অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
রবীন্দ্রনাথ কেমন করে লিখতেন - সুনির্মল বসু

বীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র একটা নাম নয়, ফলে ফুলে পত্র-পল্লবে ভরা এক মহা কল্পতরু। প্রতিদিনের জীবনে সর্বত্র তিনি অতিশয় জরুরী। তিনি মানুষের মননে আছেন বলেই, কৃষ্ণচূড়ার রঙে বর্ণ বাহার, প্রজাপতির সহজ ওড়াউড়ি, দীঘির জলে শাপলা শালুক, উতরোল নদীতে জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, তিনি আছেন বলেই, এই পৃথিবী এত সুন্দর, এত মোহময়। গল্পে গানে, উপন্যাসে নাটকে, প্রবন্ধে তিনি ভরিয়ে দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের সুবিস্তৃত আঙিনা।

আজ তাঁর শুভ জন্মদিন। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জননী সারদা দেবী। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তাঁর জন্ম। তিনি পড়াশোনা করেছেন ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে, নরমাল স্কুলে এবং সেন্ট জেভিয়ার'স কলেজিয়েট স্কুলে। চার দেয়ালের মধ্যেকার পড়াশুনা তাঁর কোনদিনই ভালো লাগেনি। যিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান, তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেবেন কেন। তাঁর বাবা মশাই যখন দেখলেন, রবির পড়াশোনায় মন নেই, তখন তিনি তাকে জমিদারি দেখাশোনা করবার জন্য শাহজাদপুরে, পাতিসরে পাঠালেন।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, আমার কাজ ছিল জমিদারি করা নয়, আসমানদারি করা। তাঁর সর্বক্ষণের সাথী তখন আব্দুল মাঝি। তিনি সর্ব ক্ষণ বোটে চড়ে বেড়ান। নিজেই বলেছেন, পদ্মা নদীকে আমি বড়ই ভালোবাসি। ইন্দ্রের বাহন যেমন ঐরাবত, আমার তেমনই পদ্মা, আমার সর্বক্ষণের সাথী।

মাত্র আট বছর বয়সে বড়দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর সাধনা পত্রিকায় অভিষেক কবিতা লিখে তাঁর সাহিত্যে অভিষেক। এরপর তিনি লিখেছেন, সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাত সঙ্গীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল।
জমিদারি দেখতে এসে তাঁর কবি জীবনের ঐশ্বর্য পর্ব শুরু হলো। লিখলেন, সোনার তরী, মানসী, চিত্রা ও চৈতালী কাব্যগ্রন্থ। লিখলেন,
ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী,
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।

১৯১৩সালে গীতাঞ্জলি গ্রন্থের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন। এর ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থের নাম হল, songs of the offerings.
তিনি বিশ্ব কবি হলেন। চীন দেশ বলেছিল, চু চেন তান, অর্থাৎ, ভারতীয় ঋষি ভারতীয় সূর্য।

কিন্তু প্রশ্ন হল, রবীন্দ্রনাথ কেমন করে লিখতেন। তিনি এক জায়গায় বসে কখনও লিখতেন না। আজ উদয়নের বাড়িতে লিখলে, কাল শ্যামলীতে।
মংপুতে যখন রানী চন্দের কাছে ছিলেন, তখন টেবিল ঘুরিয়ে লিখতেন। লেখার সময় কেউ সামনে থাকুক পছন্দ করতেন না।
একবার এভাবে লিখতে বসেছেন, জানালার পাশে মাধবীলতা দুলছে, তাঁর  খাস চাকর বনমালী ঘরে ঢুকবেন কিনা ইতস্তত করছে, রবীন্দ্রনাথের লিখে ফেললেন, সেই বিখ্যাত গানটি, হে মাধবী, দ্বিধা কেন।

প্রতিদিন ভোর বেলায় তিনি বোটে চড়ে বেড়ান, প্রতিদিন একটি গ্রাম্য বধূকে নদীতে জল নিতে দেখেন, তাকে নিয়েই একদিন গান লিখলেন,
তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম।

বিলেতে গিয়ে দেখা হল, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ তাকে নিয়ে গান লিখলেন,
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী।

একদিন বিকেলে পদ্মা নদীতে বোটে ভেসে চলেছেন, আকাশ জুড়ে মেঘ করলো। প্রবল ঝড় বর্ষা শুরু হল। রবীন্দ্রনাথ সেই ঝড় জলে ভিজলেন। রাতে কবিতা লিখলেন,
আমি পরানের সাথে খেলিব আজিকে মরন খেলা,
নিশীথ বেলা।

পরদিন সকালে আবার লিখলেন,
হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে,
ময়ূরের মতো নাচে রে।
তাঁর মনটা ছিল অতিশয় সংবেদনশীল, উড়ু উড়ু, দার্শনিকের মতো।

আবার একদিন নৌকা থেকে দেখলেন, একটি ছেলে একটি গাছের গুড়ির উপর বসে আছে, অন্য ছেলেরা তাঁকে নদীর জলে ফেলে দেবার চেষ্টা করছে, একজন কাঁচাপাকা গোঁফওয়ালা লোক কিছু একটা জিজ্ঞাসা করলেন, বড় ছেলেটা আঙ্গুল উঁচু করে কিছু একটা দেখালো। রবীন্দ্রনাথ ছুটি গল্প লেখার পটভূমি পেয়ে গেলেন।

লখনৌ এর বড় ব্যারিস্টার এবং নামকরা কবি অতুলপ্রসাদ সেন, রবীন্দ্রনাথ কেমন করে লেখেন দেখতে এলেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথ সবার সামনে লেখেন না। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখা গেল, আকাশ জুড়ে মেঘ। রবীন্দ্রনাথ ঘুম থেকে উঠে বাগানের দিকে গেলেন। বিড়বিড় করে বলছিলেন,
সব যে হয়ে গেল কালো, নিভে গেল। 
পরে গানটি লিখে তিনি দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর কে ডেকে বললেন, এইমাত্র গানটা লিখেছি, সুর লাগাও তো।  অতুলপ্রসাদ সেন তখন বললেন, কবি, আপনার এই গানটির কথা আমি জানি।
সেকি, কিভাবে,
আজ সকালে যখন আকাশে মেঘ করেছিল, আপনি বাগানের কাছে হাঁটছিলেন, আর মুখে বিড়বিড় করে এই গানের কথাগুলো বলছিলেন। আমি শুনেছি।

জীবন সম্পর্কে গভীর প্রজ্ঞা ছিল রবীন্দ্রনাথের। তাঁর জীবন মোটেই আরামের ফুলশয্যা ছিলনা। বরং অজস্র মৃত্যুর মিছিল দেখতে হয়েছে তাঁকে সারা জীবন। বড় মেয়ে মাধুরীলতার মৃত্যু, মেজো মেয়ে রেনুকার মৃত্যু, সহধর্মিনী ভবতারিণী দেবীর মৃত্যু, ছোট ছেলে শমীর মৃত্যু জনিত বিষাদ তাঁকে আচ্ছন্ন করেছিল।
শমীন্দ্রনাথ মাত্র এগারো বছর বয়সে মারা গেলেন যেদিন, সেদিন তাঁকে দাহ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে ফিরছেন। জ্যোৎসনায় ভরে গেছে চার দিকের মাঠ। কবির মনে বেজে চলেছে,
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু
বিরহদহন মাঝে।

তিনি শ্যামলীর বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। তাঁর মন গভীর বিষাদে আচ্ছন্ন। বন্ধুরা এসে বললেন, চলুন, জ্যোৎস্নায় হাঁটি। তিনি গেলেন না। লিখলেন, সেই বিখ্যাত গানটি,
আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে।

অসংখ্য মৃত্যুর সরণি পেরিয়ে তিনি পরলোক তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলেন। বন্ধু অধ্যাপক মোহিত চন্দ্র সেন এর কন্যা উমা সেনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্ল্যানচেটে মৃত আত্মাদের আনতেন।
প্রশ্ন, কে এসেছ,
আমি শমী, শমী,শমী,
মৃত্যুর পরে ঠিক কী ঘটেছিল,
নদীর ধার দিয়ে ভাসতে-ভাসতে আমি যেন কোথায় গেলাম,
তোর জন্য কবিতার বই লিখে ছিলাম, মনে আছে,
আছে, আছে, আছে,
বল দেখি,
মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে, মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে, তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে।

একদিন এলেন কাদম্বরী দেবী, কবির নতুন বৌঠান।
অল্প বয়সে সমবয়সী কাদম্বরী দেবীকে লেখা দেখাতে গেলে, তিনি বলতেন, আমাদের রবি ভালো লেখেন, বিহারীলাল বাবুর মত নয়।

সারা জীবন রবীন্দ্রনাথ বিহারীলাল বাবুর চেয়ে ভালো কবিতা লিখতে চেষ্টা করেছেন। সেভাবেই বিশ্বখ্যাতি। একদিন প্লানচেট নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীকে আনলেন।
রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করলেন, কে এসেছ,
তোমাদের নতুন বৌঠান।
তুমি যে আমার কাছে আসো, তা বুঝবো কি করে, কাল রাতে যখন তুমি কম্বলটা পায়ের কাছ থেকে তুলে নিলে, তখন একরাশ দমকা বাতাসের মতো জানালার শার্সি দিয়ে আমি তো তোমার কাছে এলাম।
বিদেশে আমার ছবির প্রদর্শনী হচ্ছে, তুমি দেখো,
তোমার সব কাজেই আমার সমর্থন আছে।

কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করার পর রবীন্দ্রনাথ অতিপ্রাকৃত গল্প লেখায় মনোনিবেশ করেন। ক্ষুধিত পাষাণ, মনিহারা প্রভৃতি গল্প এই পর্বে লিখেছেন। নারীর মনস্তত্ত্ব নিয়ে লিখেছেন শাস্তির মতো পৃথিবী কাঁপানো গল্প। আসলে, তাঁর সোনার কলমের স্পর্শ পেলেই, চরিত্রগুলো, জীবনের ক্যানভাস টুকু জীবন্ত হয়ে উঠতো।
মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি জগতও জীবনকে দুচোখ মেলে দেখেছেন। সেই দেখা গুলোই সাহিত্যে সত্যরূপে ধরা দিয়েছে। বলেছেন,
জীবনে জীবন যোগ করা, তা না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা, তাই আমি মেনে নিই সে নিন্দার কথা, আমার সুরের অপূর্ণতা।

এক জীবনে বহু জীবনের কাজ করে গিয়েছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড় সমালোচক এডওয়ার্ড টমসন বলেছেন, tagore's রাইটিংস ওয়ার অফ ভিজুয়াল অফ আইডিয়াস।
এই শুদ্ধতম আইডিয়া গুলো আমাদের প্রতিদিনের জীবনে অত্যন্ত জরুরী। জালিয়ান ওয়ালাবাগের নিরস্ত্র মানুষদের উপর কর্ণের ডায়ার গুলি চালালে তিনি নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। আসলে, সারাজীবন তিনি ছিলেন মানবতাবাদী।

মানুষ থাকে না, আদর্শ থেকে যায়। রবীন্দ্র সাহিত্য মানুষের আশ্রয়। সুখে দুঃখে আনন্দে বেদনায় শোকে প্রতিদিন তাই রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রাণের অতন্দ্র প্রহরী। গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজার মত আমার এই স্মৃতি তর্পণ।
রবীন্দ্রনাথের প্রতিদিন জন্ম হয়, রবীন্দ্রনাথের কোনোদিন মৃত্যু হয় না।
তাঁর কবিতার ভাষাতেই আশা প্রকাশ করি,
ঐ মহামানব আসে।
কারণ, দুঃখ পীড়িত, শোক কাতর মানুষের কাছে তিনি যে শেষ আশ্রয়, একমাত্র আশ্রয়, প্রাণের ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

সুনির্মল বসু। পশ্চিমবঙ্গ, ভারত