অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
সুখের ছোঁয়া...- ফাহমিদা রিআ

ফিস থেকে জাপানে যাবার বিষয়টা ফাইনাল হতেই মাকে  সেতুর কথা জানালো শাবাব। পাক্কা বছর খানেকের ব্যাপার। সেতুর বাবা যেভাবে তোড়জোড় শুরু করেছেন মেয়ে বিদায়ের, শাবাব ফিরে এসে সেতুকে পাওয়ার ক্ষেত্রে সংশয় থেকেই যায়।
অতএব, একমাত্র ভরসাস্হল মা।  

ছেলের পছন্দে কিছু না বললেও মন থেকে খুশি হন নি রাহেলা। মেয়ের মা নেই,সৎ মায়ের সংসার। এমন সংসারে বড় হওয়া মেয়ের মন মানসিকতা উদার হয় না  বলেই রাহেলার ধারনা ছিলো। কিন্তু একমাত্র ছেলে শাবাব  গোঁ ধরে বসলো,এখনই প্রস্তাব না পাঠালে সেতুর বিয়ে অন্যত্র দিয়ে দিবেন ওর বাবা। 

জল ঘোলা করে সময় ক্ষেপন না করে প্রস্তাব নিয়ে গেলেন রাহেলা। মেয়ে বিদায় করা নিয়ে কথা। সেতুর বাবার আগ্রহের কমতি নেই। আর সৎ মা শেষ মুহূর্তে যাও বা এলেন,সাফ বলে দিলেন---- টাকা পয়সা খরচ করে মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছি, কোন দাবী দাওয়া মানতে পারবো না।
যা বুঝবার বুঝলেন রাহেলা। ভালোবাসাহীন এমন কাঠখোট্টা পরিবেশে মনের পুর্ণ সায় না থাকা সত্বেও সেতুর অনামিকায় আংটিটা পরিয়ে, দিন সাতেকের মাথায় অনাড়ম্বর আয়োজনে  তুলে আানলেন একমাত্র ছেলের বৌ করে।

মাস পাঁচেক পরেই শাবাব উড়াল দিবে।
সেতুকে মায়ের কাছে রেখে যাবে, একটা আলগা স্বস্তি শাবাবের বুকে। সেতুকে হারাবার ভয়টা যেমন থাকলো না,  মায়ের একাকীত্বও ঘুচবে শাবাবকে ছাড়া।
ওদের মা ছেলের সংসারে কাছের আত্মীয় স্বজন তেমন কেউ নেই। দু চারজন যাওবা আছেন, আপন আপন গন্ডিতে ব্যস্ত, অন্যান্য শহরে।

রাহেলা প্রথম থেকেই আশার সলতেটা তেমন পাকালেন না। 
যেমন ঘরকন্না সামলাচ্ছিলেন তেমনি চালাতে থাকলেন। কিন্তু সেতু যেন অনেক আগে থেকেই এ বাড়ির। স্বাচ্ছন্দ্যে, সাবলীলতায় চলাফেরা আর কথাবার্তায় বার বারই বিস্মিত হতে থাকলেন রাহেলা। সবচেয়ে বেশি অবাক হলেন মেয়েটি রাহেলার পিছু ছাড়তে চায় না কোনভাবেই। ওর নিজের ঘরে বিশ্রাম নিতে বললে বলে, মা আপনিও একা এ ঘরে, আমিও ও ঘরে। তারচেয়ে এক ঘরেই বিশ্রাম নেই। কথা বলি।
 -আমার বয়স হচ্ছে কখনও ঘুমাই , কখননো বই পড়ি। তুমি বরং ড্রয়িং রুমে গিয়ে টিভি দেখো, গান শুনো। শাবাব অফিস থেকে ফিরলে ব্যস্ততা বাড়বে। এখন বরং একটু...... 

পিঠ ছড়ানো চুলগুলো হাত খোপায় জড়াতে জড়াতে হাসে সেতু,
 - মা,  এসবইতো করে এসেছি এতটা দিন একাকী সময় কাটাতে।
 -একা কেন? ভাইবোনদের সাথে খুনসুটি, হল্লা করতে না?
দুপাশে মাথা নাড়ে সেতু।  - না মা, আমার ভাইবোনদের অত সময় কোথায়? পড়ালেখা, কোচিং, প্রাইভেট,  সারাক্ষণই মায়ের সাথে   ছুটোছুটি করে যতক্ষন সময় পায় সেই সময়টুকু নষ্ট করতে দেন না, মা ওদের ঘুমের জন্য নির্ধারিত করে দেন।

শাশুড়িমা ওর বলার ভংগি দেখে হাসেন। বলেন,
 -আর তুমি  বুঝি  ফাঁকিবাজি করতে  পড়ালেখায়?
 - না মা, আমার পড়া আমাকেই করতে হতো। প্রাইভেট বা টিউটর কোনটাই ছিল না আমার। মাঝে মাঝে অবশ্য ছুটির দিনে বাবা অংক আর ইংরেজিটা দেখিয়ে দিতেন। শুনেছি খুব ছোট্টবেলায় আমার মা আমাকে হাতে ধরিয়ে লেখা শেখাতেন, ছড়া মুখস্ত করাতেন। মাতো আগেই চলে গেছেন, বড় হওয়ার পর ওসব আমার মনেই পড়ে না। নিজেকে একাই জেনেছি সবসময়।
 -আহারে, তোমার মায়ের চেহারা মনে পড়ে না একটুও?
  -নাহ্, আমার স্মৃতিতে "মা" শব্দটা জেনেছি একটু বড় হয়ে। যেদিন  এক বিকেলে বাবা ঘোমটা মাথায় দেয়া একজনকে  নিয়ে এসে বললেন,
 -সেতু তোর জন্য মা এনেছি।
মা শব্দটার সাথে তখন থেকেই পরিচয় আমার। ডাকাও শুরু। কিন্তু  সাধটা তেমন করে  মিটে নি কোন দিনও।  হয়তো পাশের বাড়ির রানুর পিঠে দোলানো বেনীটার মত মায়ের হাতে নিজের বেনীট গেঁথে পাইনি বলে। আমার কাজিন বকুল আপুর  মত পরীক্ষার সময় পড়ার টেবিলের এক পাশে টুল পেতে  ঢুলু ঢুলু চোখে  মা বসে থাকেন নি বলে। সেতুর গলাটা ধরে আসে আবেগে।

রাহেলার বুকের ভেতরটা কেমন যেন আহা করে ওঠে।
পরক্ষনে মনকে শাসান, মায়ায় জড়িয়ে কাজ নেই। আত্মীয় স্বজন পাড়া পড়শীদের মধ্যে কমতো দেখলেন না। 
পঁচিশ / ত্রিশ বছর ধরে চেনা মা, ক মাসেই  অচেনা হয়ে যায় বৌএর নাকি কান্না আর অভিযোগে। ছেলেগুলো একবারও ভাবে না,তার আবাল্য চেনা মা এমনতো ছিলো না, এমন হতে পারে না। বৌ চোখে নাকে জল ঝরিয়ে কি বললো না বললো আর অমনি বৌ কে নিয়ে হাঁটা দিলো নিজের গড়া সংসারে। আরে বাবা, মা টা যে তোর, একবারও ভাবলি না, দশ মাস গর্ভে ধারন করে, পেলে পুষে বড়টি করলো আর অমনি মায়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলো? মেরে পিটে এত দিনে যখন মানুষ করলো, চাকরীর সুবাদে স্বনির্ভর করলো, জীবনে চলার জন্য সংগিনী এনে দিলো আর দুটো কথা বৌকে বললো কি বল্লো না, সংসারের কাজ কর্ম শিখালো কি শিখালো না কিংবা  শিখাতে গিয়ে এক আধটু আদেশ উপদেশ দিতে গেলেই মা পর হয়ে গেলো? না, না এতটা তিনি সইতে পারবেন না। একেতো বিধবা মানুষ, তারউপর আবার সবেধন ঐ একটিই হাতের লাঠি। বৌ য়ের কারনে শাবাবও যদি এমনটি করে তবে যে তিনি বেঁচে থাকার অক্সিজেনটুকু সংগে সংগেই হারাবেন।  
সাত পাঁচ ভেবে সেতুর সাথে  দূরত্ব রেখেই চলেন রাহেলা, মনকে টেনে ধরেন কোন দূর্বলতা এলেই।

চার মাস পেরিয়ে  গেলো সেতুর এ বাড়িতে আগমনের। পঞ্চম মাস আসতেই শাবাব উড়াল দিলো সময়ানুযায়ী।
সেতুর কোন ভাবান্তর নেই।তেমনি মায়ের আঁচল ধরা হয়েই দিন কাটায়। এর মধ্যে একবারও বাবার বাড়ি যাবার কথা মুখেও আনে নি। বাবা প্রথম প্রথম দু একবার ফোনে খোঁজ নিলেও তেমন করে ডাকেন নি মেয়েকে। 

রাহেলা বিস্ময়ের সাথে খেয়াল করেন, মা না হয় নিজের নয়, কিন্তু বাবারও কি মনে পড়ে না? বিয়ে দিতে পেরেই কি  মায়া মমতার সবটুকু দায় থেকে নিষ্কৃতি নিয়েছেন?  মা মরা মেয়ের ভাগ্যে কি বাবার আদরটুকুও জোটে না?
এ  ক' মাসে যতটুকু দেখলেন, মেয়েটা কেমন যেন ভালোবাসার কাঙাল।  আবার ছেলেমানুষি ভাবটাও আছে।
মাঝে মাঝে শাবাবের সাথে মতের অমিল হলেই এক ছুটে রাহেলার মতামত যাঁচাই করতে আসতো। আর মিলে গেলে সে কি উচ্ছ্বাস। রাহেলাও অবাক হয়ে দেখেন, সত্যিইতো সেতুর মতের সাথেই রাহেলার মতটা মিলে যায়। সেতুটা আসলে তাঁর মতই।

নিজের অজান্তেই একটু একটু করে সেতুর মায়ায় জড়াতে থাকেন রাহেলা। কিন্তু বুঝতে দেন না । যদি সত্যি সত্যি এই পরের মেয়েটার প্রতি তিনি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন,তারপর যদি তাকে মাড়িয়ে সেতু চলে যায় একক সংসারে,  তবে...... তবে যে তার নরম হৃদয়ে আঘাত সইবার মত কোন জায়গাই থাকবে না।

তবু গড়াচ্ছিলো দিন মন্দ না। মায়ের আর সেতুর অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়েও আসছিলো এক এক করে।
হঠাৎ সেদিন মাঝ রাতে মার গোঙানিতে ঘুম ভেঙে গেলো সেতুর। ডিম লাইটের আবছা আলোতে মার মুখের দিকে চাইতেই আৎকে ওঠলো সেতু। প্রচন্ড পেটের ব্যাথায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন মা। 

সেতু প্রথমটায় ঘাবড়ে গেলেও কজন প্রতিবেশির সেইভ করা নাম্বারে কল দিতে দিতে একজনকে পেয়ে যেতেই  উনার সাহায়তায়  সে রাতেই এম্বুলেন্স ডেকে  ক্লিনিকে নিয়ে এলো মাকে।
দুটো দিন  ধরে চললো ছুটোছুটি। আলট্রাসনো, এ টেস্ট, ওটেস্ট শেষে চটজলদি মায়ের মেজর অপারেশনটার সিদ্ধান্ত  নিয়ে ফেললো সেতু, শাবাবের সাথে ফোনে আলাপ করে।

সিস্টার দুজন রাহেলাকে কেবিনে  দেয়ার পর ব্যাথার  ঘোরে মা  থেমে থেমে কাতর কন্ঠে বলে চলেছেন অজস্র কথা। দুচোখে ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে পরম যত্নে কপাল হাত ছুঁইয়ে  জেগে রইলো সেতু সারাটা রাত মায়ের শিয়রে। এক দুই তিন দিনের দিন স্বাভাবিক  চোখ মেলে  ডাকলেন মা,
-শাবাব
সেতু ভাবলো, মা হয়তো ঘোরের মাঝে তাকে চিনতে পারছেন না।  কানের কাছে মুখ নিয়ে ধীরে ধীরে বললো সেতু
 - মা, শাবাবতো ট্রেনিং এ, এইতো কটাদিন পরেই এসে যাবে। 
মা মাথা নাড়লেন,ক্ষীন কন্ঠে বললেন,
 - শাবাব  ফোন করেছিলো?
 -জ্বি মা করেছিলো। আপনার খবরাখবর নেয় প্রতিবেলায়।
 -একটা কল দাওতো ওকে।
সেতু বার কয়েক চেষ্টার পরও পেলো না। ছোট্ট একটা মেসেজ দিয়ে রেখে দিলো। খানিকপর কল করলো শাবাব নিজেই। 
 - আমি মিটিং  এ ছিলাম তাই ফোন সাইলেন্ট ছিলো।   মা ভালোতো? 
 -মা নিজেই তোমার সাথে কথা বলার জন্য কল দিতে বলেছেন। এই নাও, নিজেই শোনো- মা কেমন আছেন?
মার বেডের একপাশে মোবাইলটা রেখে স্পিকারটা অন করে দেয় সেতু। ও পাশ থেকে ব্যস্ত ত্রস্ত কন্ঠে রাজ্যের ব্যকুলতা ঝরিয়ে ডাকে শাবাব, - মা আ আ আ আ আ....
ক্ষীন কন্ঠে মৃদু শব্দ তুলে মা জবাব দেন,
 - বাপ আমার,  এইতো ভালো আছি আমি। অত ভাবিস না। সুষ্ঠুভাবে কাজ সেরে ফিরে আয়। 
এই মায়বতী যে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে রে। ওকে রেখে চলে যাওয়ার সাধ্য কি আমার আছে?
 - মা, তুমি মনোবল রেখো। ভেঙ্গে পড়ো না একটুও।
 - তুই একটুও ভাবিস না বাবা। আমাকেতো সুস্হ হতেই হবে। আমার যে অনেক কাজ বাকি। মেয়েটা কতকাল পরে মা পেয়েছে, ওর  চুলে বেনী গেঁথে দিতে হবে যে, ভাবছি এবার  বিসি এস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে বলবো, ফাঁকি  দেবার উপায় নেই। ওর  পড়ার টেবিলের কাছে আমি ঠিক পাহারা দিবো টুলে বসে। 
পাশে দাঁড়িয়ে আবেশিত হয় সেতু অপ্রত্যাশিত আনন্দে। নিজেকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় ডেকে ওঠে,
 - মা,  দূর্বল শরীরে এত কথা নাই বা বল্লেন আজ....
কথা শেষ হয় না। রাহেলার বাড়ানো হাতে নিজেকে এলিয়ে দেয় সেতু। সুখের   কান্নায় ভিজে চলে মা মেয়ে। বেডের একপাশে পড়ে থাকে মোবাইলটা। অন হয়ে থাকা  স্পিকারে এ সুখের ছোঁয়া ঠিক পৌঁছে যায় বুহু দূর দূরান্তে থাকা শাবাবের হৃদয়েও।

ফাহমিদা রিআ
মালিবাগ, ঢাকা