অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
আত্মজ - সুফিয়া ফারজানা

কাঁচা বাজার থেকে বেগুন, শসা, লেবু, একটা পেঁপে, কাঁচা মরিচ আর ধনিয়াপাতা কিনলো শিউলি। এই সময়টা বাসায় থাকতে ভালো লাগে না তার। জাহিদ সকাল ছয়টায় বাসা থেকে বের হয়। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে সে। সেই কোম্পানি মতিঝিলে। তারা থাকে পল্লবীতে। ভোর ছয়টায় বাসা থেকে বের না হলে আটটায় অফিসে ঢুকতে পারে না জাহিদ। মাসে তিন দিন লেট পাঞ্চ করলে একদিনের বেতন কাটে কোম্পানি। তাই ভোর ছয়টার মধ্যেই রেডি হয়ে দুপুরের খাবার নিয়ে বাসা থেকে বের হতে হয় জাহিদকে। শিউলি রাতেই তরকারি রান্না করে ফ্রিজে রেখে দেয়। ভোর পাঁচটায় উঠে এক চুলায় তরকারি গরম করে, আরেক চুলায় ভাত বসায়। দু'জনে ফজরের নামাজ পড়তে পড়তে ভাত হয়ে যায়। অল্প একটু গরম ভাত খেয়ে দুপুরের ভাত-তরকারি হট বক্সে ভরে নিয়ে বের হয়ে যায় জাহিদ। ওদের অফিসের গাড়ি নেই। তাই পাবলিক বাসই ভরসা।

জাহিদ চলে গেলে রান্নাঘরটা গুছিয়ে ফার্নিচারগুলো মুছে ঘর ঝাড়ু দেয় শিউলি। তারপর এক কাপ চা বানায় সে। কিছুদিন ধরে কোন কিছুই খেতে ভালো লাগে না তার। একটা টোস্ট বিস্কুট দিয়ে এক কাপ কড়া দুধ চা খায় সকালে। এই সময়টা খুবই ভালো লাগে তার। তারপর বারান্দার গাছগুলোতে পানি দেয়। লেবু গাছটাতে ছোট ছোট লেবু হয়েছে কয়েকটা। এই লেবুগুলো বড় হয় না কেন জানি। ছোটই থাকে, তারপর ঝরে পরে যায়। তবু ভালো লাগে। কী অপূর্ব মন মাতানো ঘ্রাণ লেবুপাতার! শিউলিদের গ্রামের বাড়ির লেবুগাছে প্রচুর লেবু হয়। এবার ঢাকায় আসার সময় অনেক লেবু ছিঁড়ে দিয়েছিলেন তার শ্বশুর। জাহিদ লেবুর শরবত খেতে খুব ভালবাসে।

চা খেয়ে কাঁচা বাজারে গেল শিউলি। বেগুন, শসা, পেঁপে, কাঁচা মরিচ আর লেবু কিনে ফেরার সময় চোখ গেল মাংসের দোকানে। এই দোকানটাতে ফ্রেশ গরুর মাংস পাওয়া যায় সকালে। কিন্তু শিউলির কাছে তো বেশি টাকা নেই। তবু মাংসের দোকানে গেল শিউলি। হাফ কেজি মাংস যদি নেওয়া যায়! পেঁপে দিয়ে গরুর মাংস খুব পছন্দ করে জাহিদ। কিন্তু হাফ কেজির দামই ৩৫০ টাকা। শিউলির কাছে আছে ৩০০ টাকা। লজ্জায় কিছু বলতে পারে না সে। ফিরে আসে দোকান থেকে। পিছন থেকে ডাক দেন দোকানের মালিক, "মা জননী, কি হইলো? গোশত নিলেন না?"
"না, চাচা। থাক।" একটু মলিন হেসে বলে শিউলি।
"আরে, নিয়া যান।"
"হাফ কেজি গরুর মাংস নিতাম। কিন্তু আমার কাছে ৫০ টাকা কম আছে, চাচা।"
"নেন, নিয়া যান। ৫০ টাকা আরেক দিন দিয়েন। অই বাবলু, ভালো দেইখা হাফ কেজি গরুর গোশত দে মায়েরে।"
বাবলু নামের কিশোর ছেলেটা হাফ কেজি মাংস পলিথিনের ব্যাগে ভরে যত্ন করে এগিয়ে দেয়,"নেন, আফা।"

শিউলি তাড়াতাড়ি ৩০০ টাকা বের করে দিয়ে মাংস নিয়ে চলে আসে সেখান থেকে। কেমন জানি কান্না আসে তার। এই লোকগুলো তাকে চেনেও না। মাছ, মাংস যা কেনার, জাহিদই কেনে। শিউলি কখনও আসেনি মাংসের দোকানে। অবশ্য জাহিদ যে খুব কেনে, তাও নয়। মাংস তারা কমই খায়। হয়ত মাসে একবার। ২৫ হাজার টাকা মাসিক বেতনে ঢাকা শহরে সংসার চালানো আসলেই কঠিন। একটা বেডরুম, একটুখানি ডাইনিং, রান্নাঘর আর এক চিলতে বারান্দার ছোট্ট ফ্ল্যাট, তাও ছয় তলায়। তারই ভাড়া সব মিলে ১৩ হাজার পরে। বাড়িতেও কিছু টাকা নিয়মিত দিতে হয় জাহিদকে। ইদানীং অফিস থেকে ফেরার পর ক্লান্ত জাহিদকে দেখে খুব মায়া হয় শিউলির। এত পরিশ্রম করে মানুষটা! এর বেশি আর কি করবে বেচারা!

বাজার থেকে বাসায় ফেরার পথে একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে। এই স্কুলে চাকরির জন্য গিয়েছিল শিউলি। এসব স্কুলে বেতন অনেক কম। তবু চাকরির পাশাপাশি দুই একটা টিউশনি করলে কিছুটা সাপোর্ট তো দিতে পারতো সংসারে। কিন্তু তাকে নিয়োগ দিতে রাজি হননি স্কুলের প্রিন্সিপাল। এখানে টিচার হতে গেলে অনার্স পাস হতে হয়। ইন্টারমিডিয়েটের পর আর পড়াশোনার সুযোগ হয়নি শিউলির। সে দেখতে শুনতে বেশ ভালো। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর ছোটখালা এই বিয়ের প্রস্তাবটা দিলেন শিউলির জন্য। ছোট খালার মামাতো ভাসুরের ছেলে জাহিদ। ছেলে মাস্টার্স পাস। ছেলে লম্বা চওড়া, চেহারা ভালো, ঢাকায় চাকরি করে আর খুবই ভদ্র। তাছাড়া পরিচিত পরিবার। ছেলের বাড়ির অবস্হা খুব একটা ভালো নয় অবশ্য। তবু এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন শিউলির বাবা। চার বোনের মধ্যে শিউলি বড়। মেয়েদের বিয়ে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন শিউলির বাবা। তিনি ছোটখাটো ব্যবসা করে অতি কষ্টে সংসার চালান। এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব মেয়ের জন্য তিনি আশাও করেননি। তবে শিউলি পড়াশোনায় ভালো ছিল। এসএসসি এবং ইন্টারমিডিয়েটে তার রেজাল্ট বেশ ভালো। জাহিদের ইচ্ছা থাকলেও সামর্থ্য নেই শিউলিকে অনার্স পড়ানোর। এই কারণে জাহিদ অনেক বার দুঃখ প্রকাশ করেছে শিউলির কাছে। মানুষটা সত্যিই খুব ভালো।

বাসায় ফিরে ঝটপট রান্না সেরে ফেলে শিউলি। মসলা বেটে গরুর মাংস রান্না করে পেঁপে দিয়ে। সাথে পাতলা মসুরের ডাল আর বেগুন ভাজি। মাংসের সুঘ্রাণে ঘর ভরে যায় শিউলির। একটা লেবু আর শসা কেটে সাজিয়ে রাখে টেবিলে। কাল অফিসে মাংসের তরকারি নিয়ে যাবে জাহিদ। গত পরশু জাহিদ বলছিলো, "কী এক পাংগাশ আর তেলাপিয়া মাছের তরকারি প্রতিদিন নিয়ে যাই, শিউলি। খুব লজ্জা লাগে সবার সাথে বসে খেতে।"

আগামীকাল অনেক দিন পর একটু ভালো খাবার দিতে পারবে সে জাহিদকে। এটা ভাবতেই  অজানা এক ভালো লাগায় মন ভরে যায় শিউলির। ঠিক সেই সময়ে মাথাটা ঘুরে উঠে হঠাৎ। দৌড়ে বেসিনে গিয়ে বমি করে সে। বমি করার পর মাথাটা হালকা হয়, একটু ভালো লাগে তার। আজও অনেক বমি হল। প্রতিদিন বমি হচ্ছে। ইদানীং কিছুই খেতে পারে না সে। শিউলি ভাবে, আজকেই জাহিদকে দিতে হবে সুখবরটা। আর দেরী করা যায় না। আচ্ছা, খবরটা শুনে জাহিদ খুশি হবে তো? নাকি দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে যাবে তার??

সুফিয়া ফারজানা
ঢাকা, বাংলাদেশ