অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
শুকতারা এবং একটি বিচ্ছেদ - সুফিয়া ফারজানা

সুতপার মা মিরা আজ চলে গেছে তার বারো বছরের সংসার ফেলে। সবাই জেনেও গেছে বিষয়টা। এসব কথা জানাজানি হতে তো সময় লাগে না খুব একটা। সুতপা আর সুপ্রভা দুই বোন স্কুল থেকে ফিরে দেখে, বাসার পরিস্থিতি কেমন যেন অন্য রকম। থমথমে, গুমোট একটা পরিবেশ। তাদের বাসা তো এরকম থাকে না কখনও। প্রতিদিন তাদের মা ই নিয়ে আসেন। আজ বাবা গিয়ে আর্লি লীভের দরখাস্ত দিয়ে নিয়ে এসেছেন তাদের। বাবার মুখ গম্ভীর। শুধু বললেন,"আজ বিকালে দিনাজপুর যাবো আমরা। তোদের নানা খুব অসুস্হ।"

সুতপার নানা তো অনেক বছর ধরেই অসুস্থ, প্যারালাইজড। তাদের নানাবাড়ি দিনাজপুর শহরে। দাদুবাড়ি বগুড়ায়। বাবার চাকরিসূত্রে অনেক আগে থেকেই অবশ্য ঢাকায় থাকে তারা। সুতপা আর সুপ্রভার জন্মও ঢাকাতেই। সুতপার বয়স এখন দশ, সুপ্রভার সাত। আজ বাসায় ফিরে তারা তাদের মাকে দেখতে পেল না কোথাও। 

মিরা দিনাজপুরেও যায়নি। কাউকে কিছু না বলে এক কাপড়ে চলে গেছে মিরা। একটি মেসেজ দিয়েছে শুধু রাশেদকে, "আমাকে খুঁজো না। আমি আর ফিরবো না। আমি তোমার যোগ্য নই, কখনও ছিলাম না। সুতপা আর সুপ্রভাকে আমি জন্ম দিয়েছি। কিন্তু ওরা আসলে তোমার সন্তান। তোমার কাছে ভালোই থাকবে ওরা। আমাকে ওদের প্রয়োজন নেই।"

রাশেদ সাথে সাথে ফোন দিয়েছিল মিরাকে। কিন্তু তখন থেকেই মিরার মোবাইল অফ। এরকম অদ্ভুত মেসেজ পেয়ে মাথা ঠিক ছিল না রাশেদের। অফিসে কাউকে কিছু না বলেই বাসায় চলে আসে রাশেদ। বাসার দরজা খোলাই ছিল। কাজের মেয়েটা কাপড় ধুচ্ছিল তখন। আর মা তার নিয়ম অনুযায়ী কোরান শরীফ পরছিলেন তার নিজের ঘরে বসে। মা সংসারের খবর তেমন রাখেন না ইদানীং। ইবাদত-বন্দেগী নিয়েই থাকেন বেশির ভাগ সময়। বয়সও হয়েছে মায়ের, চোখেও দেখেন না ভালো। কিন্তু মিরা নেই, সত্যিই কোথাও নেই। রাশেদ একবার ভেবেছিল, মিরা হয়ত মজা করে এরকম মেসেজ দিয়েছে। কিন্তু না। মা অথবা কাজের মেয়ে জবা কেউই জানে না, মিরা কোথায়। সুপ্রভা আর সুতপাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে মিরা বাসায় ফেরেনি আর। তখন বাজে সকাল এগারোটা। মিরা ওদের নিয়ে স্কুলে যায় সকাল সাড়ে সাতটায়। সাড়ে আটটার মধ্যেই বাসায় ফিরে আসে। স্কুল বাসা থেকে খুব একটা দূরে নয়। কিন্তু আজ ফেরেনি, সত্যি ফেরেনি। কোথায় গেল মিরা?

বেশ কিছুদিন ধরে মিরার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করছিল রাশেদ। মিরা সারা রাত ঘুমায় না। কেমন যেন ছটফট করে। সেদিন রাত তিনটায় বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠে রাশেদ দেখে, মিরা পাশে নেই। বেডরুমের বারান্দায় গিয়ে দেখে, মিরা চুপ করে বেতের মোড়ায় বসে আছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে নিঃশব্দে। রাশেদের উপস্থিতি সে বুঝতেও পারেনি। রাশেদও কথা না বলে চুপচাপ বিছানায় এসে শুয়ে পরে। সারাদিন অফিস করে প্রচন্ড ক্লান্ত ছিল সে। বিছানায় শুয়েই সাথে সাথে ঘুমিয়েও পরে সে আবার। তার সময় হয়নি পরে এই বিষয় নিয়ে আর মিরার সাথে কথা বলার। অবশ্য মনেও ছিল না তার। কাজের ব্যস্ততায় এসব ছোটখাটো বিষয় প্রায়ই ভুলে যেত রাশেদ। পরশু মিরা নতুন এক জোড়া কানের দুল পরেছিল। বার বার জিজ্ঞেস করছিল,"এই, দেখো না, দুলটা কেমন? ছোট খালা গিফট করেছে। আজ ছোট খালা এসেছিল তার অফিস ছুটির পরে।"
    "সুন্দর।" রাশেদ মিরার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিয়েছিল।
    "না দেখেই বললে কেন? তুমি তো তাকাও নাই আমার দিকে।"

রাশেদ একটা জটিল হিসাব করছিল তার ব্যাংক লোনের। এই কথা শুনেও সে অবশ্য তাকায়নি মিরার দিকে। সেই রাতে মিরা বিছানায় এসেছিল রাশেদ ঘুমিয়ে যাওয়ার অনেক পরে। সব মিলে গত কয়েক বছরে সম্পর্কটা কেমন জানি মরে গিয়েছিল তাদের। রাশেদ অবশ্য কোন চেষ্টাও করেনি মৃত সম্পর্কে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে। তাহলে আজ কেন এত শূন্য মনে হচ্ছে সবকিছু? কেন মনে হচ্ছে আজ, এতদিন পরে যে মিরাকে ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না? এত বিচিত্র কেন মানুষের মন?

দিনাজপুরে গিয়ে আরও হতাশ হল রাশেদ। না, মিরা দিনাজপুরেও নেই। দিনাজপুরে তাদের প্রচুর আত্মীয়স্বজনের বাড়ি। কিন্তু কোথাও মিরা নেই। রাশেদ আশা করেছিল, দিনাজপুরেই কোথাও হয়ত মিরা আছে। কোথায় গেল সে তাহলে? তাহলে রাশেদের সন্দেহই কি ঠিক? মিরার স্কুল জীবনের এক বন্ধু আছে, ইকবাল। তার বয়স তিরিশ পেরিয়েছে, মিরার সমবয়সী। এখনও বিয়ে করেনি সে। অনেক দূরে কোন পাহাড়ি এলাকায় আদিবাসীদের একটা স্কুল চালায়। সেখানেই পাহাড়ে তার ঘরবাড়ি। ইকবাল পিতৃ-মাতৃহীন অনাথ ছেলে। তার কোন ভাইবোনও নেই, কোন পিছুটান নেই। একদম মুক্ত জীবন যাপন করে সে। এত বয়সেও বিয়েশাদি করেনি। সে নাকি ছোটবেলা থেকেই মনে মনে ভালবাসতো মিরাকে। মিরাও কি বাসতো? গোপন একটি সম্পর্ক কি ছিল তাদের?

রাশেদের সন্দেহই ঠিক ছিল। মিরা রাশেদের সাথে গভীর অভিমান করে সত্যি সত্যিই তার সাজানো সংসার, ফুলের মত সন্তানদের ছেড়ে শেষ পর্যন্ত ওই ছন্নছাড়া ছেলেটার কাছেই চলে গিয়েছিল। বিয়েও করেছিল সে ইকবালকে। তারপর....তারপর কত কত রাত জেগে আকাশের তারা দেখতো তারা! ইকবাল তাকে চিনিয়ে দিয়েছিল, কোনটা শুকতারা, আর কোনটা সন্ধ্যাতারা। আদিবাসী শিশুদের লেখাপড়া শেখাত ইকবাল। তাদের নাচ শেখাত, গান শেখাত মিরা। রাত জেগে দু'জনে মিলে পড়তো জীবনানন্দ দাশের কবিতা। ক্যাম্প ফায়ার করতো জঙ্গলে। পাখির মাংস আগুনে ঝলসে খেত। স্বপ্নের মত সুন্দর এক জীবন! কিন্তু সেই জীবনও কেন একঘেয়ে হয়ে গেল সময়ের সাথে? 

একবার পেয়ে গেলে সোনার মোহরও নাকি মাটি মনে হয়। মিরারও তাই হল। ক্যাম্প ফায়ারে আর মন বসে না তার। রাত জেগে শুকতারাও দেখে না আর। মন চলে যায় ঢাকায় তার ছোট্ট সাজানো সংসারে, সুপ্রভা আর সুতপার কাছে। বুনো পাহাড়ি ফুলের সুগন্ধে একা বিছানায় ঘুমিয়ে পরে মিরা। বাইরে বসে শুকতারা খোঁজে ইকবাল। এত তাড়াতাড়ি কেন হারিয়ে গেল আকাশের সবগুলো তারা? তারাদের মেলায় শুকতারাটি আর খুঁজে পায় না ইকবাল। ওদিকে মিরা স্বপ্ন দেখে, সুপ্রভা আর সুতপা স্কুলে যাচ্ছে। রাশেদ রেডি হচ্ছে অফিসের জন্য। রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত মিরা। রাশেদ কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, মিরা বুঝতেই পারেনি। রাশেদ বলছে,"আমার লাল টাইটা খুঁজে পাচ্ছি না, মিরা। একটু দেখো না, প্লিজ।" 
স্বপ্নের মাঝেই কেন আজ মিরার মনে হল, ফেলে আসা জীবনটা অনেক বেশি সুন্দর ছিল? রাশেদের লাল টাই খুঁজে দেওয়া শুকতারা খোঁজার চেয়েও অনেক বেশি সুখের ছিল?

সুফিয়া ফারজানা
ঢাকা, বাংলাদেশ