বেলা সাঁঝের পাণ্ডুলিপি (দুই) - দীপিকা ঘোষ
(দুই) দিলদারের সংবাদটা শোনার পর থেকেই বন্ধুর বিপদে উতলা হয়েছেন প্রতাপ। কিন্তু সাহায্যের হাত প্রসারিত করার সামর্থ্য তাঁর ছিল না। অসহায়ভাবে তাই ভাবনার গভীরে তলিয়ে ছিলেন সন্ধ্যা থেকে। মনীশ কাল আবারও আসবেন বন্ধুর সংবাদ সংগ্রহ করে। সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ। মেঘে ঢাকা আকাশে একফালি চাঁদ বহু সময় ধরে লুকোচুরি খেলতে খেলতে সরে যাচ্ছিলো দূর থেকে আরও দূরে। পূবের প্রান্তকোণ ছেড়ে পশ্চিমের খোলা আঙিনায়। বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়িতে পা রাখছিলেন প্রতাপ। পেছন থেকে মোহিনী ছুটে এলো–
আজ আবার বাইরে হাঁটার কী দরকার? বারন্দাতেই একটু পায়চারি করুন না!
না মামণি একটু যেতে হবে। আজ সকালেও তো হাঁটা হয়নি। রেগুলার অভ্যাস না থাকলে …!
অভ্যাস আবার কী! রোজই তো দু’বেলা হাঁটছেন! এই বয়সে এক আধদিন না হাঁটলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না! বাইরে আজ ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে, সেজন্যই বলছি।
প্রতাপ ফিরে এলেন। কারণ পুত্রবধূর সব ধরনের আদেশ সর্বদা যে অমান্য করা চলবে না, সেটা কয়েক বছরে মর্মে মর্মে বুঝেছেন। মোহিনী তীক্ষ্ণ নজর ফেলে জিজ্ঞেস করলো-
আপনার কি শরীর খারাপ? কেমন ক্লান্ত দেখাচ্ছে!
নাঃ ঠিকই আছে!
কিচ্ছু ঠিক নেই! কাল চায়ের সঙ্গে জোর করে সিঙ্গারা খেলেন! এই বয়সে একটু কন্ট্রোলের ভেতর না থাকলে চলে? আজ আবার মাসিকে বলেছেন, ডালের বড়া খেতে ইচ্ছে করছে!
খাইনি তো মামণি!
বানানো হয়নি তাই খাননি! বানালেই খেয়ে নিতেন!
প্রতাপ কথা না বাড়িয়ে টুকরো বারান্দার ওপরে নিঃশব্দে পায়চারি করতে শুরু করলেন। বুকের ভেতর অভিমানের ঢেউ উঁচু হয়ে আছড়ে পড়ে মনের দু’কূল ছাপিয়ে গেলো। দুপুরবেলা বাড়ি ঢুকে মাসির ডাল বাটার দৃশ্য চোখে পড়তেই তাকে থামিয়ে দিয়েছিল মোহিনী–
আবার ডাল পিষছো কেন মাসি?
ওই, দাদা একটু ডালের বড়া খেতে চাইলেন যে বৌমা!
নাঃ! ডালের বড়া আজ হবে না! সব তুলে রাখো! তোমায় শতদিন বলেছি না, আমায় জিজ্ঞেস না করে কক্ষনো বাড়তি কিছু রান্না করতে যাবে না? যা যা আজ রাঁধতে বলেছি, সেগুলোই শুধু রাঁধবে!
প্রতাপ খবরের কাগজ পড়তে পড়তে সবটাই শুনেছিলেন। প্রতিবাদ করেননি অবশ্য। বার্ধক্যের নির্ভরতায় জীবনের অভিমান, অপমানের স্তরগুলো জোর করে ঝেড়ে ফেলতে না পারলে আশ্রয়ের শক্ত ভিতটাই কেবল নড়বড়ে হয়ে যায়। একদিন সংসারে তাঁর কর্তৃত্ব ছিল। সম্মানের জৌলুস ছিল চেতনায়। আজ সবই শুধু স্মৃতির জীবাশ্ম। তারপরও তাদের ঘিরে জীবনের অবশিষ্ট যাত্রাপথ এখনও রোজ রোজ পেরুনো। রোজ রোজ ডায়েরি লেখা। ডায়েরির পাতায়- পাতায় নীরব অশ্রুতে একান্ত মনে পথ চলা। জীবনের যতকিছু স্বাধীনতা, স্বপ্ন কিংবা শৌখিনতা সবই এই ডায়েরির অবগুণ্ঠণে ঢাকা। সেখান থেকেই মাঝে মাঝে দু’চারটি পাতা খুলে নিয়ে পড়া। মাঝে মাঝে অনুভবের রূপেরসে মনের আস্বাদন নিয়ে সাঁতার কেটে বেড়ানো।
ফায়ার ব্রিগেডের ঘড়িতে উচ্চনাদে রাত নয়টার ঘন্টা বাজলো। চল্লিশ বছরের মধ্যে একদিনও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে অতি সম্প্রতি এই নির্দিষ্ট সময়েই যুক্ত হয়েছে একটি নতুন এডিশন। আধপাগলা দর্জি মোর্শেদ কুলির গান। বেশিরভাগই উর্দু কাওয়ালি। উর্দু নিজের মাতৃভাষা হওয়ায় মিঠে গলায় এতদিন অন্তর খুলেই গাইতেন মোর্শেদ। কিন্তু আজ একেবারেই অন্যধারার সঙ্গীতধ্বনি বাজলো তার কণ্ঠস্বরে। সম্ভবত স্বরচিত সঙ্গীত। মোর্শেদ কুলি গান ধরেছেন- ‘আলু ভাতে, বেগুন পোড়া, শুধু ডাঁটা চচ্চড়ি // আর পারি না খেতে দাদা, ছ্যাঁচরা, পোড়া তরকারি!’ শুনতে শুনতে প্রতাপের মনে হচ্ছে, সঙ্গীতের সুর নয়, অশ্রুর বিগলিত স্রোত গড়াচ্ছে দর্জির গলার ভাঁজে ভাঁজে। তার অর্থনৈতিক অবস্থা বহু বছর ধরেই সঙ্গীন। সংসারে আট নয়টি ছেলেমেয়ে। আয় রোজগার নেই। নতুন যুগের নিত্য নতুন ফ্যাশনের সঙ্গে পরিচিতি না থাকায় মোর্শেদ কুলির দোকানে খরিদ্দার নেই বললেই চলে।
পুরনো প্রতিবেশিরা জানেন, আগে পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। মোর্শেদ কুলির প্রথম পক্ষ চল্লিশ বছর আগে যখন মারা যান, ছেলে আনোয়ারের বয়স তখন দুই। শহরের বড় রাস্তার ধারে তার দর্জির দোকান থেকে রোজগার যতটুকু হতো, সংসারে তাতে স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব ছিল না। তবুও মোর্শেদ কুলির ঘরে দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রবেশ ঘটতে সময় পেরিয়েছিল দশ বছর। নতুন মায়ের উপস্থিতিতে আনোয়ারের জীবনে অবশ্য অনুকূল পরিস্থিতির উদয় হয়নি। বরং সাইক্লোন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বাধ্য হয়েই অনাহূতভাবে ছেলেটা আশ্রয় নিয়েছিল জ্যেঠার বাড়িতে। জ্যেঠার সংসারেও তখন স্বাচ্ছন্দ্যের জোয়ার ছিল না। ঘরে দুই স্ত্রী। দুই ঘরে গুটি গুটি অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। তবে আশ্রয় পেয়ে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল ছেলেটা। যদিও মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর সাহস সে কোনোদিন অর্জন করতে পারেনি। আজও সবার ফুটফরমাশ খাটা ছাড়া বিশ্বে দ্বিতীয় কাজ তার জানা নেই। প্রতাপ চোখ বুঁজে অভ্যাসমতো নিয়মিত মানব জীবনের আদ্যপান্ত বিষয় নিয়ে যেমন ভাবেন, দর্জির গান শুনে তেমনি অনেক দিনের পুরনো স্মৃতির প্রাঙ্গনে পায়চারি করছিলেন। হঠাৎ কপালের ওপর ছোট্ট নরম হাতের ঠাণ্ডা স্পর্শ লাগতে চোখ মেলে চাইলেন। দেখলেন, সামনেই তাঁর চার বছরের নাতনী এষা উৎসুক চোখে দাঁড়িয়ে।
কচি কণ্ঠে শোনা গেল–
দাদু, বাবা ডাকছে। শুয়ে আছো কেন? খাবে না?
কে জানে কেন, এই আহ্বানে হঠাৎ দাদুর বুকের নিচে অভিমানের পাহাড় জোয়ারজলের উঁচু ঢেউয়ের মতো ঠেলে উঠতেই চোখ ছলছলিয়ে এলো। ছোট্ট মানুষটি বিস্ময় নিয়ে তাকালো তাতে-
কাঁদছো কেন? তোমার কি জ্বর হয়েছে?
না দিদিভাই! কিচ্ছু হয়নি!
তাহলে কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভয়ের স্বপ্ন দেখছিলে?
হুঁ!
কী দেখছিলে?
এই যাঃ! একদম ভুলে গেছি!
কেন ভুলে গেছো?
ভুলে যাই বলেই তো বেঁচে থাকি! বেঁচে থাকতে পারি! কী বললাম, কিছু বুঝলে?
এষা দু চোখে বিস্ময় ঢেলে দু পাশে মাথা ঘোরালো কয়েকবার। দাদু স্বগোক্তির মতো উচ্চারণ করলেন – এখনও যে বোঝার সময় হয়নি দিদিভাই! বড় হলে ঠিক বুঝবে! তবে প্রাণভরে আশির্বাদ করি, এসব বিষয় কখনোই যেন তোমাকে বুঝতে না হয়!
বুঝতে না হয়? কেন দাদু? আচ্ছা তাহলে মাকে বলো! বাবাকে বলো! দাদাকে বলো!
তোমার মতো দাদাও এসব বুঝবে না!
দাদুর শেষ কথাটায় খুশি হয়ে কচি মুখে হাসলো এষা। দাদা তার থেকে দুই বছরের বড়। তবুও সবক্ষেত্রেই দাদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার যে হেরে যাওয়া চলবে না, এই অভিমানটুকু তার ছোট্ট বুকের ভেতর এরই মধ্যে বাসা তৈরি করে ফেলেছে। হেসেই তাই জিজ্ঞেস করলো-
মা বুঝবে? বাবা বুঝবে?
হ্যাঁ। তারা চেষ্টা করলেই বুঝবে!
প্রতাপ আর কথা বাড়ালেন না। যদিও এই শিশুটির কাছে তিনি মনোজগতের কিছু কিছু ভাব কখনো সখনো প্রকাশ করে ফেলেন। সে কি এষা বোঝে না বলেই? নাকি এষাকে যে মাঝে মাঝে তাঁর মরুভূমির জীবনজুড়ে মরুদ্যানের মতো মনে হয়, সেই কারণে? আহা! এমন সারল্যভরা সুখ তাঁর শৈশবেও তো ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু এখন প্রয়োজন হলে যন্ত্রনার ক্লিষ্টটা থেকে মুক্তির জন্য আকুল হয়েও, পবিত্রতায় ভরপুর সেই সতেজ সবুজ শৈশবকে আর ছুঁতে পারেন না প্রতাপ। ছুঁতে গেলে ভাবনার ভাঁড়ামিটাই কেবল গুলিয়ে ওঠে বারবার। দাদু নাতনীর কথায় বিছানা থেকে নেমে ডাইনিং টেবিলে এসে বসলেন। আজ তাঁর জন্য টেবিলে খুব সহজপাচ্য খাবার রেখেছে মোহিনী। পথিকের চোখে পড়তেই বিস্ময় নিয়ে তাকালো-
এ কী! বাবার জন্য কেবল স্যুপ রেখেছো কেন? খানিক পরেই ক্ষিধে পাবে যে!
তার স্ত্রী গম্ভীর মুখে বললো–
পাক! বুড়ো বয়সে সবকিছুই কন্ট্রোলে থাকা ভালো! ওনার শরীর আজ ভালো নেই!
পথিক ব্যাকুল হয়ে উঠলো -
বাবা, তোমার শরীর খারাপ? কী হয়েছে? কই কিছু বলোনি তো?
আমি তো জানিনে আমার শরীর খারাপের কথা! মামণি কী দেখে বলছে কে জানে! কিচ্ছু হয়নি আমার! আমি রোজ যেমন খাই, তাইই দাও আমাকে!
হলেই বা আপনি বলবেন নাকি? বিছানায় পড়ে থাকলে কে দেখবে? চারদিকে আমার হাজার গণ্ডা কাজ! সারাদিন ছুটোছুটি! ওদিকে আপনার এসিডিটির প্রবলেম, হাই প্রেসার, কলেস্টেরলের প্রবলেম, তবুও খাওয়া দাওয়া কন্ট্রোল করবেন না!
আমার সবকিছু কন্ট্রোলেই আছে মামণি! কারণ আমি কোনো ব্যাপারেই অসংযমী নই! নিজের দেহের খবর নিজের চেয়ে ভালো আর কে জানবে?
পথিক স্ত্রীর বাড়াবাড়িতে এবার একটু উত্তপ্ত হলো-
কেন কথা বাড়াচ্ছো? দুখানা রুটি, মাছ, তরকারি খেলে অসুবিধে কী হয় আমি তো বুঝতে পারছি না!
উত্তরে মোহিনীর গলার স্বরে আলোড়ন ঝরে পড়লো-
তোমার বোঝার দরকারটা কী? যেগুলো বোঝা দরকার, সেগুলোই বুঝতে পারো না, তাতে আবার…! সব ব্যাপারে মাথা ঘামাতে এসো না! কাল যে বলেছিলাম, অফিস থেকে ফেরার পথে প্রান্তিকের দুধের কৌটো নিয়ে এসো, তার কী হলো? তোমার কি অজানা নাকি ছেলেটা রেগুলার গরুর দুধ খেতে পারে না? তবু বারবার এক কথা রোজ কেন মনে করিয়ে দিতে হয়?
পথিক নীরব হয়ে রইলো। মোহিনীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডা করার ইচ্ছে কিংবা স্পর্ধা কোনোদিন তার ছিল না। আজও নেই। এসব মুহূর্ত এলেই মৌনতার ভেতর দিয়ে প্রতাপ মৃতা স্ত্রীর বড় অভাব বোধ করেন। অলকা অযৌক্তিক কথার ঘায়ে স্বামীকে এভাবে কখনো আঘাত করতে চাইতেন না। তাঁর পছন্দ অপছন্দের সব খুঁটিনাটি বিষয়কে ভালোবেসে নীরবে মূল্য দিতেন। প্রতাপের স্বভাব চাপা। অযথা কারুর নিন্দে করার অভ্যাস নেই। সেজন্যই অলকা সচেতন থাকতেন স্বামীর অভ্যাসগুলো কারুর অবহেলার আঘাতে কখনো যাতে ভারাক্রান্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে। কিন্তু এখন বেদনা, দুঃখ, অভিমান যাইই কেননা বুকের তলায় উতরোল হয়ে ঝড় তুলুক, অফুরান সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ হয়ে শেষ অবধি নিঃশব্দে তাঁর হৃদয়প্রান্তেই মিলিয়ে যায়। চলবে...
দীপিকা ঘোষ। যুক্তরাষ্ট্র
-
গল্প//উপন্যাস
-
01-06-2021
-
-