অটোয়া, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪
কানাডা ইমিগ্রেশনঃ ফিরে দেখা ২০২০ - মাহমুদা নাসরিন

তকাল ছিল হ্যালোইন। টরেন্টোতে এবারই প্রথম ড্রাইভ থ্র্রু হ্যালোইন হয়েছে,  সিপি ২৪ চ্যানেলে খবরে দেখলাম। হেমন্তের এই সুন্দর পড়ন্ত বিকেলে প্রকৃতিতে শুধু রঙের খেলা, বাহারি পাতা আর হ্যালোইনের সাজে সেজে আছে গোটা শহর।  কিন্তু কি যেন এক বিষন্নতায় ঘিরে আছে সবার মন- টরেন্ট, কানাডা, বাংলাদেশ, আমেরিকা সহ সারা পৃথিবী জুড়ে এই বিষন্নতা। কভিড -১৯ এই বছরের মার্চ মাস থেকেই সবার মধ্যে নিয়ে এসেছে এক মহা আতঙ্ক।  যে আতঙ্কের এখনো কোনো শেষ নেই- সেকেন্ড ওয়েভ চলছে সব খানে। অথচ কত নতুন আশা আর স্বপ্ন নিয়েই না শুরু হয়েছিল ২০২০!
     মার্চের ১২ তারিখে যখন কানাডার ইমিগ্রেশন মিনিস্টার ২০২০-২০২২ এই তিন বছরে  এক মিলিয়ন বা দশ লক্ষ অভিবাসী আনার পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন, তখন স্বাভাবিক ভাবেই সবার মতো আমিও খুব খুশি হয়েছিলাম।  এর পরপরই কভিড -১৯ শুরু হয়, সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।  পিআর  হিসাবে ল্যান্ডিং ২০২০ এর আগস্ট এ ২০১৯ এর তুলনায় ৬৪% কমে যায়। ইমিগ্র্যাশন কানাডা ঠিক কতজন ২০২০ এ পিআর হিসাবে ল্যান্ড করতে পেরেছে সে তথ্য সুনির্দিষ্ট ভাবে প্রকাশ করেনি; তবে তারা বলছে টার্গেটের ৩ লক্ষ ৪১ হাজারের অর্ধেককে হলেও তারা কাজ করে যাচ্ছে পিআর হিসাবে আনার।   হেলথ এন্ড সেফটি  ফার্স্ট, আর তাই ট্রাভেল রেস্ট্রিকশন এবং ম্যান্ডেটরি কোয়ারেন্টাইন থাকাতে, সর্বোচ্চ ৭২ ঘন্টা আগের কভিড নেগেটিভ  টেস্টিং রিপোর্ট বাধ্যতামূলক হওয়ায়  ইমিগ্রান্টদের ল্যান্ডিং অবশ্যই অনেক অনেক কমে গেছে। আমাদের সবার দৈনন্দিন  জীবন থেকে কত পার্বণ, কত পরিকল্পনা, কত স্বপ্ন, কত উৎসব উঠে গেছে।  আমাদের কত কাছের মানুষ মারা গেছেন, অসুস্থ হয়েছেন এই মহামারীতে।  মোটামুটিভাবে কারো কোনো পরিকল্পনাও আর ঠিক থাকেনি।  মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক, ম্যান প্রপোজেস গড ডিসপোসেস। স্রষ্টার ইচ্ছার উপরে কারো কোনো হাত নেই।   
     পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডা- বিশাল আয়তনের দেশটিতে একমাত্র আদিবাসী অল্পকিছু মানুষ ছাড়া সবাই অভিবাসী।  আদিবাসীদের পূর্বপুরুষরাও রেড ইন্ডিয়ান নামে  খ্যাত -অর্থাৎ তাঁদের পূর্বপুরুষরাও এসেছিলো অন্য দেশ থেকে। সে যাই হোক- আমরা সবাই সেটলার, আদিবাসীদের জায়গা দখল করে নিয়েছি, আমরা তাঁদের কাছে ঋণী, তাঁদের প্রতি আমাদের অনেক দায়বদ্ধতা রয়েছে- সে অনুযায়ী আমাদের কাজ এবং পরিকল্পনা করা উচিৎ।  ইমিগ্রান্টরাই তাই এই দেশটির চালিকা শক্তি।  এদেশে জন্ম হার বাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও সফল হওয়া যাচ্ছে না, বয়স্ক লোকজনের সংখ্যাই এখানে বেশি। কভিড -১৯ এর সময় কানাডা যেভাবে  মানবিকতা, বিজ্ঞান, আর বিচক্ষণতার  মাধ্যমে  কানাডিয়ানদের সুরক্ষার চেষ্টা করছে,  যেভাবে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট, ভিসিটর, ওয়ার্কার, রেফুজিদের সঙ্গে আচরণ করেছে কূটনৈতিকভাবে প্রতিবেশী দেশ আমেরিকা, বিতর্কিত  চায়না এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যেভাবে  সহঅবস্থান  করেছে  তা কানাডার অবস্থানকে বিশ্বে আরো মহিমান্বিত করেছে। আর তাই, কানাডায় অভিবাসনের ইচ্ছা সারা বিশ্বে আরো বেড়ে গেছে। এই ইচ্ছায় আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে গত ৩০ অক্টোবর কানাডার ইমিগ্রেশন মিনিস্টার মার্কো মেন্ডিচিনুর  ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বারো লক্ষ তেত্রিশ হাজার অভিবাসী আনার ঘোষণা।  এই পরিকল্পনায়  বড়ো  বড়ো  সিটিগুলোর বাইরে সুনির্দিষ্ট কম জনসংখ্যাবহুল এলাকায় সেখানকার সুনির্দিষ্ট চাহিদা অনুযায়ী যোগ্য ইমিগ্রান্টদের আনা  হবে।  আগামী তিন বছরে ৬০% নেয়া হবে স্কীলড ইমিগ্রান্ট - এক্সপ্রেস এন্ট্রি, পিএনপি, এগ্রিফুড পাইলট প্রোগ্রাম,  রুরাল এন্ড নর্থার্ন এবং মিউনিসিপাল পাইলট প্রোগ্রামের মাধ্যমে।  ফ্যামিলি ক্লাস, রেফিউজি স্পনসরশিপ, হিউম্যানিটেরিয়ান এন্ড কম্পাশনেট  এবং এসাইলাম ক্যাটেগরিতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে । তাঁর  টার্গেট এইরকম-
২০২১ সালে - ৪০১,০০০ জন অভিবাসী,
২০২২ সালে - ৪১১,০০০ জন অভিবাসী, 
২০২৩ সালে - ৪২১,০০০ জন অভিবাসী আনার পরিকল্পনা আছে।
     কানাডার ইতিহাসে এযাবতকালের সবচেয়ে বেশি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা এটি।  একমাত্র ১৯১৩ সালে কানাডাতে ৪ লাখ ১ হাজার ইমিগ্রেন্ট আনা হয়। কানাডিয়ানদের স্বাস্থ্য সেবা সহ  ইনফরমেশন টেকনোলজি, ফুড সেক্টর, এগ্রোফুড এবং ফার্মিং সহ  অন্য সব ক্ষেত্রেই কভিড -১৯ এর ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে কানাডার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে, নতুন জব সৃষ্টির জন্য বেশি বেশি সংখ্যায় ইমিগ্রান্ট আনা  ছাড়া কোনো উপায়ই নেই।
     মেন্ডিচিনুর এই ঘোষণায় কানাডার ভিতরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকেই বলেছেন  কানাডা নিজেই যেখানে কভিড -১৯ এর কারণে বিশাল অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে তখন কি দরকার বাইরে থেকে লোক আনার? কভিড -১৯ কানাডার পলিসি মেকারদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে- কানাডায় জনবল কত  দরকার, আর তাই কানাডা তার নিজের প্রয়োজনেই অভিবাসী আনবে এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।  কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- শুধু পরিকল্পনা করলেই তো হবে না, তার সঠিক বাস্তবায়ন তো করতে হবে।  আর তা করতে গেলে যুগোপযোগী আধুনিক ব্যবস্থা নিতে হবে, অভিবাসনের আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘ সূত্রিতা কমাতে হবে, সর্বোপরি ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা কমানোর জন্যে  জনবল বাড়াতে হবে। 
     কানাডিয়ান ইমিগ্রেশনের দীর্ঘসূত্রিতা কভিড-১৯ এর আগে থেকেই ছিল।  আর এ নিয়ে হতাশার কোনো শেষ নেই।  হিউম্যানিটেরিয়ান এন্ড  কম্পাশনাট  গ্রাউন্ড এপ্লিকেশন প্রসেসিং টাইম ৩৬ মাস, ৫০০০ স্পাউসল স্পনসরশিপ অ্যাপ্লিকেশনস ঝুলে আছে তিন  বছরের বেশি সময় ধরে।  আর তাই সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখে কানাডার এডমন্টন, মন্ট্রিয়ল, অটোয়া, টরন্টো, ভ্যানকুভার সহ বিভিন্ন শহরে ভালোবাসার প্রতীক লাল পোশাকে স্বজ্জিত  হয়ে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী প্রতিবাদ  জানায়। এনডিপি লিডার জেনি কাউয়ান ইমিগ্র্যাশন মিনিস্টারকে বিশেষ চিঠি দিয়ে দাবি করেন হাজার হাজার স্পাউসল স্পনসরশিপ অপ্প্লিকেন্টদের বিশেষ টেম্পোরারি রেসিডেন্ট ভিসা দেওয়ার জন্য।    ইমিগ্রেশনের সরকারি ওয়েবসাইট আনুমানিক প্রসেসিং টাইম দেয়া থাকে। সেখানে নোটিস দেয়া আছে পান্ডামিকের  এর জন্য সঠিক প্রসেসিং টাইম দেয়া সম্ভব  নয়।  কভিড এর আগেই কানাডিয়ান সিটিজেনশিপ এপ্লিকেশন প্রসেসিং এ এক বছর সময়  লাগতো, পান্ডামিকের  সময় প্রথম ভার্চুয়াল সিটিজেনশিপ  অথ টেকিং হয়।  ইমিগ্র্যাশন ইন্টারভিউ ভার্চুয়াল হওয়া  উচিত অন্যথায় কানাডিয়ান ইমিগ্র্যাশন টার্গেট এবং প্রসেসিং ডিলেই শুধু বাড়বে। আশা করি ইমিগ্র্যাশন রিফিউজিস এন্ড সিটিজেনশিপ কানাডা অতি দ্রুত জনবল বাড়িয়ে, ডিজিটালাইজেড মডার্ন সিস্টেম  ইমপ্রুভ করে ইমিগ্র্যাশন টার্গেট  ফুলফিল করবে অতি দ্রুত। আসুন পসিটিভ চিন্তা করি- সবাই ভালো থাকি আর ভালো রাখি সবাইকে। ছোট্ট এই জীবনের চাওয়া পাওয়া খুব বেশি নয়।

মাহমুদা নাসরিন। টরেন্টো, কানাডা 
লেখক: মাহমুদা নাসরিন, প্রিন্সিপাল কনসালট্যান্ট, ক্যানবাংলা ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস, ২০৫/৩০৯৮ ড্যানফোর্থ এভেনিউ, টরেন্টো, শিক্ষক ও সমাজকর্মী। সাবেক সহযোগী অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ও কিং খালেদ বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব। nasrinmahmuda8@gmail.com