অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
মাধবীলতা - ফাহমিদা রিআ

তুন ফ্লাটে ওঠার পর টুনের স্কুলটাও নতুন হলো।  হিসেবটা মাথায় রেখেই নাঈম নাজমা বাসা শিফট করেছেন। 
হাঁটা পথের দূরত্ব হলেও নাঈম অফিস যাবার সময় টুনকে গাড়িতেই তুলে নেয়। গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। 
আর  নাজমা যায় স্কুল শেষে আনতে। ছুটির ঘন্টা বাজার সাথে সাথে গেটের বাইরে অপেক্ষমাণ নাজমাকে পেয়ে কাঁধের ব্যাগটা  হাতে গছিয়ে দিয়ে দে ছুট। এক্কেবারে স্কুল ঘেঁষা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর।  আগেই বায়না করে রাখা জিনিসটি নিয়ে সোজা কাউন্টার। মা দাম দেয়ার সাথে সাথে লক্ষী ছেলেটি হয়ে বাকি পথটুকু মাড়িয়ে সোজা নিজেদের গন্ডি।
দিন তিনেকের মাথায় নাজমা খেয়াল করলেন ওদের আগে বা পিছে ঐ স্কুলেরই পোশাকে ছোট্ট একটি মেয়েও কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ওদের গন্ডিতেই ফিরে। সংগে কেউ থাকেন কিনা চোখে পড়ে নি। রাস্তা পারাপারের ঝামেলা নেই, একা আসলেও আসতে পারে। কিন্তু যা দিনকাল পড়েছে আজকাল। কোন কিছুতেই আস্হা নেই। তাছাড়া মেয়েটা টুনের চেয়ে সামান্যই বড়। এ বয়সে শহরের পথে  একা একা বাচ্চাকে ছেড়ে দিতে পারারও হিম্মত লাগে। যেটা অনেক বাবা মায়েরই থাকে না। 
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে লিফটের দরজা খুলতেই  টুন মার হাত ধরে টেনে ঢুকায় নাজমাকে।  এইতো সেই মিষ্টি মেয়েটাও আজ ওদের সাথে। 
নাজমা ওর দিকে তাকাতেই পরিচিত একটা হাসি দিলো মেয়েটি, বললো
- আন্টি তোমার বাবুটা একা স্কুলে যেতে চায় না?
নাজমা ওর কথার ধরনে হেসে বলেন
- উঁহু। ওতো নতুন তাই। তুমি বুঝি একাই যাও?
- যাইতো। আমার মত বড় হলে বাবুও পারবে।
- তুমি বড় হয়ে গেছো বুঝি? কি নাম তোমার?
সজোরে হ্যাঁ সুচক মাথা ঝাঁকিয়ে বলে মেয়েটি, 
- বড়ইতো। প্লে থেকে কেজিতে ওঠেছি  যে। আমার নাম? মাধবীলতা।
লিফট আটতলায় আসতেই হুড়মুড়িয়ে চলে যায় মেয়েটি।
নাজমার ভারী ভালো লাগে ওর চটপটে কথাগুলি।  ওরে বাব্বা, কি গাল ভরা নাম- মাধবীলতা।
পরদিন ছুটির সময় আবার দেখা। 
- মাধবী...... 
দাঁড়িয়ে পড়লো মেয়ে  তখনই।

টুন গেট পেরিয়ে মার হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে দে ছুট।
মা পিছন থেকে চেচিঁয়ে বললেন,
-টুন  দুটো চিপস নিবি আজ।

এভাবেই  ঐ সপ্তাহের প্রতিদিনই একসাথে আসা যাওয়াটা নিয়ম হয়ে যায় ওদের তিনজনের।
নাজমা অলিখিত চুক্তির মত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে মাধবীর বের হতে দেরী হলে।

কত গল্প যে করে মাধবী একটুকু সময়ের পথ চলতে চলতে। টুন এর উপরের ক্লাশে পড়ে বলে সব কিছুতেই একটা বড়মানুষী আচরন করে মাধবী টুন এর সাথে।
পথের মাঝে দৌড়ে চলতে হয় না, জেদ করতে হয় না, আরও কত কি। আর অবাক ব্যাপার,  টুন কিন্তু মাধবীর আদেশগুলো সত্যি সত্যি মেনেও নেয়। যেন ওর জন্মের আগে হারিয়ে যাওয়া  অদেখা দু'বছরের  বড় বুবুটিকে সে ফিরে পেয়েছে।
মাধবী আড়াল হলেই টুন বলে, 
- আচ্ছা মা, আমার বড় বুবুটা কি আকাশের তারা না হলে এতদিন মাধবী আপুর মতই এত বড় হতো? এমন করে ঝাঁকড়া চুলগুলো ঝাঁকিয়ে মায়া মায়া চোখে আমার শেষ হওয়া চকলেটটার দিকে তাকিয়ে নিজের ভাগের চকলেটটা দিয়ে দিতো? 
আবার চোখ পাকিয়ে বকুনিও দিতো জোরে দৌড় দিলে? আমার........
মা হেসে গড়িয়ে পড়েন টুন এর একটানা কথা বলার গতিতে, বলেন,
-মনে কর, আকাশের  জ্বলজ্বলে তারাটা টুপ করে খসে পড়ে আমাদের এই ফ্লাটের আটতলায় চলে এসেছে।

তারপর নাজমা  বুকের ভেতর থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,
- এমনটা হলে খুব ভালো হতো, তাই না রে টুন?

কদিনের একটুখানি পথ  চলাতেই কেমন যেন একটা মায়া জন্মে গেছে মেয়েটার উপর নাজমার। ধারাবাহিক গল্পের মত করে মাধবী ওর নিজের কথা, মায়ের  কথা, পিচ্চি বোনটার কথা বলে চলে এক এক দিন এক এক ভাবে। নিজের কথাও বলে, মা জোর করে করে এটা খাওয়ায়, ওটা পরায়।  পড়তে বসায়, ছড়া শেখায়। কত খেলনা এনে দেয়। পিচ্চি বোনটা  মাকে কোথাও যেতে দেয় না। একটুখানি না দেখলে শুধু কাঁদে । আবার ছোট্ট ছোট্ট হাত পা নেড়ে ফোকলা হাসিও দেয় মাধবীকে দেখলে। ও যখন হাঁটি হাঁটি পা পা করবে, মাধবী পিংক কালারের ছোট্ট জুতো জোড়া ওর পায়ে পরিয়ে সামনে ফ্লাটের কিরন ভাইয়াদের বাসায় নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে বলবে," এই দেখো আমাদেরও নতুন বাবু আছে, তোমাদের নতুন বাবুকে কোলে নিতে দাওনি সেদিন,আমিও দিবো না, হুহ্।"

নাজমা ওর চোখে মুখের কথার তুবড়ি ছোটানোয়  মজা পান। ভাবেন, আহা বেচারি মা-টা নিশ্চয় কচি বাচ্চাটাকে নিয়ে খুব পেরেশানিতে থাকেন, তাই আসতে পারেন না কখনও মাধবীকে স্কুলে দিতে বা নিতে। 
নাজমা মনে মনে পরিকল্পনা করেন, বাসাটা পুরো গুছানো হলে ফুরসত মত একদিন মাধবীদের ফ্লাটে গিয়ে ওর মায়ের সাথে আলাপ করে আসবেন,সেই সাথে আশ্বস্তও করবেন, টুনের সাথে সাথে মাধবীকেও নিয়ে আসার দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন নিজে থেকেই।
ওয়াই ফাই সংযোগ,ডিসের সংযোগ, ল্যান্ড ফোন  সেটিং, ইন্টারকম, ডোরবেল ইত্যাদি ইত্যাদি  হাজারোটা কাজ, একটা শুরু হয়তো, আরেকটার সমস্যা দেখা দেয়।
যাই হোক,  তারপরও কদিনে অনেকটাই গুছিয়ে আনেন নাজমা। বারান্দা বাগানে এলোমেলো রাখা টবের গাছগুলি সাজাতে সাজাতে ভাবেন সামনের সাপ্তাহিক ছুটির দিনটাতেই যাবেন তিনি মাধবীদের বাসায়। টুনের বাবাও সেদিন বাসায় থাকবেন। টুনকে বাবার  জিম্মায় রেখে দিব্যি অনেকটা সময় নতুন প্রতিবেশিদের সাথে আলাপ সেরে বেড়িয়ে আসতে পারবেন নির্ঝঞ্ঝাটভাবে।

কিন্তু ছুটির দিন চলে এলো, মাধবী এলো নাতো এই দুদিনে একবারও। স্কুল কামাই? এমনটা করে নিতো এর আগের সপ্তাহের পুরোটা। তবে কি অসুখ করেছে মাধবীর? জ্বর, সর্দি, কিংবা বাসাতেই  ছুটোছুটি করতে গিয়ে ব্যাথা ট্যাথা পেলো নাতো?

নাহ্ অত ভাবনায় কাজ নেই। তারচে বরং লিফটের আট নম্বর বোতামটা টিপে একবার ঘুরেই আসা যাক। মনটা বড্ড ছটফট করছে মেয়েটাকে দুদিন না দেখে।
লিফট থেকে বেরিয়ে  খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেলেন নাজমা। "এ" নাকি "বি" কোন ফ্লাটে মাধবীরা থাকে?
পায়ে পায়ে এগিয়ে "বি"  ডোরবেলে হাত রাখেন। একবার, দুবার, বহুবার। নাহ্ কেউ ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে  বললো না, " আসুন"।
তবে কি "এ" তে থাকে মাধবী।
সামনে এগিয়ে "এ"  ফ্লাটের ডোরবেলে আঙুল ছোঁয়ান নাজমা।
খুট শব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে একটি ছোট ছেলে।
নাজমা প্রথমটায় কি বলবেন কথা খুঁজে পান না। একটু সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করেন
- এটা কি মাধবীদের বাসা?
ছেলেটা সজোরে মাথা নাড়ে 
- নাহ্ এটাতো আমাদের বাসা।
তারপর  তর্জনি তুলে সামনের ফ্লাটের দিকে,
-ঐ যে ওটা ওদের  বাসা। কদিন আগে ওরাতো  চলে গেছে নতুন বাসায়।

নাজমা প্রচন্ড ধাক্কা খান মনে মনে। 

ভেতর থেকে বড় কারো কন্ঠ ভেসে এলো,
- কিরন,  কে এসেছে? কার সাথে কথা বলছিস?

ততক্ষনে ডাকতে ডাকতে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন কিরণের মা।

নাজমা নিজ পরিচয় দিয়ে বললো,
- আমি মাধবীলতার কাছে এসেছিলাম। 
ভদ্রমহিলার মুখটি মুহুর্তেই কেমন যেন দুঃখে ছেয়ে গেলো।ধীর কন্ঠে আহ্বান জানালেন নাজমাকে
- প্লিজ ভেতরে এসে বসেন।

প্রায় আধ ঘন্টা পরে নাজমা যখন কিরনদের বাসা থেকে বেরিয়ে লিফটের বোতামে চাপ দিয়ে তর তর করে দশতলায় ওঠতে লাগলেন, দু কান জুড়ে বাজতে লাগলো কিরনের মায়ের কথাগুলি।

গত বছর  মাধবীর মা  মৃত কন্যার জন্ম দিয়ে নিজেও মারা যান। ওর দাদী দূর শহর থেকে এসে অনেক কষ্টে হাল ধরে ছিলেন  এতদিন, নাতনি আর শোকাচ্ছন্ন পুত্রটির। দাদীর ছায়ায় মাধবীকে ঠিকঠাক মনে হলেও একটু একটু করে কেমন যেন অস্বাভাবিকতার দিকে এগুচ্ছিলো। খেলার সাথীদের কাছে,স্কুলের গেটম্যান মামার কাছে, নতুন  যে কারো কাছে বানিয়ে বানিয়ে ওর কল্পনার রাজ্যের গল্প শোনায়।  মায়ের গল্প, ছোট বোনের গল্প অনর্গল বলতে থাকে। 

বাবা ব্যবসার কাজে সকাল বেলা মাধবীকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে চলে যান। ফিরেন একেবারে রাতে। মাধবীর দাদীই নিয়ে আসতেন স্কুল থেকে।  হঠাৎ  করে উনার একটা স্ট্রোক হয়ে যাবার পর কিছুদিন থেকে ও একাই আসে সামান্য পথটুকু।
মাধবীর অস্বাভাবিকতার কথা ওর বাবার কানে আসার পর সাইক্লোজিস্টের সাথেও যোগাযোগ করেন।  এভাবে একা একা ওর কল্পনাগুলো আরো শাখা প্রশাখা বিস্তার হবার আশংকা থাকায় ওর অসুস্হ দাদী আর ঝুঁকি না নিয়ে ছেলের এখানকার  সংসারের পাততাড়ি গুটিয়ে নিজ বাড়িতে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ছেলের  জন্য পাত্রীও ঠিক করেছেন ওখানে।
এটাতো নিশ্চিত তাঁর ছেলে আবার বৌ পাবে, তিনিও বউমা পাবেন।

কিন্তু টোপা গালের মিষ্টি সোনা মেয়ে মাধবীলতা কি সত্যিই আরেকটা মা পাবে? পাবে কি তুলতুলে নরম ছোট্ট ছোট্ট হাত পা নাড়া নতুন কোন বোনকে আপন করে? 
হয়তো পাবে। কিংবা..... 

নিজের ফ্লাটের সামনে ডোরবেলে আঙুল ছোঁয়াতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন নাজমা। কদিনের মায়ায় গড়া সম্পর্কটা সদ্য হারিয়ে ফেলার বাঁধ ভাঙ্গা কষ্টে ঝাপসা দুচোখ মুছতে  খানিকটা  সময়তো লাগবেই।

ফাহমিদা রিআ 
মালিবাগ, ঢাকা