অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
আপদ - রাশেদ নবী

মি দ্বিধান্বিত হয়ে গাড়ি থামাই। সোজা পূর্বদিকে যাব না দক্ষিণ-পূর্বদিকে? মোড়ে একটা ছোট মল দেখা যায়। ওখানে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করা যাক। নামার জন্য আমি গাড়ির দরজা খুলি।

‘মহামারির সময় কাউকে বিশ্বাস না করাই ভাল।’ 

‘তা ঠিক…।’ আমি উত্তর দিতে গিয়ে চমকে যাই। গাড়িতে কে? গাড়ির দরজা খোলায় গাড়ির ভিতরে আলো জ্বলে ওঠে। বাইরে অন্ধকার। গাড়ির আলোতে পিছনের সিট পরিষ্কার দেখা যায়। কেউ নাই। সম্ভবত একটানা অনেকক্ষণ গাড়ি চালানোর কারণে আমার মাথা কাজ করছে না। 

মলের দোকানগুলো খোলা, কিন্তু কোথাও কাউকে দেখা যায় না। কয়েক দোকান পরে একজন দোকানীকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করি কোনট সঠিক রাস্তা। সে আমাকে আমার গন্তব্যের ঠিকানা দিতে বলে। আমি সেল ফোন বের করে ঠিকানা খুঁজি। কিন্তু সেল ফোনের সব নাম-ঠিকানা অস্পষ্ট হতে হতে মিলিয়ে যায়। ইতস্ততভাবে দোকানীকে বলি, ‘ওইদিকের রাস্তাটাই। আমি অনেকবার গেছি… একটা পুরানা শহর, একট নতুন কলেজ ক্যাম্পাস, একটা বড় নদী পার হয়ে…। 

‘সব হাইওয়েই কোনো না কোনো বড় নদী পার হয়।’ আমার কথা থামিয়ে দিয়ে সে হাঁটতে থাকে। আমি আলো-অন্ধকারে তাকে অনুসরণ করি ‘এখানেও একটু উত্তরদিকে গেলেই একটা বড় নদী পাবে। নদীর ওপারে একটা বড় সম্মেলন কেন্দ্র। চল তোমাকে নিয়ে যা্চ্ছি।’ 

‘গাড়িটা এখানে রেখে যাব?’ আমি জিজ্ঞেস করি। 

‘গাড়িটা পকেটে নাও না!’ সে নির্বিকারভাবে উত্তর দেয়। 

‘ঠিক কথা।’ সাদা জিপগাড়িটা ছুঁতেই তা আমার হাতের মুঠোয় উঠে আসে। আমি তা পকেটে ভরি। 

সম্মেলন কেন্দ্রটা সত্যিই বড়। সম্মেলন কক্ষের ভিতরে অন্ধকারাচ্ছন্ন, বাইরে দিনের আলো। আমি বের হয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়াই। এইপাশে আমার সাদা জিপটা পার্ক করা ছিল; ওইপাশে গেল কি ভাবে? কেউ একজন ড্রাইভারের সিটে বসে; তার লম্বা চুল, বড় গোঁফ। আমি পিছন ফিরে ক্ষু্ব্ধ কন্ঠে দোকানীকে বলি, ‘আামার গাড়ি ওই উজবুককে দিয়েছ কেন?’ 

দোকানীকে দেখা যায় না। সামনে ফিরে দেখি জিপগাড়িটাও নাই। 

এখন কি করি? 

সম্মেলন কেন্দ্রের কাছেই একটা বিশাল রেষ্টুরেন্ট। ভিতরে অনেক খদ্দের। জানলার ধারে যে টেবিলে গিয়ে আমি বসি সেখানকার সবাইকে মনে হয় ঘনিষ্ঠ। জানলার বাইরে থেকে একজন হেঁড়ে গলায় চিৎকার করে বলে, ‘মহামারির সময় এরকম দলবদ্ধ পানাহার…!’ 

সবাই ভয় পেয়ে হুড়মুড় করে ছুটে বেরিয়ে যায়। আমার টেবিলের সঙ্গীদের একজন ‘চল’ বলে দৌড় দেয়। আমিও সবার সাথে দৌড়ে একটা ফাঁকা হাইওয়েতে এসে পৌঁছাই। চারদিকে অন্ধকার। রাস্তার মাঝখানে আমার জিপটা দাঁড়িয়ে। হেডলা্ইট জ্বলছে। সবাই ঠেলাঠেলি করে গাড়িতে উঠে বসে; দোকানী তাদের একজন। আর উজবুকটা ড্রাইভারের সিটে বসে গোঁফে তা দিচ্ছে। 

‘আমার গাড়ি নিয়ে পালাচ্ছ? এই মহামারীর মধ্যে কোথায় পালাবে?’ আমি চেঁচিয়ে বলি। 

দোকানী মুখ বের করে বলে, ‘“আমার গাড়ি,” “আমার গাড়ি” বলে বুক ফাটিও না। একটা খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলো, যাও!’ সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। 

বটে ! খেলনা গাড়ি! জিপটা ছুঁতেই তা খেলনা গাড়ি হয়ে অবলীলায় আমার হাতের তালুতে উঠে আসে। গাড়ি-দখলকারীরা ‘এই ভূতো, এই ভূতো’ বলতে বলতে একে অপরকে ফুঁ দিতে দিতে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। চারদিক আবার আলোয় স্পষ্ট হয়। 

গাড়ি ফিরে পেয়ে আমি ড্রাইভারের সিটে উঠে বসি। 

এখন, আগে ঠিক করা যাক কোনদিকে যাব।

রাশেদ নবী
অটোয়া, কানাডা