গয়নার বাক্স - রত্না দত্ত
পিসেমশাই মারা যাওয়ার মাস ঘুরতে না ঘুরতেই ছোটপিসি কে অলক্ষ্মী বলে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ফেরত পাঠিয়ে দিল বাপের বাড়িতে। সেই থেকে সত্যিই নিজেকে সংসারের অলক্ষ্মী মনে করে নির্বাসন নিল বাড়ির উপরের চিলেকোঠার ঘরটিতে। বাপের বাড়ির জমিদারী আদবকায়দায় নিজেকে ছোটপিসি আগের মতই সাবলিল করে তুলতে পেরেছিল ঠিকই কিন্তু তখনকার সমাজে বিধবাদের রীতি - নীতি, আদবকায়দা এগুলোর বাইরে পিসি নিজেকে নিয়ে যেতে পারেনি। কিন্তু পিসির এই বাড়িতে একটা আলাদা দাপট ও ছিল। তার মুখের ওপরে কেউ কিছু বলার সাহস পেত না বাড়ির ছোটোরা তো যমের মত ভয় পেত,আর বড়রা কিছুটা সমীহ করে চলত, কিন্তু বাড়ির ছোট বলে সবার কাছে আদরের পাত্রী হয়েও ছিল।
কিছুটা আদর, যত্নও পেত এই কমবয়সে বিধবা হয়ে এসেছিল বলে। বিশেষ করে বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের থেকে বাবা ও মা ছোটো পিসিকে একটু অন্য চোখে দেখতো এবং ভালোবাসতো। সেইজন্য পিসিও বাবাকে ও মাকে দাদা, বৌদি হিসেবে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতো। যাইহোক, এইভাবেই চলে যাচ্ছিল দিন, কিন্তু হঠাৎ একদিন সকালবেলায় বাড়িতে হুলস্থুল কাণ্ড; বাড়ির যত সদস্য, চাকর - বাকর, দারোয়ান, মালী, রাঁধুনি সবাইকে বাড়ির উঠোনে জমায়েত হতে দেখা গেল। আমিও যথারীতি কৌতুহলবশত নিচে নেমে এলাম। প্রচন্ড চিৎকার - চেঁচামেচি হচ্ছে দেখে জিজ্ঞাসা করতেই জানতে পারলাম, পিসির গয়নার বাক্সটা নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। আমি থাকতে না পেরে চেঁচিয়ে বললাম,
- সে কি গো? পিসি! তোমার গয়নার বাক্সটা চুরি করার দুঃসাহস কে দেখালো?
কার এত বড় ক্ষমতা যে প্রথমতঃ তোমার ঘর থেকে আর দ্বিতীয়তঃ তোমার ঐ যখের ধন আলমারি থেকে গয়নার বাক্স বের করে নেবে। তার বুকের পাটা আছে বলতে হবে।
- তুই থাম! আর পাকা পাকা, বড়ো বড়ো কথা বলিস না তো? হাজার বার বলেছি বাড়িতে এই উল্টো - পাল্টা লোকজনকে পরিচয় না নিয়ে কেউ কাজের জন্য ঢুকিও না। কেউ কি শোনে আমার কথা? বিধবা বলে বাড়ির এককোণে পড়ে থাকি বলে আমার কথার তো কোনো গুরুত্বই নেই।
সবাই তো আকাশ থেকে পড়ল। পুলিশ, দারোগা বাড়ি ভর্তি হুলস্থুল ব্যাপার। যে পিসি ঐ ঘরের চাবি আর আলমারির চাবি নিজের শাড়ির আঁচলের খুঁটে বেঁধে রাখে সবসময় তার গয়নার বাক্স কি করে চুরি যেতে পারে, আর ওই গয়নার বাক্সে পিসির বিয়ের সমস্ত গয়না ছিল। পিসিও চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে দিল।
- যাইহোক, সন্দেহের তালিকায় অনেকে থাকলেও কাউকেই শেষপর্যন্ত ধরা গেলো না। কিন্তু রহস্যটা সবার মনে থেকেই গেলো। কিন্তু মাঝখান থেকে আমার খেলার বন্ধুবান্ধবদের আসার পথটা বন্ধ হয়ে গেল। এরপর থেকে বাড়ির সবাই একটু সাবধানতার পথ অবলম্বন করতে শুরু করল। মনে মনে সবাই সবাইকে সন্দেহ করলেও পিসির ভয়ে সেই সন্দেহের বিন্দুমাত্র বহিঃপ্রকাশ ঘটলো না। একটা অজানা রহস্যের জল বিছিয়ে রইল সবার মনে।
এরপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে বাবার পরিচয়টাও বেশ নিবিড় হয়েছে, আমি তখন বারো ক্লাসে পড়ি। একটু-আধটু বুঝতে পারলেও বাবা সেইভাবে বাড়ির সকলের কাছে প্রকাশ করতেন না, কিন্তু হয়তো ভবিষ্যতের দিশারী হিসেবে আমাকে একটু আধটু বলতেন এরপরে বাবা রীতিমতো স্বাধীনতার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এক নতুন উদ্যমে। বাবা ছিলেন পেশায় ডাক্তার। তাই ডাক্তার হিসেবে বাড়ির বৈঠকখানায় নিজে প্র্যাকটিস করতেন আর ঐ প্র্যাকটিসের আড়ালে চলতো বাবার স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজকর্ম। তিনি বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জীবনও দান করেছেন নিঃস্বার্থভাবে দেশের মুক্তির জন্য। পুলিশের চোখ এড়িয়ে বাবাকে অনেকবার পালাতেও হয়েছিলো তাই সেইসময়ে বাবার অপূর্ণ কাজগুলোর দায়িত্ব আমাকেই পালন করতে হতো। এর জন্য আমাদের বাড়িতে অনেকবার পুলিশও এসেছিল। মা তো সবসময় তটস্থ হয়ে থাকত। পিসিও বাবাকে সবসময় সাহায্য করতো। অনেকবার অনেকরকম বুদ্ধি খাটিয়ে বাবাকে বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে পালানোর সুযোগও করে দিয়েছিল। আসলে পিসির দুর্দিনে বাবা পিসিকে অনেক সাহায্য করেছিল তাই পিসিও বিশেষ করে দেশের সেবায় বাবার পাশে দাঁড়িয়েছিল একরকম বাড়ির সকলের অমতে। স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন বিপ্লবী হিসেবে বাবার যেটুকু অবদান ছিল তার মূল প্রেরণা ছিল ছোটপিসি। ছোটপিসির অটল বিশ্বাসই বাবাকে দেশের কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং বাবাও মনেপ্রাণে দেশের সেবায় ব্রতী ছিলেন। পিসির এই অনুপ্রেরণায় শুধু যে বাবাই অনুপ্রাণিত হয়েছিল তা নয় কোথাও যেন আমিও আস্তে আস্তে অনুপ্রেরণা পেতে শুরু করি।
একদিন রাত্রে কেন জানি না বাবা আমাকে ঘরে ডেকে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে বললেন,
- তোমার সঙ্গে একটা দরকারি কথা আছে বিপুল?
- বলুন বাবা?
- আমি আজ যে কথাটা বলব সেটা তুমি আর আমি ছাড়া কেউ জানবে না! যদি হঠাৎ করে আমার কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায় তা.......... ই। ইংরেজরা ও পুলিশরা যেভাবে আদা জল খেয়ে আমার পিছনে লেগে আছে তা -তে কতদিন আর নিজেকে রক্ষা করতে পারবো জানি না।
- কি হয়েছে বাবা? বলুন না?
- হ্যাঁ তবে শোনো! তোমার পিসির যে গয়নার বাক্স টা একসময়ে চুরি গেছিল সেটা কিন্তু আদৌ চুরি যায় নি।
- মনে?
- হ্যাঁ! সেইসময়ে সেটা সবার কাছে চুরি গেছিল ঠিকই কিন্তু তোমার পিসি বুঝতে পেরেছিল যে ওই গয়নার বাক্সের ওপর সকলের লোলুপ নজর ছিল তাই রক্ষা করাও কঠিন। পিসি চেয়েছিল যে তার সমস্ত গয়না কোনো ভালো কাজে দান করতে। তাই তিনি সেটা চুরি হয়েছে বলে আমাকে দিয়েছিলেন দেশের কাজে লাগানোর জন্য। তাই সেদিন তোমার পিসির দেওয়া ঐ গয়নার বাক্সটা আমি বাড়ির বাগানের পশ্চিমদিকে ঐ বড় কদমগাছটার তলায় পুঁতে রেখেছিলাম সময়ের অপেক্ষায়। একদিন সেই সময় এলও। তরুণ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের হাতে তুলে দিলাম সেই গয়নার বাক্স খানা দেশের জন্য, আমার মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য। সেদিন সেই মহান কাজ করতে পেরে নিজেকে ধন্য বলে মনে করেছিলাম আর তোমার পিসিকেও মনে মনে আমার সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন তোমার পিসি নিজের চোখে তা দেখে যেতে পারেননি ঠিকই কিন্তু পিসিকে দেওয়া আমার কথা আমি সযত্নে পালন করেছিলাম। আর এই গোপন কথাটা যেন চিরকাল গোপন কথা হিসেবেই থাকে। তাই পিসির ইচ্ছের যেন অবমাননা না হয় দেখো! আমার কখন কি হয়ে যায় তাই এই গোপানকথাটা আমি যাবার আগে তোমাকেই জানিয়ে গেলাম। বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই আমি বাড়ির হলঘরে পিসির ফ্রেমবন্দি ফটোটার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা ভেজা চোখে পিসির দিকে তাকিয়ে বললাম,
- সত্যিই পিসি তোমার বুদ্ধি ও দূরদর্শিতার কাছে হার মানতে বাধ্য হলাম। আজ তুমি যদি বেঁচে থাকতে তাহলে তোমাকে একটা প্রণাম করে বলতাম,
- পিসি! তোমাকে কুর্নিশ, তোমাকে সেলাম।
সেই সমাজে পিসি বিধবা হলেও স্বাধীনতা সংগ্রামে পরোক্ষভাবে নিজের একটা জায়গা করে নিয়েছিল একরকম নিজের অজান্তেই অতি চতুরতার সঙ্গে আর সেই গোপনকথা আজও আমি, পিসি আর আমার বাবা ছাড়া কেউ জানতে পারেনি আর ভবিষ্যতেও জানতে পারবে না।
- তাই পিসি! তোমাকে শতকোটি প্রণাম। দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে তোমাদের মতো নারীদের অবদান কোনোদিনই মুছে যাবে না, বিফলে যাবে না। তাই তুমি একজন মহীয়সি নারী আমার চোখে।
রত্না দত্ত। হুগলী
-
গল্প//উপন্যাস
-
10-09-2020
-
-