অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
আশ্চর্য মানুষ - মনজুর অপি

বীন্দ্রনাথ তার ৮১ তম  জন্মদিনে ‘সভ্যতার সংকট’ নামের প্রবন্ধে লিখলেন, “জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলম  ইউরোপ এর অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে।  আর আজ আমার সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল। আজ আশা করে আছি, পরিত্রানকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র লালিত কুঠির এর মধ্যে, অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈব বাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্ব দিগন্ত থেকেই”। তিনি লিখলেন, “ঐ মহামানব আসে/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/ মর্ত ধুলির ঘাসেঘাসে/”।  রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মূলত কবি, এই পরিচয়ে তিনি বিশ্বব্যাপী অধিক পরিচিত। আবার তিনি ছিলেন একজন ঋষি পর্যায়ের মানুষ। যারা দিব্য দৃষ্টিতে অনাগত অনেক কিছুই দেখতে পারেন অথবা অনুধাবন  করতে পারেন। যদি এমনটা ভাবা যায় পূর্ব দিগন্তে সেই ত্রানকর্তা হয়ে আবির্ভূত হলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলায় আবির্ভাব হল একজন মহামানবের।

মার্চ মাসকে  মানুষ বলে অগ্নিঝরা মার্চ, এই মাসের ২৬ তারিখে ফুঁসতে থাকা আগ্নেয়গিরির লাভার মত জ্বলে উঠেছিল  বাংলাদেশ। প্রতিরোধের সেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে। আর যে স্ফুলিঙ্গ থেকে সেই আগুনের সূত্রপাত, সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জন্ম নিয়েছিল ১৯২০সালের ১৭ মার্চ। টুঙ্গি পারার এক অজগায়ে জন্ম নিয়েছিলেন ইতিহাসের এই মহানায়ক। জন্মের পর তার দাদা তাকে দেখে বলেছিলেন, এই ছেলে একদিন অনেক বড় কিছু হবে। বাবা তার নাম দিলেন খোকা। তারা জানতেন না এই খোকা কত  বড় হবে। তার শরীর দীর্ঘ হতে হতে আকাশ ছুঁয়ে যাবে। বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন “আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি”। সেই হিমালয়সম মানুষটি অনন্য এক ভালবাসায় যেন তার বলিষ্ঠ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন পুরো দেশটাকে। তার হাত যখন উপরে উঠে তখন গর্জে উঠে সাড়ে সাত কোটি মানুষ। তার সেই অঙ্গুলি হেলনের দোলায় দোলতে থাকে একটি পুরো জাতি। আমরা যারা তাকে  সামনা সামনি কোনদিন দেখিনি তাদের কাছে তার হাত উপরে তোলা, তর্জনী উঠানো সেই ছবিটিই সবচেয়ে পরিচিত। মার্চের ৭ তারিখের সেই বিখ্যাত ছবি। ৭ মার্চ, শেখ মুজিব, বাংলাদেশ, সব যেন একাকার।        

কিশোর বয়সেই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে যোগদান। গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কারণে প্রথম গ্রেফতার। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ ও স্বাধীনতা আন্দোলন। ৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন, ৪৯ সালে আওয়ামী লীগ, ৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ৫৯ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন। তারপর ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণা। ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান। ১৯৭০ সালের নির্বাচন। এ ভাবেই ধাপে ধাপে তিনি জাতিকে নিয়ে যান স্বাধীনতার এক দফায়। আর শেখ মুজিব হয়ে উঠেন বাঙ্গালীর একক নেতা। হয়ে উঠেন বঙ্গবন্ধু। অনন্য এক ভালবাসায়, বিশ্বাসে তিনি জায়গা পেয়ে যান প্রতিটি বাঙ্গালীর হৃদয়ে। ১৯৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে বড় নেতা অনেকেই এসেছেন। এবং অনেকেই বাংলাদেশ প্রশ্নে বিভিন্ন সময়ে আপোষবাদি মতবাদের কারণে পিছিয়ে পড়েছেন। বঙ্গবন্ধুই একমাত্র নেতা যিনি মনে করতেন বাঙ্গালীর জন্য দরকার নিজের স্বাধীন দেশ। প্রথম থেকেই তিনি বুঝেছিলেন পাকিস্তানের সাথে এই পূর্বপাকিস্তান থাকতে পারবেনা। 

পূর্বপাকিস্তানকে স্বাধীন করতে হবে। এবং এই সংকল্পে তিনি ছিলেন সব সময় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সে জন্য তিনি সব ধরনের ঝুকি নিতে প্রস্তুত ছিলেন। ৬৬ সালে যখন তিনি ৬ দফা ঘোষণা করেন, তার আগে বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী  আতাউর রহমান খানের কাছে। আতাউর রাহমান বলেছিলেন, “মুজিব, তুমি আমকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চাও? তুমি  বললে তোমারও ফাঁসি হবে। উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাঙ্গালীর মুক্তির জন্য কাউকে না কাউকে তো ফাঁসির ঝুঁকি নিতে হবে”। এরকম সাহসী একজন মানুষই পারে একটি পরাধীন জাতিকে স্বাধীন দেশ উপহার দিতে। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি ধাপে ধাপে সবাইকে প্রস্তুত করছিলেন প্রতিরোধের জন্য, যুদ্ধের জন্য। বোঝা যায় কি নিখুত ভাবে তিনি একে একে তার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি জানতেন তার করণীয় কি। তার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের, রাজনৈতিক জীবনের একটাই লক্ষ্য ছিল এদেশের মুক্তি। তার সারা জীবন লালন করে যাওয়া স্বপ্নের কথাই তিনি বলেছেন ৭ই মার্চের ভাষণে। এ জন্যই তাৎক্ষণিক একটি ভাষণ এত পরিপূর্ণ এবং এরকম হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল। আমরা সবাই জানি এটি কোন লিখিত ভাষণ ছিল না। তবে তিনি তা লিখে রেখেছিলেন তার হৃদয়ের মাঝে। লেখা ছিল তার শরীরের প্রতিটি রক্তকনায়, ছিল তার স্বপ্নের মাঝে। এবং সে স্বপ্ন সেদিন ছড়িয়ে পড়েছিল প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়ে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন হয়ে গেল সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বপ্ন। সে দিন শেখ মুজিব আর ব্যাক্তিতে থাকলেন না, ছড়িয়ে গেলেন সারা দেশে। অথবা অন্য ভাবে বলা যায়, প্রতিটি বাঙ্গালী হয়ে গেল যেন এক এক জন শেখ মুজিব। তার কাছের মানুষদের কাছ থেকে জানা যায়, সেদিন তিনি বেশ অস্থির ছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন আজ সেই দিন। যে দিনের জন্য তিনি সংগ্রাম করেছেন সারা জীবন। অনেকের সাথে তার সেদিন কথা হয়। দেশি বিদেশি ছাড়াও ছিলেন দেশের ছাত্র নেতাসহ প্রবীণ অনেক রাজনিতিক। সবাই যার যার মত করে বলছেন তাকে কি বলতে হবে, সব মিলিয়ে অস্তির একটি অবস্থা । শেখ হাসিনা তার এক লেখায়  সেদিনের কথা বলছেন  “নিচের অফিসঘর থেকে আব্বা  উপরে দোতালায় এলেন, তখন মা এক কাপ চা লেবুর দু ফুটা রস দিয়ে আব্বার হাতে তুলে দিলেন। বললেন, তুমি এখানে বস, চা খাও। খাবার প্রস্তুত করছি। সময় প্রায় হয়ে এলো। মা টেবিলে খাবার দিলেন। বেশি কিছু আহামরি খাবার নয়, বাঙ্গালীর সাধারণ খাবার। ভর্তা, সবজি, ভাজা মাছ, মাছের ঝোল। খাওয়া শেষ হলে মা সকলকে বললেন, আপনারা  এখন মাঠে চলে যান। আব্বাকে মা ঘরে যেতে বললেন। পাশের ঘরটা শোবার ঘর। আমি আর আব্বা ঘরে গেলে মা বললেন, তুমি একটু বিশ্রাম নাও। আব্বা বিছানায় শুয়ে পড়লেন। আমি আব্বার মাথার কাছে  বসে আব্বার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম, এটা আমার সব সময়ের অভ্যাস।  মা একটা  মোড়া টেনে বসলেন, হাতে পানের বাটা, পান বানিয়ে আব্বার হাতে দিলেন। তারপর তিনি বললেন, দেখো তুমি সারাটা জীবন এদেশের মানুষের  জন্য  সংগ্রাম করেছ, দেশের মানুষের  জন্য কি করতে হবে তা সকলের  চেয়ে তুমিই  ভাল জানো। আজকে যে মানুষ  এসেছে তারা তোমার কথাই শুনতে এসেছে। তোমার কারো কথা শোনার প্রয়োজন নেই, তোমার মনে যে কথা আছে তুমি সেই কথাই বলবে। আর সেই কথাই সঠিক কথা হবে। অন্য কারো কথায় তুমি কান দিবে না। আব্বা কথাগুলো  মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। কিছুক্ষণ চোখ  বন্ধ করে থাকলেন। সভায় যাওয়ার সময় আগত। তিনি প্রস্তুত হয়ে রওনা হলেন।” এ যেন প্রতিটি মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর ঘরের শাশ্বত ছবি। দুপুরের খাবার পর কিছুক্ষণ  বিছানায় শুয়ে থাকা, প্রিয় মানুষের হাতে বানিয়ে দেয়া পান মুখে নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলা, এযেন একেবারে সাধারণ কোন  বাঙ্গালীর ঘর। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন খাটি বাঙ্গালীর  প্রতিরূপ। এরকম অবস্থানে এসেও তার মধ্যে ছিল বাঙ্গালীর শতভাগ বৈশিষ্ট্য। বাঙ্গালীর হাজার বছরের  সব কথাকে মনে ধারণ করেই তিনি সেদিন গিয়েছিলেন রেসকোর্স ময়দানে। তার পরের ইতিহাস সবার জানা। সেদিনের সেই ভাষণ  একটি নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে  পরিণত করেছিল। তার সেই ভাষণ  রচনা করেছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের  বিজয় ইতিহাস। কবি আল মাহমুদ তার “নিশিডাক” কবিতায় লিখলেন  “সে যখন বলে ভাইসব, অমনি অরণ্যের এলোমেলো গাছেরাও সারি বেধে  দাড়িয়ে গেল/  কবিরা কলম ও বন্দুকের পার্থক্য ভুলে হাটতে লাগল খোলা ময়দানে/”।  এ যেন ঘোর লাগা সেই মায়াময় নিশিডাক। যা উপেক্ষা করার ক্ষমতা মানুষের থাকে না। মায়াবী সে আহবানে মানুষ সংসার ত্যাগী হয়, জগতের আনন্দ সুখ তুচ্ছ জ্ঞান করে ঘর ছাড়ে অবলীলায়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ছিল তেমনি এক জাদুকরি আহবান। প্রতিটি বাঙ্গালীর  মনে তখন ঘোর লাগে। তার প্রতিটি কথা শিহরণ জাগায় সবার  মনে। ঘোরলাগা বাংলাদেশ  তখনই  প্রস্তত হয়ে যায়। প্রস্তত হয়ে যায় সবাই মুক্তির জন্য নিজের প্রাণকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। বাতাসে ভর করে সে ডাক  পৌঁছে যায় প্রতি ঘরে। সবাই জেনে যায় ডাক এসে গেছে মুক্তির। ডাক এসেছে স্বাধীনতার। প্রয়াত লেখক মিজান রাহমান তার এক লেখায় সেদিনের কথা বলছেন এভাবে  “একটা জনগোষ্ঠী আপনাআপনিই পূর্ণ জাতি হয়ে উঠে না নিজের একান্ত আপন আত্মপরিচয়ের গৌরবে। তার সম্মুখে একটা বিশেষ যাত্রা পথের মানচিত্র তৈরি করে দিতে হয়, তাকে অনুপ্রাণিত করতে হয় একটা বিশেষ গন্তব্যকে লক্ষ করে  অগ্রসর হতে, হাতে হাত রেখে, পায়ে পা মিলিয়ে, গানে গানে, প্রাণে প্রাণে একাত্ম হয়ে। সেই সোনালি স্বপ্নের দ্বীপটিতে তিনি সেদিন নিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের সবাইকে, পূর্ব বাংলার নিপীড়িত নিগৃহীত আপামর জনসাধারণকে। একটি বক্তৃতার যাদুকরী স্পর্শে একটি শব্দের সম্মোহনী শক্তিবলে। পূর্ণ  জাতিত্বের  পদধ্বনি শুনতে পেরেছিলাম সেদিন। সুতরাং ৭ই মার্চ কেবল একটি  নূতন জাতির জন্ম দিবস নয়, সে জাতির জনকটিরও জন্ম সেই একই  দিনে”। 

বঙ্গবন্ধু ছিলেন আওয়ামীলীগের নেতা। একটি  রাজনৈতিক দলের নেতা সকল মানুষের হয়ে উঠলেন। বাঙালী জাতির ইতিহাসের হয়ে গেলেন মহানায়ক। সেই ৪৮ থেকে শুরু। দুঃসাহসী  ছাত্র নেতা থেকে একজন বলিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মী কিভাবে নিরবিচ্ছিন্ন কর্মের মাধ্যমে, জেল জুলুম সহ্য করে, অক্লান্ত পরিশ্রমের  মাধ্যমে তিনি পৌঁছে যান তার অভীষ্ট লক্ষে। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী ধীরেন্দ্রানাথ দত্ত আনিত বাংলা ভাষার প্রস্তাব পাকিস্তান সরকার  বাতিল করে দেয়। ঢাকায় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ  গঠিত হল। ১১ মার্চ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত  হল। আগের দিন রাতে সংগ্রাম পরিষদের সভায় অনেকেই আপোষ  করতে বলেন সরকারের সাথে। কেবল একটি কণ্ঠ প্রতিবাদের সুরে গর্জে উঠলো। সেই  কণ্ঠ ঘোষণা করলো  আগামীকাল ধর্মঘট হবে, সচিবালয়ের সামনে পিকেটিং হবে। এই প্রতিবাদি কণ্ঠ ছিল শেখ মুজিবের। পরের দিন ১১ মার্চ সচিবালয়ের সামনে  পিকেটিং করার সময়  গ্রেফতার হন শেখ মুজিব। স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে  এটিই তার প্রথম  গ্রেফতার। আর শেষ  গ্রেফতার ২৫ মার্চ ১৯৭১। তার ৫৫ বৎসরের  জীবনে  প্রায় ১৪ বৎসরই তিনি  কাটিয়েছেন  জেলের  ভিতরে। শুধুই  এই জাতির  মুক্তির জন্য তিনি ত্যাগ  করেছেন তার সব আনন্দ এবং সুখ। তার কাছ থেকেই আমরা  প্রথম পাই নতুন একটি  দেশের নাম। ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৯ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু দিবসের  বক্তৃতায় তিনি বলেন, “এক সময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্র  হইতে, মানচিত্রের  পৃষ্ঠা হইতে  ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ  চিহ্ন টুকুও  চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। একমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া  কোন  কিছুর নামের সংগে  ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব  খুজিয়া  পাওয়া  যায় নাই। আমি ঘোষণা করিতেছি আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয়  প্রদেশটির  নাম  হইবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধু বাংলাদেশ”। এভাবেই  বঙ্গবন্ধুর  মুখ থেকে প্রথম উচ্চারিত হল  বাংলাদেশ নামটি।  বাংলার  মানুষ ও বিবেকের কাছে তিনি ছিলেন দায়বদ্ধ। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি পান মানুষকে ভালবাসার অদম্য শক্তি। শুধু মানুষকে  ভালবাসার মধ্যে দিয়েই একজন সাধারণ মানুষ হয়ে ওঠেন  অসাধারণ, হয়ে যান বঙ্গবন্ধু। তাই বিদেশি সাংবাদিক যখন তাকে জিজ্ঞেস করেন, what is your qualification? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, I love my people. সাংবাদিকের আবার প্রশ্ন, what is your disqualification?  বঙ্গবন্ধু উত্তর দেন, I love them too much. 

বাঙালি জাতি তার এই ভালবাসার ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারবে না। ’৭১ সালের ৩রা জানুয়ারি, ’৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের  শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “মোমেন খান আমাকে কাবু করতে পারেনি, এমন কি আইয়ুব খানও পারেনি। কিন্তু আমকে দুর্বল করে দিয়েছে আপনাদের এই অকুণ্ঠ ভালবাসা। আপনারা দোয়া করবেন যেন আপনাদের এই ভালবাসার মর্যাদা দিতে পারি”। বাংলার মানুষের ভালবাসার মর্যাদা তিনি রক্ত দিয়ে পরিশোধ করে গেছেন। এ যেন, “আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন,” ( রবিন্দ্রানাথ)। বাংলার মানুষকে সুখী করার জন্য  তিনি জীবন ভর দুঃখের তপস্যা করে গেছেন।

 ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ, সেদিন ছিল তার ৫২ তম জন্ম দিন। দেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। ইহাইয়া খানের সাথে আলোচনা শেষে গণভবন থেকে তিনি দুপুরে ৩২ নম্বরে তার বাসভবনে এলেন। তখন বিদেশি সাংবাদিকদের সাথে ঘরোয়া আলোচনাকালে এক বিদেশি সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচেয়ে বড় ও পবিত্র বাসনা কি? উত্তরে তিনি বললেন,  “আমি জন্মদিন করিনা, আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এ দেশের মানুষের নিরাপত্তা নাই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে, আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিনই কি আর মৃত্যু দিনই কি? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু। আমিতো আমার জীবন জনগণের জন্য উৎসর্গ  করেছি।”  বাংলার মানুষ সবসময় তাকে নিজেদের মানুষ হিসেবে দেখেছে। নিজেদের আপন একজন বলেই ভেবেছে। তিনি ছিলেনও তাই। বিখ্যাত ব্রিটিশ কলামিস্ট সিরিল ডান যথার্থ বলেছেন, “এই নেতা জনগণকে মন্ত্রমুগ্ধ করার মত বজ্রকন্ঠের অধিকারি (voice of thunder) বক্তা। দীর্ঘ দেহী শ্যামল কান্তির মানুষ। সম্ভবত তিনি বাঙ্গালীর একমাত্র নেতা, - যিনি গায়ের রং, মুখের ভাষা, চলনে - বলনে, আকারে, এক কথায় নৃতাত্ত্বিক ভাবে খাটি বাঙ্গালি। তার সংগ্রাম শুধু স্বাধীনতা লাভের জন্য নয়। এই সংগ্রাম বাঙ্গালীর নেশন হুড পুনরোদ্ধার  এবং নেশন ষ্টেট প্রতিষ্ঠার”।  

আশ্চর্য  এই মানুষটির জীবন ছিল অতি সাধারণ। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়েও তিনি সরকারি বাস ভবনে থাকতেন না। নিরাভরণ আটপৌরে ৩২ নম্বরের বাড়ীতেই থেকেছেন আজীবন। বিভিন্ন ছবিতে আমরা দেখি তার সেই লুঙ্গিপরা ছবি। গায়ে সাদা হাফ হাতা গেঞ্জি।  বিছানায় বসা ছেলে মেয়ে পরিবেষ্টিত হয়ে। অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার যেমন হয় ঠিক তেমনি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে আমরা তার সাধারণ জীবন যাপনের সেই কথা অনেকটাই জানতে পারি। জীবনে নিজের জন্য তিনি কিছুই চান নি। একবার এক  বক্তৃতায় বলেছিলেন, “একজন মানুষ আর কি চাইতে পারে, আমি যখন ভাবি দূরে এক জনশূন্য পথের ধারে আধো আলো ছায়ায় এক লোক লন্ঠন হাতে দাড়িয়ে আছে শুধু আমাকে এক নজর দেখবে বলে, তখন মনে হতো, এক জন মানুষের পক্ষে আর কি চাওয়া পাওয়ার থাকতে পারে?”  জীবনভর  তিনি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। বাংলার মানুষ তাকে ভালোবাসতো বলেই তার কথাতেই মৃত্যুকে উপেক্ষা করেছে। জায়গা দিয়েছে তাকে হৃদয়ের গভীরে। এখানেই বেঁচে থাকবেন বঙ্গবন্ধু।  

১৯৮৩ সালে মওদুদ আহমেদ তার বই, Bangladesh - Era of Shekh Mujibur Rahman -এ  লিখছেন, “শেখ মুজিবের আবির্ভাব বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তার সমাধি রচিত হয়নি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি রূপকথার নায়কের মতই ভাস্বর হয়ে থাকবেন। হয়ত বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ মুজিবের চেয়েও প্রজ্ঞাবান, দক্ষ, সুযোগ্য ও গতিশীল রাজনৈতিক নেতার অভ্যুদয় ঘটেছে বা ঘটবে, কিন্তু বাংলাদেশের  স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয় পরিচিতি নির্ধারণে তার চেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন এমন কাউকে পাওয়া কঠিন হবে”। 

রূপকথার এই নায়কের গল্প বহমান থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। ১৯৯৪ সালে আহমদ ছফা ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ শিরোনামে লিখলেন  “আজ থেকে অনেকদিন পরে হয়ত কোন পিতা তার পুত্রকে বলবেন, জানো খোকা, - আমাদের দেশে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিলেন, যার দৃঢ়তা ছিল, তেজ ছিল, আর ছিল অসংখ্য দুর্বলতা। কিন্তু মানুষটির হৃদয় ছিল, ভালবাসতে জানতেন। দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিক চিক করে জ্বলে, তা হল মানুষটির সাহস। আর জোছনা রাতে রুপালি কিরন ধারায় মায়ের স্নেহের মত যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি ও স্নিগ্ধতার বোধ জাগিয়ে তোলে তা হল তার ভালবাসা। জানো খোকা, তার নাম ছিল শেখ মুজিবুর রহমান”।

মনজুর অপি । অটোয়া, কানাডা