অটোয়া, বুধবার ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫
নতুন করে - ফাহমিদা রিআ

ড় বৌ  ফাঁকা ট্রে হাতে ঢুকলো ঘরে। সেন্টার টেবিলে রাখা পরিত্যাক্ত চায়ের কাপগুলি ট্রেতে তুলে নিরবেই বেরিয়ে গেলো।

বিকেল থেকেই আজ এ বাড়ির ড্রয়িং রুমে জনসমাগম। বলতে গেলে নিজেদেরই মিলনমেলা, শাশুড়ি মার চার ছেলে, ছেলে বৌ আর গোটা পাঁচেক নাতি নাতনিরা। বাইরের লোক বলতে দুজন। একটা নাম করা কোম্পানির আগতদের সাথে  এই ঘরোয়া মিটিং।  তাই  কাজের বুয়ারাও  কথোপকথোনে প্রবশাধিকার পায় নি।

কাগজে কলমে সবকিছু পাকাপোক্ত হবার পর ফাইল পত্র বেঁধে ভদ্রলোক দুজন ব্রিফকেস এঁটে চলে গেলেন হাসতে হাসতে।

এবার ঘরের বাকি সোফাগুলোতে আর ডাইনিং এর চেয়ার টেনে বসলো চার বৌ।

বড়, মেজো, সেজো আর ছোট  সব ভাইরা মিলে তখন হুমড়ি খেয়ে কাগজের অন্য কপিগুলো দেখতে ব্যস্ত হলো।
সেজো বউ  জানান দিল সেজো খোকাকে,
- দেখলে কত  দেরির কাজ এগুলো। এ জন্যইতো ছুটির সন্ধ্যেটা বেছে নিতে বলেছিলাম। 

ছোট বৌ সোফায় গা এলিয়ে আয়েশি হাই তুলতে তুলতে বললো,
- ছুটির দিন না হলেতো আমার পক্ষে আসা সম্ভবই ছিল না।
ছোট ছেলে মাথা নেড়ে সায় দিলো,
- যাই হোক ভালয় ভালয় সব সমাধান হয়ে গেলো, কি বলো বড় ভাই?
বড় জন  মাথা নাড়িয়ে বললো,
- হুম তাই।

হঠাৎ  সামনে বসা মায়ের দিকে চোখ পড়াতে মাকে লক্ষ্য  করে বলে সেজো,
- তুমিতো সারাটা জীবন ঘরের কোনেই রইলে মা।এই সুযোগে একটু ঘুরে নাও এখন।
মা দৃষ্টিটা স্হির রেখেই বললেন,
- এই বাড়িটাকে গড়তেই ঘরের কোনে থাকতে হয়েছে, আবার এ বাড়িটাকে ভাঙ্গতেই ঘরের বাহির হতে হবে। নিয়তি।
সেজো ছেলে  হই হই করে ওঠলো,
- এভাবে নিচ্ছো কেন মা তুমি? আগের মত কি আছে আর? এখন লোকসংখ্যা দ্বিগুন, বাড়ি বাড়াতে হবে না?  বাবাতো আর চার ছেলের জন্য  চারটে বাড়ি রেখে যান নি যে একেক ভাই একেক বাড়িতে নিজ নিজ সংসার নিয়ে ওঠবো।

- তাই বুঝি চার দুগুনে আটটা ফ্লাটের হিসেব নিকেশ সুষ্ঠু ভাবেই সম্পন্ন করলে তোমরা মাকে বাদ দিয়েই।
বড় বৌয়ের কথায় সবাই একটু চমকে ওঠলো যেন।
চার ভাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করে একটুখানি চুপ হয়ে রইলো, কোন কথাই যেন জোগালো না কারো মুখে।
বড় বৌ আবার বললেন,
- জানি তোমাদের অনেক ব্যস্ততা। আমার এত কথা শোনার সময়  তোমাদের নেই। তবুও বলবো,  রান্না হয়ে গেছে। ওদের দাদীমার  সাথে বাচ্চারা দুটো ডালভাত খাবে। সবকিছুতো টুকরো হয়েই যাচ্ছে। ওরা আর এমনটা চাইলেও পাবে না হয়তো কখনই।
ছোট বৌ একটু নড়ে চড়ে বসলো। গলাটা পরিস্কারও করে নিলো কেশে, বললো
- বড় ভাবী, কি যেন বলছিলে? সবার দুটো করে ফ্লাট , মা  কেন বাদ পড়লো তাইতো ?
একবার ভাবোতো, মার এখন সেই বয়স কি আছে একা একা ফ্লাটে থাকার? তার ' চে এইতো ভালো, মা ঘুরে ফিরে চার ছেলের বাড়ি বেড়িয়ে সময় কাটিয়ে দিবেন ধর্ম কর্ম করে।

বড় ছেলে কিছু একটা বলতে চাইছিলো, মা হাত ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললেন,
- বেশ তাই হবে।ছোট বৌ ঠিকই বলেছে। বাড়ি ভাঙ্গার আগ পর্যন্ততো তোমরা চার ভাই চার ভাড়া বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে। চার বছরের চুক্তি অনুযায়ী বছরে তিনবার করে মাকে ভাগ করবে। অবশ্য  ততদিন যদি হায়াত থাকে।
ছোট বৌ, সেজ বৌ তো শুরু থেকেই আলাদা বাড়িতে আছো তোমাদের তেমন ভাবনা নেই। বড় আর মেজোও খুঁজে নেবে।  তার আগে কি তোমরা আমাকে বলবে, যেমন সমান করে ভাগ বাটোয়ারা করলে তোমাদের অধিকারের তেমনি সমান আদর যত্নে আমায় রাখবে তোমরা? গতবার বড় বৌমা যখন তার বাবার অসুস্হতার সংবাদে মাস খানেক আসতে পারলো না, মেজ বৌমার  হঠাৎ  জরুরী অপারেশনে ক্লিনিকে ভর্তি হতে হলো। তখন সেজো খোকা জোর করে তার বাসায় নিয়ে গেলো আমাকে।  সেজ বৌমার সেকি হিমশিম অবস্হা। ছেলের প্রাইভেট টিউটর, মেয়ের গানের শিক্ষক একসাথে এলে সেকি পেরেশানি। হবে নাইবা কেন। একটা ঘর জুড়েতো আমি।
টিউটরিয়ালে নাম্বারও কম পেলো ওরা সে সপ্তাহের।
ভাবলাম বাকি সপ্তাহটা ছোটর কাছেই যাই।

সেখানে ছোট্ট দাদুভাই।  বড্ড পাতলা ঘুম তার। ডাইনিং এ একটু শব্দ করে গ্লাসটা রাখলেই হয়েছে। জানালা খুলতে বা বন্ধ করতে গিয়ে শব্দ হলো কি হলো না, আমার দাদুভাইয়ের তারস্বরে চিৎকার। ওর ঘুমের সময়  টিভি দেখা বা মোবাইলে কথা বললেতো পাড়া মাথায় করে বসে। ছোট বৌমার নাস্তানাবুদ অবস্হা। মেজাজ তিরিক্ষি তো হতেই পারে।

ফিরলাম  স্বামীর ভিটেয়।  ততদিনে বড় বৌমা শোক সামলে ফিরে এলো, মেজ বৌমাও ফিরলো দুর্বল শরীর নিয়ে। 
আমার বুকে আছড়ে পড়ে কি কান্না মেজোর। একটা ফোনও কেন করিনি। বড়ও তাই।

আমি  জবাব দিতে পারি নি কারো অভিমানের।  কি করে বলবো তোমাদের কেউই যে আমার পাশে ছিলে না,  যেমন ঘুরঘুর করো আমাকে খাওয়ানোর জন্য তেমন ব্যতিব্যস্তও হও  আমার মোবাইলটাকে  চার্জ দিয়ে, নির্দিষ্ট মিনিট করে ওটা পেট ভরিয়ে রাখার জন্য। 
তোমাদের ছাড়া ওসব কি আমি কখনও করেছি নাকি পারি?  তোমরা ছাড়া ওসব করবেই বা কে? সেদিন  বৌমারা আমার না বলা কথা হয়তো বুঝেছিল, তাই  অভিমান করে নি কেউই।

একটা কথা আছে না, "হোম হোম সুইট হোম"। আহ্ কি শান্তি।  সেই যে তেরো বছর বয়সে এক হাত ঘোমটা মুড়ি দিয়ে এই শ্বশুরের ভিটেয় এসেছিলাম স্বামীর পিছে পিছে, ভেবেছিলাম শেষ জীবনটা এই সুইট হোমেই কাটিয়ে দেবো।
আজ যখন  ভাগ বাটোয়ারার প্রয়োজনে একসাথে সবাইকে পেয়েছি তখন বলবো,  নয়তো এমন সুযোগ আর নাও পেতে পারি।

সেজো ছেলে তার চেয়ার ছেড়ে মার পাশটিতে বিছানায় এসে বসলো,
- মা, তুমি কি ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজি হয়েছো? তুমি কি চাও না তোমার ছেলেরা একসাথে একই ঠিকানায় থাকুক?  এই যে ছোটো আর আমি পৈতৃক ভিটা ছেড়ে মাসে মাসে ভাড়ার টাকা গুনছি, সেতো এ বাড়িতে স্হান সংকুলান হয় না বলেই। তা বলেতো আজীবন এমনটা চলতে দেয়া যায় না।

মা ঠোঁটের কোনে  কিঞ্চিৎ  বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বললেন,
- তোরা একসাথে থাকবি এ চাওয়াতো আমার চিরদিনের।তোর আর ছোট খোকার ঘরতো এখনও খালি পড়ে আছে রে।  তোর বাবা  গ্রামের সব  ফসলি জমিগুলো বিক্রি করে এই বাড়িটিকে বিশাল করে বানিয়েছিলো, তোদের ভাবিষ্যতের কথা মনে করেই।বিয়ের কিছুদিন পরেই তোরা ভাড়া বাসায় চলে গেলি বৌমাদের কর্তব্য কাজ নিয়ে মনোমালিন্যতায়। তখন আমার নাতি নাতনিদের কারোতো জন্ম হয়নি।  স্হান সংকুলানের কথা আসছে কেন? 

সেজো এবার আমতা আমতা করে বললো,
- শুধু ঘর হলেইতো হয় না মা। 

মা বলে চলেন,
- তোর দাদার ভিটায় তোর বাবা চাচারা ছয় ভাই একসাথে থেকে সন্তান সন্ততিদের বড় করেছে। পরবর্তীতে যে যে পেরেছে আপন রোজগেরে টাকায় আপন আপন বাড়ি করেছে।

সেজো খোকা কথার মাঝেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে,
- সেই সামর্থ্যটা নেই বলেইতো এখানে সময় ক্ষেপন করতে এসেছি।

ছোট বৌও গলা উঁচিয়ে বলে ওঠে,
- পারলেও দাবী ছেড়ে দেবো নাকি? এটা আমাদের প্রত্যেকের অধিকার।
স্বল্পভাষী মেজো বৌ বলে ওঠে এতক্ষণে
- শুধু শ্বশুরবাড়ি? শাশুড়ি নয়? 

ওঠে দাঁড়ান মা এবার।
- থাক,সেজো। অকেজো আর ফেলনা সম্পদ কুড়িয়ে নেবার দায় কারো কাঁধেই পড়বে না। চলো সবাই ডাইনিং  এ  বাচ্চারা হল্লা করছে ক্ষিধেয় অস্হির হয়ে। শুধু সবাই নিশ্চিন্ত হও, আমি কারো দু ফ্লাটের বাড়তি বোঝা হবো না।  অনেক আগেই আমার ব্যবস্হা করে ফেলেছি বলেই তোমাদের বাড়ি ভাঙ্গার প্রস্তাবে আমি ভেঙ্গে  পড়িনি। 

বড় বৌ খাবার টেবিলের দিকে যেতে যেতে কান্না ধরা কন্ঠে বললো,
- মা ঠিকানাটা আমাদেরও জানা উচিত। আমাদের  সন্তানদেরওতো একদিন বাবা মার প্রয়োজন ফুরোবে।  অতিরিক্ত হয়ে ঠাঁই খুঁজতে হবে আমাদেরও। বারেবারে  নতুন করে ঘুরবে এ চাকা, চালু যখন হয়েই গেলো।

মা বিষন্নতার হাসি ছুঁড়ে  দিয়ে বললেন
-প্রয়োজন  হয়তো ফুরোবে, হয়তো ফুরোবেও না। জগত সংসারে বড় বৌ,  মেজ বৌ রাও থাকবে যে।

বড় বৌ কিংবা মেজ বৌ এর জবাবটা আর শোনা হলো না মায়ের। ডাইনিং রুমের চেয়ারটায় ততক্ষনে বসে পড়েছেন মা বাচ্চাদের হট্টগোলের মাঝে।

ফাহমিদা রিআ
মালিবাগ, ঢাকা