বন্দিবেলার গল্প - অলক পর্ণা সেনগুপ্ত
এমন করে বন্দি থাকতে হবে কমলিকা কী ভেবেছিল কোনোদিন!! তার মধ্যে অনিমেষ এখন এখানে। লকডাউন শুরু হওয়ার আগ দিয়ে এসেছিল ওর চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে। অনিমেষ চাকরি করে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এক গ্ৰামের স্কুলে। আর কমলিকার জন্ম কর্ম সব এই উত্তরবঙ্গের ছোট্ট শহর জলপাইগুড়িতে। বিয়ে হয়েছে তা প্রায় দশ বছর বাচ্চা কাচ্চা হলনা। তাই নিয়ে ওদের কারোরই কোনো আফশোস নেই। অনিমেষও জলপাইগুড়িরই ছেলে। চাকরি সূত্রে সেই যে ঘুটিয়ারি শরীফে আস্তানা গাড়লো এখনও সেখানেই। কমলিকা আর অনিমেষের দাম্পত্যটা দশ বছর ধরে লং ডিসট্যান্সেই চলছে। ছুটি পেলে অনিমেষ চলে আসে জলপাইগুড়িতে। বাবা মা দুজনেই গত হয়েছেন কলেজে পড়াকালীন। কমলিকা একাই থাকে এ বাড়িতে। ওর বাবার বাড়ি এ শহরেই অন্য পাড়ায় । শহরের নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর পাশাপাশি টুকটাক লেখালেখি, আবৃত্তি, সমাজসেবা ইত্যাদি নিয়ে ও খুবই ব্যস্ত থাকে সবসময়। কমলিকা বসুর আকর্ষণ এড়ানো দূরহ ব্যাপার তাই চারপাশে স্তাবকের ভীড় লেগেই থাকে। চিরকালই যা উপভোগ করে এসেছে কমলিকা।
অনিমেষ আবার একটু আড়ালে থাকতেই ভালবাসে। নানা রকম সুখাদ্য খাওয়া আর নানা রকম ব ই পড়া এ হল অনিমেষের প্রিয় কাজ। অনিমেষ-কমলিকা বিয়ের পর থেকে টানা একমাসের বেশি একসাথে থাকেনি। এবার প্রথমে তো এই মহামারীর সময় দুজনে একসাথে থাকবে এটা একটা স্বস্তির বিষয়ই ছিল, কিন্তু ক্রমশঃ যেন ঘোলা হচ্ছে জল। মাঝে মাঝে যেন অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে।
করোনার ভয়ে বাড়ির সাহায্যকারিনী মেয়েটিকেও সাময়িক বিদায় দিয়েছে কমলিকা। কিন্তু এত কাজ করার অভ্যেস ওর কোনকালেই নেই। সারাদিন বাড়িতে বসে থাকা যে কী বিরক্তিকর!! তার ওপর অনিমেষের রকমারি খাওয়ার ফরমাশ। আগে ছুটিতে বাড়ি এলেই কমলিকা নিজে থেকেই বিভিন্ন রান্না করে খাওয়াত। প্ল্যান করে রাখত এবার এলে অনিমেষ কে কি কি খাওয়াবে। কিন্তু এবার যেন ওর হাঁফ ধরে যাচ্ছে। সারাদিন একখানা বই মুখের ওপর ধরে অনিমেষকে একই ভঙ্গিতে দেখে যাচ্ছে ও। স্থানটা পরিবর্তন হচ্ছে মাঝে মাঝে কখনও সোফা কখনও বা বিছানায়, অগোছালো ঘর আর গুছিয়ে উঠতে পারছে না। এক অসহ্য ল্যাদখোর স্বভাব অনিমেষের। ওখানে এক রাঁধুনি আছে, পঞ্চা। সে আবার পাকা রাঁধুনি। সেখানে নানা রকম খাওয়া আর বই পড়া আর স্কুল এই জীবন অনিমেষের। কমলিকার ওখানে যাওয়ার কথা ভাবলেই গায়ে জ্বর আসে। ভয়ঙ্কর ভীড়ের লোকাল ট্রেন, মশা, বর্ষাকালে প্যাচপ্যাচে কাদা!!
অনিমেষও কিন্তু বুঝতে পারছে কমলিকার অবস্থা। ওর নিজেরও মাঝে মাঝে বিরক্তি লাগছে কমলিকার এই পিটপিটে স্বভাবের জন্য সবসময়, এটা কোরোনা, ওখানে শুয়ো না, এত রিচ খেতে চাও কেন?? ওফ্!!! মনের রাগটা প্রায়ই প্রকাশ হয়ে পড়ছে দুজনেরই। আর ফোন, কত যে ফোন আসে কমলিকার!! কত যে ফ্যান ওর!! মনে মনে ভাবে অনিমেষ। অনিমেষের যেন মনে হয় কমলিকার জীবনে ওর এখন সাইড রোল। এতদিন বুঝতে পারেনি, লকডাউন বুঝিয়ে দিল।
পয়লা বৈশাখ পঁচিশে বৈশাখ সব চলে গিয়ে বাইশে শ্রাবণও পেরিয়ে গেল। অনান্য বার কত অনুষ্ঠান কত আনন্দে সবাই মিলে মেতে থাকে এবার শুধু স্মৃতি চারণ। তবুও সোশ্যাল মিডিয়া আছে বলে একটু শ্বাস ফেলতে পারছে!! মনে মনে ভাবে কমলিকা। অনলাইনে কয়েকটি অনুষ্ঠানও করল। বন্ধুদের আমন্ত্রণে। অনিমেষের এসবে তেমন কোন উৎসাহই নেই। তবে ওর ফোন এলে যে দৃষ্টিটা একটু বদলে যায় বোঝে কমলিকা।
বাড়িতে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির উপস্থিতির অভাব বোধ হয় কমলিকার। একা থাকাটাকে ও উপভোগ করে এসেছে বরাবর, দাম্পত্য জীবন ওর কাছে প্রায় একটা পিকনিকের মত ছিল। রোজকার জীবনের দাম্পত্যে কখনো যেন ও অনভ্যস্ত হয়ে পড়েছে! অনিমেষ খুব একটা রাগী নয় তবে একটু কম কথার মানুষ, বন্ধুবান্ধবও হাতে গোনা। আর এখন তো বের হবার প্রশ্নই নেই, তাছাড়া বাইরে থেকে ফিরলে কমলিকা জল, সাবান, স্যানিটাইজার, জামাকাপড় ধোয়া সব নিয়ে এত হুলুস্থুল করে যে বের হওয়া বন্ধই করে দিয়েছে অনিমেষ। নয়তো অন্তত শ্বশুরবাড়ি গিয়ে এক আধদিন শালার সাথে আড্ডা মেরে আসবে ভেবেছিল, কিন্তু কমলিকার গরম দৃষ্টি দেখে মিইয়ে গেল নেতানো মুড়ির মতো। অগত্যা বই পত্র ভরসা। মাঝে মাঝে চেষ্টা করে নিজেই টুকটাক রাঁধার, কিন্তু নিজেই ঠিক খেতে পারে না। কমলিকা অবশ্য মনে হয় ওর এই চেষ্টাটার দাম দেয় বলেই অনিমেষের ধারণা। নৈলে ওই রান্না বিনি বাক্যব্যয়ে দিব্যি খায় কি করে!! দোতালায় ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় অনিমেষ উল্টো দিকের বাড়ির দুটি বাচ্চা খেলছে বাড়ির বাগানে। এর আগে ওরা প্রায়ই আসত এ বাড়িতে। কমলিকা খুব ভালবাসে ওদের।
অনিমেষের মনে পড়ে বছর তিনেক আগে কমলিকা একটি বাচ্চা দত্তক নিতে চেয়েছিল খুব। কিন্তু অনিমেষ রাজি হয়নি। এখন মনে হয় রাজি হলেই ভাল হতো। আর হয়ত কমলিকা রাজী হবে না। এক নীরব জেদ আছে ওর মধ্যে। ওই একবারই আর কোনদিন ও বিষয়ে বলেনি। নিজেকে আরও বেশি ব্যাস্ত রেখেছে নানা কাজে। অনিমেষের ওখানে কলিগদের নিয়ে খুব ভাল একটা ফ্রেন্ড সার্কেল আছে স্কুলে ছাত্র পড়ানো, নানা রকম খাওয়া, আড্ডা আর বই পত্র নিয়ে দিব্যি কাটে ওর। সাথে আরেকটি ভাললাগার কাজ করে ও, তাই হল কিছু নাইন-টেনের ছেলেমেয়েদের কোচিং দেওয়া, অবশ্যই ফ্রীতে। খুব ভালবেসে ওই কাজটি করে ও। বাড়িতে এসেও ক’টা দিন হৈ চৈ করেই কাটিয়ে দেয়। কিন্তু এবার একটা অভাববোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কী যেন একটা নেই, যা থাকলে ভরাট হত জীবনটা। সন্তান যে বায়োলজিক্যাল হতেই হবে এমন ভাবনা কিন্তু অনিমেষের মনে একটুও ছিল না তা নয়। একটা সময় ওরা দুজনেই চিকিৎসকের শরনাপন্ন হয়েছিল অসুবিধে ছিল না কারোর কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সন্তান এর না কমলিকার গর্ভে।
খুব ইচ্ছে ছিল কমলিকার মা হবার কিন্তু হল না তা। তার মা না হতে পারার ব্যার্থতা এক লুকোনো ক্ষতের মত যা কমলিকা দেখাতে চায় না কাউকে। অনিমেষকে তো নয়ই। নিজেকে নানা কাজে ছড়িয়ে শান্তি পায় ও। কিন্তু এ মহামারী, মৃত্যু ভয়, এই যে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত সবার বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টার মাঝে জেগে উঠছে সেই পুরনো ক্ষত। এই কয়েক মাসে ওর আর অনিমেষের কথা যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে। তখন মনে হয় অনিমেষের মা বাবাও যদি আজ বেঁচে থাকতেন!! দুজনের মাঝে একটা সেতুর বড় প্রয়োজন ছিল। একটি শিশুকে নিজের করে নেবার খুব ইচ্ছে ছিল ওর। অনিমেষ রাজি না হওয়ায় দ্বিতীয় বার আর বলেনি। খুব অভিমান হয়েছিল। কিন্তু কমলিকা যদি বোঝাত অনিমেষ কী বুঝত না!! এত অবুঝ তো ও নয়! অপটু হাতে কমলিকাকে সংসারের কাজে সাহায্য করে, মাঝে মাঝে রান্নাও করে, ভাল নাহলেও ওর চেষ্টাটাকে সম্মান করে কমলিকা। একেকবার ইচ্ছে হয় আবার বলে অনিমেষকে, বোঝায়, আবার গুটিয়ে যায়। প্রত্যাখানে বড় ভয় ওর।
বিকেলের বৃষ্টিটা হল বলে গুমোট গরমটা কেটেছে একটু। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আজো সামনের বাড়ির বাচ্চা দুটোর হুটোপুটি দেখছিল অনিমেষ। হটাৎ বাচ্চা দুটোর “আন্টি আন্টি” চিৎকার শুনে চমকে দেখে কখন যেন কমলিকা এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। “অনি, অনেক দিন তো হল এবার একটু চেষ্টা করে দেখো না এখানে ট্রান্সফার হয়ে আসতে পারে কিনা আর কতদিন এভাবে থাকব আমরা?”
“এখানে ফিরলে কিন্তু সারাদিন নানা রকম রান্না করতে হবে, পারবে” হাসতে হাসতে বলে অনিমেষ।
-দুজনে মিলে রাঁধলে চলবে না?
-হ্যাঁ তাও চলবে, আমার রাঁধা অখাদ্যগুলো যে তুমি কিভাবে খাও!!
-কিন্তু অনি তুমি চলে এলে তোমার কোচিং এর বাচ্চারা??
-আসব বললেই কী আসা। ততদিনে ওদের মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে যাবে।
চলো কমলিকা আবার নতুন করে শুরু করি সব, এ্যাডাপ্ট এর জন্য অনলাইন ফরম ফিলাপ করি। এক নিঃশ্বাসে বলে অনিমেষ। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে কমলিকা অনিমেষের দিকে। অনিমেষও যেন নতুন করে খুঁজে পাচ্ছে কমলিকার চোখে পুরোনো কিছু। কমলিকা জানে এখন চাইল্ড এ্যাডাপ্ট করা প্রচুর সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, তবু মানুষের চেষ্টা বা ইচ্ছেকে চিরকাল সম্মান জানায় ও। অনেক দিন পর আলতো করে অনিমেষের হাতটা ধরে কমলিকা। নিজেদের বৃত্তে ঘুরতে ঘুরতে অনেক দূরে চলে যাওয়া দুটো মানুষ অনেকদিন পর আবার কাছাকাছি আসার জন্য উন্মুখ হচ্ছে, একসাথে বন্দি থেকে ওপরের রঙিন মোড়ক খুলে ফেলে পরস্পরকে ভালবেসে নতুন করে চিনতে চাওয়া দুটো মানুষ, হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে পড়ন্ত বেলায়।
অলক পর্ণা সেনগুপ্ত। পশ্চিমবঙ্গ
-
গল্প//উপন্যাস
-
16-08-2020
-
-