অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
দেশদ্রোহিতা রাজনীতি নয়- অপরাধ

খুরশীদ শাম্মী, টরন্টোঃ  
২০২৩ সাল থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইউটিউবে খুব ঘটা করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে নেতিবাচক কিছু বক্তব্য প্রচার করার চেষ্টা চলছিল। কোথাও অর্ধসত্য, কোথাও বিকৃত তথ্যে বক্তব্য ও মন্তব্যের মাধ্যমে কবিকে সাম্প্রদায়িক প্রমাণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল একদল মানুষ। ওই মানুষগুলো ভিতরে ভিতরে এতটা-ই সাম্প্রদায়িক যে একজন অমুসলিম কবি রচিত জাতীয় সংগীতও ওদের গাত্রদাহের কারণ। হ্যাঁ, কোনো যৌক্তিক প্রমাণ ব্যতিরেকে কবিকে নিয়ে ওরা অহেতুক অপপ্রচার করে সর্বশেষে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন কবি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে ওদের নানাবিধ আচরণে একটা বিষয় বারবার পরিষ্কার ফুটে উঠেছে, 'ওদের ভারত ও অমুসলিম বিরোধিতা-ই ছিল কবি বিরোধিতার অন্যতম কারণ।'

শুধু কি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওদের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন? 
না। ওদের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন মানবতাবাদী সাধক লালন শাহও। নরসিংদীর বেলাব উপজেলার পাটুলী ইউনিয়নে লালন সংগীতের আখড়াবাড়ি পুলকিত আশ্রমের সাধুসঙ্গে হামলা এবং বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছিল দুর্বৃত্তরা ২০২৩ সালের মাঝামাঝি।অবশ্য দীর্ঘদিন ধরেই ওরা লালন সংগীত ও লালন ভক্তদের সঙ্গে শত্রুতা করে আসছিল। লালন সাঁইকে শত্রু ভাবার কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো তাঁর রেখে যাওয়া অসংখ্য অর্থবহ তাৎপর্যপূর্ণ গান। আধ্যাত্মিক সরলতায় তিনি তাঁর গানে যে মানবিক ও যৌক্তিক কথা বলে গেছেন, সেগুলো রীতিমতো ওদের শঙ্কার কারণ হয়েছিল বলেই ওরা লালনভক্তদের সঙ্গে শত্রুতা করেছিল এবং এখনো করে যাচ্ছে।

ওরা শুধুমাত্র কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা লালন সাঁইয়ের স্মৃতির বিরুদ্ধতা করলে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে সক্ষম হতাম এই বলে যে তাঁদের অনুপস্থিতিতে অতি চালাকের দল নিজেদের জাহির করার অভিপ্রায়ে প্রলাপ বকছে হয়তো। কিন্তু ওরা লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গেও শত্রুতা করেই চলছিল। লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের বিরোধিতা করার কারণ দু'টি। প্রথম কারণ, তরুণ সমাজের জন্য তাঁর একের পর এক বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্য রচনা এবং দ্বিতীয় কারণ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাঁর অবস্থানের দৃঢ়তা।ইতঃপূর্ব বেশ কয়েকবার তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল, কাফনের কাপড় পাঠিয়েও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তাঁর বই বর্জন, তাঁকে বর্জন করার বিভিন্ন কার্যক্রমও এগিয়ে চলছিল একটার পর একটা। পাশাপাশি তরুণ সমাজে অপসংস্কৃতির চাষবাদ করার চেষ্টাও হয়েছে। দু:খজনক হলেও একশ্রেণির জনগণ এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে যথেষ্ট।

হ্যাঁ, উপরে উল্লেখিত মাত্র কয়েকজনের বিরুদ্ধে নয়, ওরা তালিকা করে সুপরিকল্পিতভাবে অন্যান্য মুক্তমনা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সাংবাদিক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদেরও বিরুদ্ধাচারণ করে এসেছিল। মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবার নিয়েও ছিল নানান অভিযোগ। হলুদ সাংবাদিকতা ও বর্তমান প্রযুক্তির সুযোগ ব্যবহার করে ওরা তাদের নামে ক্রমাগত অপপ্রচার চালিয়ে মিথ্যাকে সত্যে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেছিল। সফলও হয়েছিল। যার প্রমাণ, গণ অভ্যুত্থান রূপে জুলাই আগস্টে ওদের পরিকল্পিত প্রতিহিংসা বাস্তবায়ন।

একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে এই বিষয়গুলো মোটেও কাকতালীয় নয়। কেমন হুবহু মিলে যাচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় একাত্তরের দিনগুলোর মর্মান্তিক ঘটনাগুলোর সাথে। আল-বদর, আল-শামসের হিংস্রতার সাথে। যেন বেরিয়ে এসেছে মুখোশের আড়ালের ওদের সেই পুরাতন দুশমনি।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পূর্বে ওরা যাদের নামে ঘটা করে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছিল, ৫ আগস্টের পর তাদের অনেকের নামে মিথ্যা মামলা জড়িয়ে দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কারো বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি শাহরিয়ার কবিরকে গ্রেপ্তার, মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সভাপতি জেড আই খান পান্নার নামে হত্যাচেষ্টার মামলা দু'টো জলজ্যান্ত উদাহরণ। এমন অসংখ্য প্রমাণ নথিবদ্ধ করা আছে। হ্যাঁ, ওদের তালিকায় প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে কোনো প্রজ্ঞাত কিংবা নির্ভীক মুক্তমনা ব্যক্তির নাম। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, ওদের দৃষ্টি মূলত ওইসকল মেধাবী, সৃষ্টিশীল, প্রগতিশীল ও সাহসী ব্যক্তিবর্গের উপর, যাদের মেধা ও সৃষ্টিশীলতা রীতিমতো ওদের শঙ্কার কারণ। সেইজন্য তাদের মেধা, সৃজনশীল প্রতিভা, মুক্তচিন্তা চর্চা ব্যাহত করার আপ্রাণ চেষ্টা এবং প্রয়োজনে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে ওরা।

একাত্তরের রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস প্রতিজ্ঞামতো আবারও শুরু করেছে দানবতা। এক এক করে পুলিশ হত্যা, জেল থেকে সাজাপ্রাপ্ত আসামি মুক্ত করে দেওয়া, থানা পুড়িয়ে দেওয়া, অস্ত্র লুট করা, ইত্যাদি রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ড সবগুলোই করেছে ওরা। প্রতিজ্ঞা মতো অসমাপ্ত প্রকল্প সমাপ্ত করতেই যেন ওরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত স্পষ্টবাদী ও  নির্ভীক ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে বন্দি করে রেখেছে দীর্ঘদিন যাবত, যেখানে তাদের শারীরিক সুস্থতা ও জীবন কাটে অনিশ্চয়তায়। কারাগারে কেউ মারা গেলেও জানার উপায় নেই। আজকাল যেভাবে নজিরবিহীন জবাই করে হত্যার হুমকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়, জনসম্মুখে রামদা দিয়ে মানুষের দেহ কাটা হয়; বাধ্য হয়ে বলতে হয়, হত্যা ওদের কাছে উৎসব। জাতীয় স্লোগান 'জয় বাংলা' লেখার অপরাধে হত্যা করা হয় কিশোর ও যুবককে, পুত্র ছাত্রলীগ করার দায়ে প্রার্থনারত মাকে হত্যা করতে ওদের বুক কাঁপে না। পদে পদে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান এবং তাঁদের ও তাঁদের পরিবারে উপর শারিরীক ও মানসিক হামলা। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অহেতুক নির্যাতন, গ্রেফতার ও হত্যা করা হচ্ছে যখন-তখন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে, জাতীয় পার্টির অফিস পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে, অথচ ওগুলো যে দেশেরও সম্পদ, তা ওদের হিংস্র বুদ্ধিতে নাগাল পায়নি। ওদের পাকিস্তান প্রীতি ও ভারত বিরোধী মনোভাবের কারণে সনাতনীদের উপর আক্রমণ, তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে জ্বালিয়ে দেওয়া, সাধুসহ অন্যান্যদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে অন্যায়ভাবে। শিক্ষক, চিকিৎসক ও বিভিন্ন পেশাজীবীদের অপমান করে চাকরিচ্যূত করা হচ্ছে ন্যূনতম অভিযোগে। মতলবি তালিকা করে বিশেষ এক শ্রেণির নাগরিকের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি এবং আদালত চত্বরে গ্রেপ্তার হওয়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মারধর করার ঘটনা নজিরবিহীন। আইনজীবী নিয়োগে বিরোধিতা ও জটিলতা সৃষ্টি করার মতো অমানবিক কার্যকলাপে চলে ওদের প্রতিহিংসা বাস্তবায়ন।

আমরা অনেকে হয়তো বাংলাদেশের বর্তমান অস্থির পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ হিসেবে প্রমাণ করার নানাবিধ যুক্তি উত্থাপন করছি। আদৌ কি এসব রাজনীতি? এসব অপকর্মকে সোজাসুজি সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রের সাথে প্রতারণা বলা যুক্তিযুক্ত। কোনো বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ এইসব পাশবিক গণহত্যা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে রাজনীতি বলে মেনে নেবেন না। কারণ রাজনীতি সন্ত্রাস নয়। নিন্দুকেরা রাজনীতিকে যে ভাষাতেই গাল-মন্দ করুক না কেন, রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি রাজনীতির দায়বদ্ধতা আছে। কোনো রাজনৈতিক নেতা সেইসব দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না।

আমি ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতিতে তুলসীগাছ খোঁজার যুক্তি খুঁজে পাইনি কখনো। আমি মনে করি, রাজনীতিতে সাধু সন্ধান করা আর বিশাল সমুদ্রের নোনাজলে তেতোপুঁটি সন্ধান করার মধ্যে পার্থক্য নেই তেমন। তবে, রাজনৈতিক নেতাকে অবশ্যই দেশপ্রেমিক ও জনদরদী হওয়া অত্যাবশ্যক - সেটা বুঝি। সাধারণ খেটে খাওয়া জনগণের কল্যাণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং দায়িত্ব পালনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়াও জরুরি। প্রশাসনে দায়িত্বরত রাষ্ট্রপ্রধানকে দল, মত নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা ও মৌলিক চাহিদা পূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হয়, ঘুরেফিরে ওটা-ই তার প্রধান কর্তব্য। সুতরাং রাজনৈতিক নেতার ক্ষমতার প্রতি দুর্বলতা ও দলীয়করণ ত্রুটিগুলোকে কিয়দংশ এড়িয়ে যেতে পারলেও জন্মশত্রু রাষ্ট্রের সঙ্গে গলাগলি, নিজ দেশের সাধারণ জনগণের সাথে প্রতারণা, তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে জনগণ তথা রাষ্ট্রের সম্পত্তি ধ্বংস করা, মুক্তিযুদ্ধকে ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অস্বীকার করা ও ঢালাওভাবে অবর্ণনীয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ব্যক্তি ও ব্যক্তিবর্গকে আমি রাজনৈতিক নেতা বলতে সম্মত নই। ছদ্মবেশে আবির্ভূত ওইসকল প্রতারকদের মধ্যে সেই একাত্তরের দেশদ্রোহীদের প্রতিকৃতি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দেশদ্রোহিতা রাজনীতি নয়, অপরাধ। একটা স্বাধীন দেশে দেশদ্রোহিতার অপরাধে যে শাস্তি নির্ধারিত আছে, ওদের প্রত্যেকের জন্য সেই শাস্তি দাবি করছি।

খুরশীদ শাম্মী
ডিসেম্বর ২১, ২০২৪
টরন্টো, কানাডা