অটোয়া, বৃহস্পতিবার ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪
'অসাম্প্রদায়িক বাঙালি পদক' এ ভূষিত হলেন লেখক শাহাদাত রাসএল ও বুকল্যান্ডস পাবলিকেশন -ফারজানা নাজ শম্পা

বাঙালির অন্যতম পরিচয় তিনি বাঙালি। জাতি ধর্ম বা বর্ণ ভিত্তিক যেকোন মাত্রার বিভাজন তাঁদের এই পরিচয়ের শুদ্ধমাত্রাকে ম্লান করে দেয়। বাঙালি র ঐতিহ্য ও সংষ্কৃতির  ধারায় বাংলার শুদ্ধ আদর্শ কে ধারণ করে নিরলসভাবে যারা কাজ করছেন বর্তমান সময়ের তেমন একজন আলোকিত আর অমায়িক ব্যক্তিত্বের নাম শাহাদাত রাসএল।তিনি বাংলাদেশের একজন লেখক ও জীবনধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাতা।বাংলাদেশের স্কুল পর্যারের বাচ্চাদের পাঠ্যক্রমে বাংলা বর্ণ মালা  শিক্ষার ক্ষেত্রে যেকোন অসাম্প্রদায়িক  চরিত্র  হননের বিরুদ্ধে তিনি এক সাংষ্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। সেই আদর্শ থেকে বাংলার আবহমান সংষ্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ষাটজন  গুণী ও আলোকিত ব্যক্তিত্বের নামের আদ্যাক্ষরের সাথে বাংলা ভাষার বর্ণমালার সমন্বয় ঘটিয়ে  তিনি ভিন্নধর্মী ‘বর্ণ  বর্ণে বাঙালি ' এই গ্রন্থ রচনা করেছেন। কোন বাণিজ্যিক প্রলোভনে নয় বরং লেখক  গ্রন্থটি রচনা করেছেন একটি নির্দিষ্ট  আদর্শবোধ থেকে। আবহমানকাল ধরে বিকশিত বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ ইতিহাস ঐতিহ্যকে নিরপেক্ষ ও সঠিকভাবে নুতন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করার  মানবিক দায়বদ্ধতা সেই আদর্শ।

অতি সম্প্রতি তাঁর তথ্যবহুল এই গ্রন্থটির জন্য লেখক ও গ্রন্থটির প্রকাশনা বাংলাদেশের 'বুকল্যান্ডস  পাবলিকেশন 'যৌথ ভাবে স্বীকৃত ও সম্মানিত হয়। এই বিশেষ পুরুস্কার টি হলো 'অসাম্প্রদায়িক বাঙালি পদক।' এই বুকল্যান্ডস  প্রকাশনার প্ৰকাশক ও কর্ণধার  জনাব রাকিবুল হাসান নিজেও একজন মুক্ত চিন্তার ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে  বিশ্বাসী মানুষ। 

 'অসাম্প্রদায়িক বাঙালি পদক' এই বিশেষ পুরস্কারটি  সম্প্রতি আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসি'তে সমাপ্ত বইমেলার  (২২ শে ও ২৩ শে জুন ) এক অনুষ্ঠানে  প্রদান করা হয় । এই বইমেলার আয়োজক সংগঠনটি হলো 'আমরা বাঙালি ফাউন্ডেশন।'এই সংগঠনটি আর একই সাথে জামার্নির একটি সংগঠন  'বাংলাদেশ সেকুলার ফাউন্ডেশন 'এর যৌথ উদ্যোগে লেখক ও প্রকাশককে এই গ্রন্থটির জন্য  বিশেষ পুরস্কারে  ভূষিত করা হয় ।

এই  পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে অন্যান্য বক্তাদের সাথে  আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রাবন্ধিক,চিন্তাবিদ এবং  ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও  বিভ্রান্তি অপসারণের পক্ষে এক অকুতোভয় ব্যাক্তিত্ব  জনাব হাসান মাহমুদও বক্তব্য রাখেন। পুরস্কার প্রদান প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্যে তিনি জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আবহমান কাল ধরে বাংলার মাটিতে অসাম্প্রাদায়িক এক সমাজ  প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার দিকটা উল্লেখ করে শাহাদাত রাসেলের চিন্তার ফসল সমৃদ্ধ এই গ্রন্থটির বিষয় আলোচনা করেন। তিনি  অভিমত দেন যে গ্রন্থটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত মূল্যবোধ কে সমুন্নত করেছে।উল্লেখ্য যে  এই গ্রন্থটির পুরস্কার ও স্বীকৃতির প্রয়াসটি জনাব হাসান মাহমুদের একান্ত নিরলস উদ্যোগে বিশেষভাবে ত্বরান্বিত হয়।এইভাবে শাহাদাত রাসেএলের  গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তার দিকটা  তিনি আন্তর্জাতিক দরবারে তুলে ধরেন। জনাব হাসান মাহমুদ একাধারে এই বইমেলা কমিটি ও বাংলাদেশ সেকুলার ফাউন্ডেশনের  সম্মানিত উপদেষ্টা। 

পুরস্কার প্রদানের এই বিশেষ আয়োজনে প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও নিউজার্সির প্লেইনসবোরো টাউনশিপ থেকে নির্বাচিত কাউন্সিলম্যান ড. নুরুন নবী লেখক শাহাদাত রাসেএল র  অনুপস্হিতিতে বইমেলার প্রধান সমন্বয়ক সামিনা আমিনের হাতে এই  পদকটি তুলে দেন। 'আমরা বাঙালি ফাউন্ডেশন’ এই পদকের ক্রেস্টের অর্থায়ন করেছে এবং জার্মানির ‘বাংলাদেশ সেকুলার ফাউন্ডেশন’ একটি টোকেন অর্থ-সম্মানীর ব্যবস্থা করেছে।

এই বইমেলায় বিশিষ্ট সাংবাদিক ইকবাল বাহার চৌধুরী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী, সাংবাদিক ও প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, ভয়েস অব আমেরিকার রোকেয়া হায়দার, সরকার কবির উদ্দিন ও আনিস আহমেদ, কবি সৈয়দ আল ফারুক, কবি হুমায়ুন ঢালীসহ  ওয়াশিংটন ডিসি, মেরিল্যান্ড ও ভার্জিনিয়ার অধিবাসী অনেক  প্রবাসী বাঙালি এই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন।

গত ৬-৭ ই জুলাই কানাডার  টরেন্টো তে অনুষ্ঠিত তেরো তম বাংলা বইমেলায় 'বর্ণে বর্ণে বাঙালি’ বইয়ের ওপর একটি বিশেষ স্লাইড ডকুমেন্টরি উপস্থাপনায়  আলোচক হাসান মাহমুদ সেই  প্রসংগে জানান ‘বাচ্চাদের স্কুল সিলেবাসের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র-হননের ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি প্রধান উদ্দেশ্য অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়া থেকে আমরা বিচ্যুত হয়েছি।’ পাকিস্তানের একটি উদাহরণ টেনে তিনি জানান  , সেখানের  স্কুল সিলেবাস বদলে দেওয়ায় ফলে আজ পুরো জাতি বিশ্বাস করে ভারতের মুসলিমেরা সংগ্রাম করে পাকিস্তান অর্জন করেছিল এবং একাত্তরে যুদ্ধ হয়েছিল ভারত পাকিস্তানের মধ্যে,অথচ যার দুটোই ডাহা মিথ্যা। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ছিল ওই অঞ্চলের সিংহভাগ মুসলিম, বাঙালিদের সমর্থনেই মুসলিম লীগ পাকিস্তান অর্জন করতে পেরেছিল। এই আলোচনায় বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য কবি আসাদ চৌধুরীও সিলেবাসের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র-হননের বিরুদ্ধে এই আলোচনায় জোরালো বক্তব্য প্রদান করেন।

টরেন্টো  বাংলা বইমেলার উদ্বোধন  করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শ্রদ্ধাভাজন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। টরেন্টো বাংলা বইমেলায়  উপস্থিত ছিলেন সকলের শ্রদ্ধাভাজন বরেণ্য কবি আসাদ চৌধুরী, কবি দিলারা হাফিজ,  লেখক হুমায়ূন কবীর ঢালী, কবি হাসানাল আবদুল্লাহ, শেলী জামান খান, সালমা বাণী প্রমুখ । এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত  কথা সাহিত্যিক ও প্ৰকাশনা। অনন্যার মনিরুল হক, সন্দেশ প্রকাশনীর লুৎফর রহমান চৌধুরী, লেখক ও প্রাবন্ধিক হাসান মাহমুদ, লেখক জসিম মল্লিকসহ টরন্টোবাসী প্রখ্যাত লেখক, কবি, শিল্পী ও সাংবাদিকেরা।টরেন্টো বাংলা বইমেলার আহ্বায়ক হলেন শ্রদ্ধাভাজন  জনাব সাদী আহমদ ও আয়োজক ছিল  'অন্যমেলা।'

শাহাদাত  রাসেএল এর  এই প্রকাশনা ও তাঁর কর্মময় জীবন সম্বন্ধে  'কানাডিয়ান বাংলাদেশি  নিউজ'   ইতিপূর্বে  তাঁকে নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছেন।  এছাড়াও  বাংলাদেশের একটি চ্যানেলে প্রচার মাধ্যমে  তাঁর একটি সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়েছে।এই বিশেষ পুরস্কার প্রাপ্তি তে  ব্যক্তিগত অনুভূতি ব্যক্ত করার জন্য লেখক শাহাদাত  রাসএল কে সরাসরি  কয়েকটি প্রশ্ন করা হয় । তিনি উত্তরে জানান যে  'প্রতিটি প্রাপ্তির সম্মানই আনন্দের। আর যেহেতু আমি সাহিত্যিক নই। কিন্তু ভালোবেসে মানবিক আদর্শ থেকে সামান্যই লিখি। সেখানে এই সম্মান প্রাপ্তিটা আমাকে যেমন অবাক করেছে একাধারে তেমনি ভীষণ উচ্ছ্বসিত ও  করেছে। ;অসাম্প্রদায়িক বাঙালি পদক' শিশুদের জন্য আরো কিছু কাজ করার একটা তাগিদ তৈরি করেছে আমার মধ্যে। আমাকে এই সম্মাননা দেয়ায় আমি আন্তরিক  কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমার অভিভাবক স্থানীয় শ্রদ্ধেয় প্রাবন্ধিক ও লেখক হাসান মাহমুদ ও কবি সামিনা আমিন'এর কাছে। 

 'বর্ণে বর্ণে বাঙালি' গ্রন্থটির মুল আদর্শ প্রসঙ্গে  তিনি জানান ,' আসলে বাংলাদেশের চলমান শিক্ষানীতির ভেতরেই অনেকাংশেই ভয়াবহভাবে ঢুকে যাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার  বিষ। পরিকল্পিতভাবে এবং ক্ষমতার পালা বদলে ভোটের রাজনীতিই যেখানে শেষ কথা সেখানে রাজনৈতিকরা অনেক ক্ষেত্রেই নৈতিকতা বিসর্জন দিয়েছে অনেক আগের থেকেই । আমি এই ভাবনা থেকেই চেষ্টা করেছি যে আমাদের আগামীর বাংলাদেশ যারা পরিচালনা করবে আজকের সেই শিশুটি  মহান বাঙালিদের সম্পর্কে জেনে বেড়ে উঠুক। এইভাবে মনীষীর কর্ম ,জীবনদর্শন যা আমাদের শিশুদের চিন্তা চেতনার সঠিক বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। 
 শাহাদাত  রাসএল তাঁর  চলচ্চিত্র বিষয়ক  ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কি সেই প্রসঙ্গে  জানান যে ' আমি ভীষণ সীমিত সাধ্যের একজন মানুষ। তবে আমার সাধ্যের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে এমন কিছু কাজ করতে চাই যা আমাদের বাংলাদেশ তথা দুনিয়ার সকল মানুষের জন্য আরেকটু মানবিক ও নিরাপদ একটা পৃথিবী গড়তে বিশেষ প্রভাব রাখবে। অন্তত আমাদেরকে অনেক বেশি মানবিকভাবে  চিন্তা করতে সাহায্য করবে। দেখুন দিনশেষে ধর্ম নয়, বর্ণ নয়, দেশ নয়... দিনশেষে মানুষই সত্য। প্রতিটি মানুষের অধিকার রয়েছে একটা নিরাপদ জীবন পাবার। আমি সেই লক্ষেই আমার চলচ্চিত্র ও আমার লেখালেখি চালিয়ে যেতে চাই।'

তিনি আরো বলেন  'একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আমার বরাবরই পছন্দ সেইসব বিষয় বা কন্সেপ্ট যা মানুষের অধিকারের বা সংকটের কথা বলে। যদিও আমার চলচ্চিত্র নির্মাণের বর্তমান অবস্থানকে আমি একেবারেই আমার শুরু হিসেবে মনে করি৷ তবে আমার নির্মিত 'কালার অফ চাইল্ডহুড' ও 'ডেফিনিশন অফ পলিটিক্স' ফিল্মের জন্য আমেরিকার আটলান্টাতে '১৭তম আর্বান মিডিয়ামেকার ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা চলচ্চিত্রের এওয়ার্ড, ভারতের পুনে ইন্টারন্যাশনাল শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি সেরা চিত্রনাট্য এওয়ার্ড, কলকাতার ডিজিটাল ওয়ান্ডারল্যান্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে  'সেরা চলচ্চিত্রের এওয়ার্ড এর পাশাপাশি আরো বেশ কিছু সম্মানজনক এওয়ার্ড পেয়েছি। সাম্প্রতি শেষ করলাম 'দ্যা রিভার' নামে যুদ্ধ বিরোধী একটা চলচ্চিত্রের কাজ। আন্তর্জাতিক বর্ডার সিস্টেমের কাটাতার যে মানবিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেই বিষয়কে কেন্দ্র করে একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করছি এখন'।

বাংলাদেশের ও বাঙালির দেশাত্ববোধের,প্রকৃত ইতিহাসের শিকড় সন্ধানী ,কৃষ্টির সঠিক চেতনা ও মানবিক আদর্শবোধের শিক্ষায় লালিত এই  আলোকিত ব্যক্তিত্ব শাহাদাত রাসএল র  সফল অগ্রযাত্রার প্রত্যাশায় রইলো আমাদের অনাবিল শুভকামনা।

ফারজানা নাজ শম্পা 
লেখক,অনুবাদক ও সংবাদ প্রতিনিধি 
হ্যালিফ্যাক্স কানাডা
abraraafi@yahoo.ca