অটোয়া, মঙ্গলবার ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
কোভিড নাইনটিন: পারিবারিক দায় ও শিক্ষার্থীর মনোজগত - ড. শাহনাজ পারভীন

র্তমান পেণ্ডামিক সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আগের মতো আর ঘড়ি ধরে কলেজে যাওয়া আসা হয় না। অনেকটাই এলোমেলো, ইচ্ছেমতো। আজও বেলা সাড়ে দশটায় ক্যাম্পাসে ঢুকতেই দেখি রুমের সামনে এক দঙ্গল ছাত্রীদের জটলা। কতদিনের প্রিয়মুখগুলো রুমে আমাকে না দেখে অনিশ্চয়তার দোলাচলে দুলছিলো। আমাকে দেখেই তারা ঝলমল করে উঠলো। কি এক নান্দনিক দোলায় আমিও দুলে উঠলাম। সত্যি কথা বলতে কি, আমিও তো এই ছুটিতে পানির মাছ ডাঙায় তোলার মতো ছটফট করছি। আগে একটি নির্দিষ্ট সময় ছিলো। ঘড়ি ধরে আসা যাওয়া ছিলো প্রতিষ্ঠানে। দেখা হতো প্রতিদিন প্রিয় ছাত্রীদের সাথে। অথচ বর্তমান কোভিড নাইনটিনের প্রকোপে কতদিন তাদের সাথে আমার ঠিকঠাক দেখা নেই। আসলে আমরা যারা শিক্ষকতা করি, শুধু তারাই জানি, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি শিক্ষকদের দায়বদ্ধতা, মায়া, আদর- স্নেহের সম্পর্কের মাপকাঠি। প্রিয় ছাত্র-ছাত্রী আজীবন শিক্ষকদের মনের মনিকোঠায় জ্বলজ্বল করে, প্রতিষ্ঠিত থাকে। তাদের উজ্জ্বল অবস্থানে গর্বিত হয়। আজীবন তাদের মঙ্গল কামনা করে। ভালো চায়। একজন প্রিয় শিক্ষকও ছাত্র-ছাত্রীদের মনে আজীবন এমনভাবেই প্রতিষ্ঠিত থাকেন।

প্রতি বছর যখন ইন্টারমিডিয়েট, ডিগ্রী, অনার্সের ফাষ্ট ইয়ারে নতুন নতুন ছাত্র- ছাত্রী ভর্তি হয়, তখন এই সমস্ত নতুন, নবীন ছাত্র ছাত্রীদের মতো আমরা- শিক্ষকরাও নবীন হয়ে উঠি। তাদের সাথে মিশে যাই, মিশে থাকি আন্তরিকতায়। তাই যতই আমাদের সার্টিফিকেটের বয়স বাড়ুক না কেন, আমাদের বয়স যেন সেই আঠারোতেই আটকে থাকে আজীবন। আমরাও তাদের মতোই মনে প্রাণে সবুজ, অবুঝ থেকে যাই। আর আমি একটু বেশিই যেন, ভাইস প্রিন্সিপাল হবার সুবাদে প্রতিষ্ঠানের সব ছাত্রীই আমার ছাত্রী। শুধু কোনো বিষয় কিংবা বিভাগের নয়। তাদের প্রয়োজনের তাগিদে প্রতিটি ছাত্রীর সাথেই আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। 
আমার মেয়েরাও বলে, মা তুমি সেই ছোট্টটিই থেকে গেলে আজীবন। বড় হলে না আমাদের মতো। ছোট মেয়ে আরও একটু আদর করে বলে, তুমি তোমার মতই থাকো, বড় হয়ো না মা, কোনদিন। বড় হওয়ার দরকার নেই তোমার।  তোমার এই ছোটটিই আমরা দেখে যেতে চাই আজীবন। 
এই সব সাত পাঁচ চিন্তা করতে করতে  রুমে ঢোকার সাথে সাথেই খলবল করতে করতে জীবন্ত মাছগুলো যেন জাল থেকে ছাড়া পায়। একে একে রুমে ঢোকে সবাই। 

ম্যাম কেমন আছেন? -আরে তোমরা, কেমন আছো? একসাথে! ভালো আছো তো সবাই? জ্বী ম্যাম, ভালো আছি। আমরা আজ সবাই যুক্তি করে একসঙ্গে চলে এলাম কলেজে। আপনাকে দেখতে। কতদিন দেখা হয় নি আপনার সাথে? কবে খুলবে কলেজ, ম্যাম? তোমরা জানোই তো, সব খবর তো বাড়ি বসে পেয়েই যাচ্ছো। ফেসবুক, খবরের কাগজ, ইন্টারনেটে। সবাই তো খুব যত্ন সহকারে বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে। তারপরও কেন, এই পেণ্ডামিক সময়ে সবাই এক সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছো? একটু যেন হালকা ধমক দিতে চাই ওদের। 

না ম্যাম, জানি তো কলেজ এখন বন্ধ, কবে খুলবে তা সরকার আবার ঘোষণা দিবে, বলবে। তারপরও এলাম আপনাকে দেখতে, কলেজ দেখতে। কত্তোদিন ক্যাম্পাসে দৌঁড়াদৌঁড়ি করি না! খুব ভালো লাগছে এখন। কত্তোদিন দেখিনা, আপনাকে, কলেজকে! বাসায়, ঘরে বন্দি থেকে থেকে আমরা একেবারে হাঁপিয়ে উেিঠছি ম্যাম। তাই আজ সবাই একসঙ্গে এলাম।

আহা! মনটা আমারও কিছুটা শান্ত হয়। কিন্তু মুখে কিছু বলি না, ঠিক আছে সাবধানে থেকো। পড়াশোনা করছো তো, ঠিকমতো? ক্লাস গুলো দেখছো তো রেগুলার। জ্বী ম্যাম সবই ঠিক আছে। তারপরও। 

কিছুক্ষণ পর এলো আর এক অভিভাবক। ম্যাডাম, বইগুলোর যদি একটু নাম লিখে দিতেন? 
 -কোন বইয়ের? সবগুলো বইয়ের। আমাকে চিনতে পারেন নি?  মেয়ের ভর্তির সুমায় আমি আসলাম। হ্যা, চিনেছি তো। আপনি সোনালির বাবা। জ্বী ম্যাডাম। 
মেয়ে ক্লাস করছে না? অনলাইনে সব ক্লাস তো হচ্ছে। ক্লাসেই তো সব স্যার ম্যাডাম বইয়ের নাম বলে দিচ্ছেন।
না ম্যাডাম। মেয়ের ঐ দামী মোবাইল নাই। কোথায় পাবো, জানেন তো খেটে খাওয়া মানুষ আমি। কত কষ্ট করে সংসার চালাই। নেট কেনার অত টাকা খরচ করার মতো টাকা পাবো কোথায়? বাড়িতে ওসব কিছু নাই।
বইগুলোর নাম লিখে দিলে আমি পুরনো বই এক সেট কিনে দিতাম। বাড়ি বসেও তো পড়তে পারতো মেয়েটা।
তা ঠিক। আপনি বসুন। 

এই হচ্ছে আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছেলেমেয়েরা ঘরে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে। আর এক শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রী আছে, যারা নিম্নবিত্ত। এনড্রয়েড ফোনসহ বাড়িতে ওয়াইফাই কানেকশান সত্যি তাদের সাধ্যের বাইরে! কিন্ত উপায়ও তো  নেই। কারণ পৃথিবীতে কোন কিছুর চেয়েই জীবনের দাম কম নয়। যে কোন কিছুর চেয়েই জীবনের দাম অনেক বেশি বিধায় বর্তমান সচেতন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী অনেক সচেতনভাবে শিক্ষার্থীদেরকে সাবধানে রাখছেন। দেশের অন্য সব অফিস, আদালত খুলে দিলেও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলেন নি এখনও। 
যেমনটি সরকার আশংকা করছিলো, ঠিক তেমনিই শীতের প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে আবারও দফায় দফায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ, আতংক এবং মৃত্যূর হার। 
গত ১৭ নভেম্বর  দেশে ২ হাজার ২১২ জন নতুনভাবে সনাক্ত হয়েছে। মৃত্যূ হয়েছে সর্বোচ্চ ৩৯ জনের। গত ৭৬ দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। গত এক মাসের মধ্যে এই মৃত্যূহার সবচেয়ে বেশি। বিশ্বেও সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে এইদিন। দশ হাজার আটশত ষোল জন কোভিড নাইনটিনে প্রাণ হারিয়েছে। 
বিশেষজ্ঞদের মতে, শীতে বাতাসের আদ্রতা কমে যাওয়ায় হাঁচি, কাশির মাধ্যমে বেশি মানুষকে এই করোনা আক্রান্ত করেছে। অথচ, দেখা যাচ্ছে রাস্তাঘাটে, বাসে, ট্রেনে, মানুষ ঐভাবে আর সচেতনভাবে যাতায়াত করছে না, পরছে না মাস্ক। রাখছে না সামাজিক দুরুত্ব। প্রতিদিনই অনুষ্ঠিত হচ্ছে থমকে থেমে থাকা বিভিন্ন আয়োজন, অনুষ্ঠান। করোনা শুরু হবার পর থেকে আমরা দেখেছিলাম, বিভিন্ন মিটিং, সভা, সাহিত্যের আলোচনা,  অনুষ্ঠান সবকিছুই ভার্চ্যুয়াল হচ্ছিলো। কিন্তু সংক্রমণ, মৃত্যূহার কমবার সাথে সাথে ভার্চ্যুয়াল সভাগুলো সীমিত আকারে পারষ্পরিক দূরুত্ব বজায় রেখে সরাসরি আয়োজন করবার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত তা আর ঐভাবে সীমিত থাকছে না। একেবারে আড়ম্বরের সাথে শেষ পর্যন্ত গণজমায়াতে পালিত হচ্ছে। ফলে যেই আশংকা করে এখনও পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করা হয় নি, সেই আশংকাই বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে। 
রাস্তাঘাট দেখে আর আগের মত বোঝার সুযোগ নেই যে, দেশে পেণ্ডামিক চলছে। জেলা প্রশাসন মিটিং করে বারবার মাস্ক পরার কথা ঘোষণা করছে। মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডাসহ অফিস, আদালত সব জায়গায় কড়াকড়ি আরোপ করছেন। জরিমানার কথা বলছেন। 'নো মাস্ক নো সার্ভিস' শ্লোগানে ইতিমধ্যেই সমস্ত অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানববন্ধন হয়ে গেলো।
কিন্তু সাধারণ জনগণ এ ব্যাপারে সত্যিকার অর্থেই সচেতন কিনা তা তাদের আচরণ দেখে বোঝার কোন উপায় নেই। আগের মতোই মার্কেটগুলোতে উপচে পড়া ভিড়, ভিড় লেগে গেছে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র গুলোতে। অথচ সরকার বারবার মানুষকে সতর্ক করছে, তবুও তারা বড্ড অসচেতনতার পরিচয় দিচ্ছে। 
কোভিড নাইনটিন এর এই সময়ে শিক্ষার্থীরা মোবাইল এবং টিভিতে বেশি সময় দিচ্ছে যা তাদের জন্য বিভিন্ন রকম ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। ইন্টারনেটের এই ভাচ্যুয়াল সময়ে কিশোর কিশোরীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে অনৈতিক সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের ইতি টানতে খেসারত দিতে হচ্ছে তাদের মান, সম্মান। অনেকাংশে জীবনও। সমাজ এবং পরিবারের মধ্যে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। মনোজাগতিক প্রভাবের ফলে তৈরি হচ্ছে মনোবৈকল্য। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা এক অসম সময় পার করছে। আমরা যারা শিক্ষক, আমরা যারা অভিভাবক আমাদের উচিৎ তাদের সাথে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া। তাদেরকে বোঝা, তাদেরকে বোঝানো। তাদের হাতে বিভিন্ন ধরনের বই, পত্রিকা, সেলাইয়ের সরঞ্জাম তুলে দেওয়া। মনে পড়ে, আমাদের ছোট বেলায় আমরা নানান ধরনের সেলাই, ক্রুশ কাটার ব্যবহার করেও অনেকটা সময় কাটিয়ে দিতাম। তেমনি বর্তমান শিক্ষার্থীরাও যেন, পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণসহ কো-কারিকুলাম সমৃদ্ধ পাঠেও অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। তাহলেই এই স্থবির সময়টা তাদের সহনীয় হবে। সময়টাকে তারা উপভোগ্য করে কাজে লাগাতে পারবে এবং পরিবারকে রাখতে পারবে নিশ্চিন্ত, নির্ভাবনায়।

ড. শাহনাজ পারভীন
লেখক: কবি, গবেষক, উপাধ্যক্ষ, উপশহর মহিলা কলেজ, যশোর।