হয়নি। এ্যামেরিকায় শুরু হল নতুন জীবন। হাতে অর্থ কড়ি নেই। মা একটা দোকানে সেলস গার্লের কাজ নিলো। আমি যে তার সন্তান তা জানতে দেয়নি। আমাকে ভাগনে বলে পরিচয় দেয় দোকান মালিকের কাছে। বাচ্চা আছে জানলে কাজ দিবে না। প্রথম দিকে ছোট্ট একটা ঘরে মা আমাকে বন্দি করে রেখে যেত। তারপর হাতে টাকাপয়সা হলে বাঙ্গালি কমিউনিটির ডে-কেয়ারে আমাকে রাখা শুরু করলো। ফলে দোকানের মালিক বুঝতেই পারলো না আমি তার সন্তান। সেই দোকানদার বড়ই ভালো মানুষ ছিলো। বাংলা বুঝত না। মাঝে মাঝে মা ওই দোকানে আমাকে নিয়ে যেত। দোকান মালিক ; আমাকে ¯েœহ করত। মা বাংলায় আমাকে আদর করত- বাবা-বাবা বলে ডাকত। দোকান মালিক হাসত। মাকে মাঝে মাঝে বলত- তুমি তো ভাগ্নেকে মায়ের মতই আদর কর। মা-ও নাকি বলত- মায়ের চেয়ে মাসী মার দরদ বেশী। দোকান মালিক হাসত। 

আমার বয়স যখন দশ- তখন আমার একটা বড় রকমের রোগ জেকে বসে। চিকিৎসার জন্য এত টাকা লাগবে তা ভেবে মা দিশেহারা হয়ে গেল। দিনকাল ভালোই যাচ্চিল। মা-য়ের যা রোজগার তা-তে সচ্ছলভাবে আমরা চলতে পারতাম। আমি বিছানায় শুয়ে আছি মা মাথায় হাত বুলাচ্ছে। মায়ের চোখের পানি আমার কপালে পড়ল। আমি মায়ের নাক টানার শব্দ শুনে উঠে বসলাম। মায়ের মুখের দিকে তাকাতেই মা আমাকে জড়িয়ে ধরে ঢুকরে কাঁদতে লাগলো। এরপর মা আমার চিকিৎসার টাকা জোগার করলো- হাসি মুখে তার একটা কিডনি বেচে দিলো। 

মা কিছু দিনপর ট্যাক্সির ড্রাইভার হিসেবে কাজ শুরু করল। ধীরে ধীরে আমিও বড় হতে থাকি। আমার আঠারোতম জন্মদিন উপলক্ষ্যে মা একটা নিজে ট্যাক্সি কিনে। এটা মায়ের কেনা প্রথম ট্যাক্সি। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই জন্মদিনের ট্যাক্সি উপহার পাই। মাকে নিয়ে আমি লং ড্্রাইভে বেরুই। মাকে এই দিন সব চেয়ে উজ্জল মনে হলো। মা বলল- ‘আজ থেকে তুই মেচুউর। নিজে রোজগার করবি.....।’ আমি হেসে সায় দিই। জন্মদিনে কোন জাকজমক পার্টি হয়নি। মা আর আমি। রাতে খেতে খেতে মায়ের জীবনের সব কথা মা আমাকে খুলে বলে। মা আমার কাছে মাফ চাইলো। বললো- ‘তোকে ছেড়ে কোথাও যেতে চাইনি। বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম, বিয়ে করেছি কিন্তু তুই একটু দূরে থাকায় বাসর ছেড়ে পালিয়েছি। জানতাম আমি বিয়ে তোকে দূরে নিয়ে যাবে কিন্তু ওই সময় ভুলে গিয়েছিলাম। তুই মাফ করে দিস। ’ আমি কিছু বলতে পারিনি। শুধু দু’চোখে পানি গড়িয়ে পড়েছে।

জাকির সোহান
ঢাকা, বাংলাদেশ।