অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
ফেরা - রফিকুল নাজিম

ফসার ফকির আবার ফিরে এসেছে। বাইশ বছর পর মানুষটা আবার তার নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছে। খবরটা বাঁশগাড়িয়া গ্রামের উত্তর থেকে দক্ষিণ এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে পৌঁছতে বেশি সময় লাগেনি। আহা! পৈত্রিক ভিটার শীতল মাটিতে সে উত্তর-দক্ষিণে শরীরটা টানটান করে শুয়ে আছে। গত বাইশ বছরে বাঁশগাড়িয়া গ্রামের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। প্রমত্ত পদ্মার বিষাক্ত ছোবলে এই গ্রামের মোট দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ বেশ কমেছে। ভাঙনের কারণে ভিটেমাটি হারিয়ে পরিচিত অনেকেই চলে গেছে দূরের কোনো শহরে-বন্দরে। আফসারের সেই পাঠশালাও সতেরো বছর আগেই রাক্ষুসে কীর্তিনাশা গিলে খেয়েছে। অথচ এই পাঠশালাতে শিক্ষার আলো জ্বালানোর জন্য সে কতই না পরিশ্রম করেছে। বাঁশগাড়িয়া গ্রামের প্রতিটি বাড়ি গিয়ে ছোটবড় সবাইকে ধরে নিয়ে এসে বর্ণ শিখিয়েছে আফসার। আচ্ছা, আজ কি আফসারের প্রিয় পাঠশালার জন্য মনে খুব কষ্ট হচ্ছে? হরমুজ মোল্লার কথা কি আফসার ফকিরের মনে আছে? পাঠশালা বন্ধের জন্য হরমুজ কত রকমের ষড়যন্ত্রই না করেছে! তবুও এক চুলও দমেনি আফসার।

নদীর পাড় ধরে মানুষের লম্বা সারি। ক্ষেতের আইল ধরে গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা সব্বাই আফসার ফকিরের বাড়ির দিকে ছুটছে। গাঁয়ের বউঝিয়েরা মাথায় লম্বা গোমটা টেনে দ্রুত পায়ে হাঁটছে। বাইশ বছর পর লোকটা বাড়িতে এসেছে। খবরটা শুনেই উত্তরপাড়ার আশি বছর বয়সী জবান আলীও লাঠিতে ভর দিয়ে এসেছে প্রিয় বন্ধুকে একনজর দেখার জন্য। আসতে আসতে কত স্মৃতিই না মনে পড়ছে তার। পান চিবাতে চিবাতে পাশে দাঁড়ানো ছোকরার সাথে সেই সোনালী শৈশব ও কৈশোরের গল্প রসিয়ে কষিয়ে করছে। উঠানে শোয়া আফসার ফকিরের পায়ের কাছে বসে আছে তার একমাত্র ছেলে আকবর ফকির। বাবার মত সেও বাঁশগাড়িয়া গ্রামের সবার সুখে দুঃখে পাশে থাকে। হোমিও ডাক্তারি পাশ করে নিজের গ্রামের মানুষের সেবা করছে। বাজারেই একটা চেম্বার খুলে বসেছে। অনেকেই আকবর ফকিরের মুখের দিকে তাকালে নাকি আফসার ফকিরকে দেখতে পায়! বাপকা বেটা৷ চেহারায় দারুণ মিল। সেই ইস্পাত কঠিন হাতের পাজা। মুখে দৃঢ়তার জলছবি। চোখে গভীর এক মায়ায় দরিয়া ঢেউ খেলে। একদম আফসার ফকিরের মতোই। আফসারের প্রতি ভালোবাসার টানে দূরদূরান্ত থেকে হাজারো লোক আসছে। সবার নয়নের মনি আফসার ফকির এখনো বাইশ বছর আগের মতই। তাকে দেখে কেউ কেউ আসমানের দিকে তাকিয়ে 'সুবহানাল্লাহ' বলছে। শোকরানা আদায় করছে আল্লাহর কাছে।

ডিসেম্বরের শেষের দিক বেশ শীত পড়েছিল সে বছর। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের হাওয়া বেশ ভালোই লেগেছিল বাঁশগাড়িয়ায়। হরমুজের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য আফসারের বিকল্প কেউ ছিলোনা। তাই গ্রামবাসী আফসার ফকিরকে মেম্বার প্রার্থী হওয়ার জন্য খুব জোরাজুরি করে। নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আফসারও না করতে পারেনা। নির্বাচনের শুরুতেই হরমুজ অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। চারিদিকে শুধু আফসারের জয়গান। বিষয়টা হরমুজের মগজে বারবার পদ্মার উতলা ঢেউয়ের মতই আঘাত করতে থাকে। সে কোনো কিছুতেই মনে শান্তি পাচ্ছিল না। নির্বাচনে হারলে তো হরমুজের আম-ছালা দুটোই যাবে। ক্ষমতা, চড়া সুদের ব্যবসা, জোর করে অন্যের জমি দখল- কিছুই আর সে করতে পারবেনা।

বিনা নোটিশে সেইদিন বাঁশগড়িয়া গ্রামের উপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় উঠে। পাশার দান একদম পাল্টে যায়। কীর্তিনাশার রাক্ষুসে থাবা থেকেও মানুষ ফিরে আসে কিন্তু হরমুজ মোল্লা কারো প্রতি বাঁকা চোখে তাকালে তার হদিস শুধু পদ্মার জলই জানে। আর কেউ কোনোদিন টেরও পায়না। হঠাৎ নির্বাচনের দুইদিন আগে আফসারের বাড়ির পাশে আমগাছে তার ঝুলন্ত লাশ দেখতে পায় গ্রামবাসী। পাথুরে স্তব্ধতায় ডুবে যায় পুরো বাঁশগাড়িয়া গ্রাম। চোরা স্রোতে হারিয়ে যায় জলজ সব স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। দ্রুতই ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে। আফসারের লাশের সুরতহাল হয়। তার মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলেই নথিভুক্ত করে পুলিশ। তারপর পদ্মার কত জল গড়িয়ে গেল দক্ষিণে। গ্রামের সবাই বুঝতে পেরেছিল- হারামি হরমুইজ্জা তার পথের কাঁটাকে সুকৌশলে সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেদিন সাহস করে কেউ প্রতিবাদ করতে পারেনি। শুধু নূরা পাগলা বাঁশগাড়িয়া বাজারের এ-মাথা থেকে ঐ-মাথা পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে বলেছিল, 'হালা হরমুইজ্জা, তরে ঐ গাঙের কালা পানি ডাহে। তরে ফাঁসের দড়ি ডাহে।'  সেইদিন আফসার ফকিরের এই নির্মম পরিণতি দেখে পুরো গ্রাম স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আজকের মত সেদিনও বাঁশগাড়িয়া গ্রামের সবাই আফসার ফকিরের বাড়িতে জড়ো হয়েছিল। বুক ভিজিয়ে কেঁদেছিল। তারপর অনেকদিন বাঁশগাড়িয়া গ্রামে কোনো উৎসব হয়নি। এমন কি কোনো বিয়েতেও না! প্রকৃতির অদ্ভুত প্রতিশোধ- হরমুজও একদিন গুম হয়ে যায়। কেউ কেউ মনে করে- পদ্মাই গিলে খেয়েছে হরমুজকে। তার লাশও পাওয়া যায়নি। পায়নি কোনো গোসল দাফনকাফন।

চলতি বছর বন্যার পানি হুহু করে বাড়ছে। গত তিন চার দিনে গ্রামে পশ্চিমপাড়ে ভাঙ্গন চলছে। গতকাল বিকেলে আফসার ফকিরের কবরের অর্ধেকটা ভেঙে গেছে নদীতে। লাশের কাফনের কাপড়ের কিছু অংশ বের হয়ে আছে। মসজিদের বড় হুজুর ফজরের নামাজ পড়ে পদ্মার শীতল হাওয়া গায়ে মাখে রোজ। রোজকার মত আজও বড় হুজুর হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ায় আফসার ফকিরের কবরের পাশে। তাঁর হাঁকডাকে আকবরসহ গ্রামবাসী জড়ো হয় আফসারের কবরের পাশে। জ্ঞানী গুণী ও হুজুরদের আলোচনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কবর থেকে তাকে তুলে আনে সবাই। একদম বাইশ বছর আগের মতই আছে লাশটা! শুধু সাদা মার্কিন কাপড়টা ধূসর হয়ে গেছে। আফসার ফকিরের পাশে জবান আলী তসবিহ গুনতে গুনতে বলে, 'বড় হুজুর না দেখলে ত আফসারের লাশ আজক্কা গাঙে ভাইস্যা যাইত। আল্লাহর এই কুদরত তাইলে কি আমরা দেখতে পারতাম! সুবহানাল্লাহ। সব মাবুদের লীলাখেলা!'

কেউ কবর খুঁড়ছে। কেউ বাঁশ কাটছে। আকবর আলী এখনো তার বাবার পায়ের কাছে বসে আছে। গ্রামের নতুন কবরস্থানের জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে মধ্যপাড়ায়। পরম মমতায় আফসার ফকিরকে দাফনের জন্য বাঁশগাড়িয়াবাসী প্রস্তুত। খাটিয়ায় আবার উঠেছে আফসার ফকির। মনে হচ্ছে আফসার ফকির সবার সামনে সামনে হাঁটছে। আর পুরো বাঁশগাড়িয়া গ্রাম তার পিছু পিছু হাঁটছে। কাঁদছে।

রফিকুল নাজিম
পলাশ, নরসিংদী