অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
শান্তির পারাবার - তরুণ শিকদার

হ্যাঁ, আমার আসার কথা ছিল
ঠিক পাঁচটায় মনভরা নদীর তীরে
সেই কৃষ্ণচূড়ার তলে।
যেখানে প্রতিদিন আমার আগে তুমি আসতে
একদিনও এতটুকু অনুযোগ করার সুযোগ দাওনি
যত কাজ থাকুক না কেন
করপোরেশনের ঘড়ির কাঁটায় ঢং ঢং করে ৫টা বাজার সংকেত দিতেই
তুমি হাজির কৃষ্ণচূড়ার বার্ধক্যে ভরা শিকড়ের পরে।
শিকড়ে বার্ধক্য থাকলেও কৃষ্ণচূড়া কিন্তু টগবগে অনন্ত যৌবনা
এই চৈত্রের খাঁ খাঁ নিস্ফলা রোদের মাঝে
লালবর্ণের হাসির ফোয়ারা ছড়িয়ে জিতে নিয়েছে সবার মন।
আমার পরনে ছিল রক্তলাল রঙের পাঞ্জাবী
তুমিই বলেছিলে পরে আসতে
যা গত বৈশাখে তোমার দেওয়া
কাঁধে ছিল নীলাভ উত্তরীয়
তোমারও সেদিন লাল টুকটুকে শাড়ি পরার কথা ছিল।
আমার সেই চিরায়ত দেরী
ঘড়ির কাঁটা কখন পাঁচটা ছুঁয়েছে টেরই পাইনি
চণ্ডাল বসটি যেন আজই সব কাজ শেষ করতে চায়।
আপিস থেকে বেরিয়ে ছুটছি, ছুটছি আর ছুটছি
দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে ঝড়ো গতিতে রাস্তা পার হতে পা বাড়ালাম
ব্যাস একটা তীব্র শব্দ জগতের আর কিছু মনে নেই।
মুহূর্তে পাঞ্জাবীর লেবাস ছেড়ে বেরিয়ে এলাম
পাঞ্জাবীর লাল রঙ আর আমার টগবগে রক্ত মিলে মিশে একাকার
আমার নিথর দেহটি তোলার আগে
একদল যুবক সবগুলো গাড়ি ভেঙ্গে তসনস করে দিল
চার দিকে শুধু আগুন আর ধ্বংসের স্তুপ।
ড্রাইভারের অর্ধমৃত দেহটি আমার পাশে শুইয়ে দিল
কতবার বললাম ওর কোন দোষ নেই আমারই ভুলে
কেউ শুনলো না সে কথা।
তোমার দেওয়া সখের পাঞ্জাবী, নিথর দেহ সব রাস্তায় ফেলে
আমি ছুটে এলাম তোমার কাছে
তুমি প্রতিদিনের মত মনভরা নদীর স্বচ্ছ জলের পানে নির্বাক চেয়ে আছো
আমি তোমার পাশে বসলাম
তুমি নির্লিপ্ত
কোনদিন তোমার গা ছুঁয়ে দেখিনি
আলতো করে তোমার হাতে হাত রাখলাম
তুমি নিঃশব্দ কোন সাড়া দিলে না
অনেক চেষ্টা করেও তোমার দৃষ্টি ফেরাতে পারলাম না।

(২)
হঠাৎ এক কিশোরী আমার হাত ধরে বলল
চল আমাদের যেতে হবে
দেখছ না সবাই কি দ্রুত ছুটছে
কোথায় যাব, ওরা কারা
কিশোরী বলল তাতো জানিনা কিন্তু যেতে হবে
বললাম তুমি কে?
সে বলল আমি নুসরাত, ধর্ষণের শিকার
আমার শিক্ষক আমাকে পুড়িয়ে মেরেছে।
ওরা কারা একসাথে লক্ষ লক্ষ মানুষ?
ওরাও আমাদের মত
কেউ ধর্ষণের শিকার, কেউ বর্ণবাদ,
সাম্প্রদায়িকতা বা অপরাজনীতির বলি,
কেউ ছলনাকারী পরকীয়ার বলি
কেউবা ধর্মান্ধতা আর তোমার মত রাস্তায় দুর্ঘটনার শিকার।
আর ওই যে সবচেয়ে বড়
দলটি ওরা কোভিড-১৯ এর শিকার ওরা তিন মিলিয়ন
চল আর দেরী করো না দ্রুত যেতে হবে
নইলে দরজা নাকি বন্ধ হয়ে যাবে।
আমি বিস্ময়ে বলি এখানেও দরজা!
এই উন্মুক্ত পারাবারে কে দেবে দরজা
তাতো জানি না! কিন্তু যেতে হবে।
পৃথিবীর মায়া ছেড়ে।
কিন্তু আমার জন্য যে ও অপেক্ষা করছে
দেখ ওই কৃষ্ণচূড়ার তলে লাল টুকটুকে শাড়ি পরে
কত ডাকলাম কিন্তু আজ সাড়া দিল না অভিমানী
অথচ আমার জন্য সেই ৫টা থেকে বসে আছে।
থাকতে দাও এভাবেই পথের ভিন্নতা তৈরী হয়
সবকিছু ছেড়ে চলে আসতে হয় একদিন
সেই সুদূরের পানে।
অপেক্ষার প্রহর শেষ হলে সেও খুঁজে নেবে অন্য পথ
তারপর হয়তো আবার দেখা হবে।
ওই অনন্ত শান্তির পারাবারে।

৮ এপ্রিল ২০২১, রাত ১.০০টা
তরুণ শিকদার
ঢাকা, বাংলাদেশ