অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
রূপসী বাংলার কবির বসত ভিটা - তপন রায়

রিশাল শহরেই জন্ম ও বড় হওয়া কবি জীবনানন্দ দাশের। কিন্তু সন্ধান পাওয়া দুষ্কর হলো তাঁর পৈত্রিক ভিটার। জনে জনে জিজ্ঞেস করে সন্ধান নিয়ে 'জীবনানন্দ দাশের বাড়ি'র ছবি নিলাম উৎসাহ নিয়ে। ধ্বংসোন্মুখ জীর্ণ দ্বীতল ভবন। দোতলায় দাঁড়ানো মহিলাও নিশ্চিত করলেন মাথা নেড়ে। কিন্তু পরে একজন বললেন এটা নাকি অশ্বিনী কুমার দত্তের বাড়ি! এই বাড়ির দেয়ালে সাঁটানো মালিকানা নিয়ে মামলার ফিরিস্তি।

জীবনানন্দ দাশের বাড়ি

পরিশেষে পাওয়া গেলো 'ধানসিড়ি, পশ্চিম বগুড়া রোড' ফলক সম্বলিত কাংখিত সেই বাড়ির গেট। গেটের পিলার দুটো না থাকলে হদিসও পাওয়া যেতো না জীবনানন্দ দাশের বসত ভিটার।  কিন্তু গেট পেরিয়ে ঢুকছি তো ঢুকছি। কোন স্থাপনা তো নাই! আছে এক এঁদো ডোবা। কলাবতী ফুল রঙ ছড়াচ্ছে সেখানে। পুকুরের ওপাড়ে সময় সময় যেমনে মন ধরে তোলা টিনের দোচালা, চৌচালা ঘর।  
কবির পৈত্রিক বসত বাড়ি ছিল ৫/৬ বিঘার উপর, অর্থ্যাৎ দেড় হতে দু'একর। কিন্তু এ তো বড় জোর আধ বিঘা! বোঝা যাচ্ছে, চতুর্পাশের বসত বাড়ি গুলো কবির মূল পৈত্রিক ভিটার সীমানাতে।

 জীবনানন্দ দাশের বাড়ি

আদিকাল থেকেই জায়গা জমি ঘিরে মারামারি, খুনোখুনি, মামলা হামলা। দিনে দিনে তা হচ্ছে তীব্রতর ক্রমবর্ধমান লোভ লালসার সাথে, আর এতো পরিত্যক্ত।  সুতরাং আধুনিক বরিশালের রূপকার অশ্বিনী কুমার দত্তই হোন আর কবি জীবনানন্দ দাশই হোন, কারো আসে যায় না কিছু। 'অর্পিত সম্পত্তি' নামের মোড়কে আয়ুবীয় 'শত্রু সম্পত্তি' আইন আছে বহাল তবিয়তে। 
পদ্মাতীরের গাউপাড়া গ্রামের ‘মুনশি পরিবার’ এর বাড়ি পদ্মা গর্ভে তলিয়ে গেলে এই বাড়ির সর্বানন্দ দাশ চলে আসেন বরিশাল। বরিশাল জিলা স্কুল হতে প্রবেশিকা পাশ করে সর্বানন্দ চাকুরী নেন কালেক্টরেট অফিসে। ভাড়া বাড়িতে উঠে বিয়ে করেন, অতঃপর নির্মান করেন বগুড়া রোডের এই বাড়ি। তাঁর সন্তানেরা পরে এই বাড়ির নাম রেখেছিলেন 'সর্বানন্দ ভবন'।

জীবনানন্দ দাশের বাড়ি

সতীদাহ প্রথা রদ হলেও কুপমন্ডুকতা আর কুসংস্কার ছিল তখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। হিন্দু কলেজে শিক্ষা প্রাপ্তির মাধ্যমে অভ্যুদয় ঘটে পাশ্চাত্য শিক্ষায় আলোক প্রাপ্ত তরুণদের। এই শ্রেণীর আচার আচরণে তাই সরাসরি প্রকাশ পায় বিদ্রোহ। খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরের প্রবণতা দেখা দেয় শিক্ষিত হিন্দুদের মধ্যে। এরই পটভুমিতে উনবিংশ শতাব্দীতে প্রবর্তিত হয় ব্রাহ্ম ধর্ম। হিন্দু শিক্ষিত পরিবারে জোয়ার আসে ব্রাহ্ম ধর্মে ধর্মান্তরের। 
হরিচরণ ও দুর্গা মোহন, দুই পুত্রের জন্মের পর সর্বানন্দ দাশগুপ্ত দীক্ষিত হন ব্রাহ্মধর্মে। দাশগুপ্ত থেকে পদবী হয় দাশ, দুর্গা মোহন দাশগুপ্ত থেকে সত্যানন্দ দাশ। এই সত্যানন্দ দাশ (১৮৬৩ -১৯৪২) ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) সমসাময়িক।  সাত ছেলে, চার মেয়ে নিয়ে বৃহৎ সংসার সর্বানন্দ দাশের। সত্যানন্দ দাশ ছিলেন ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক, প্রাবন্ধিক এবং ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।  ১৮৯৪ সালে তিনি বিয়ে করেন চন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কন্যা কুসুম কুমারী দেবীকে। ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করায় গৈলা নিবাসী চন্দ্রনাথ দাশগুপ্তকে সামাজিক চাপে চলে আসতে হয় বরিশাল। বাড়ি করেন আলেকান্দায়। এখানেই জন্ম কুসুমকুমারীর। 
সত্যানন্দ দাশ ও কুসুম কুমারী দাশের প্রথম সন্তান কবি জীবনানন্দ দাশ জন্ম নেন এই বাড়িতে ১৮৯৯ সালের ফাল্গুনে। ডাক নাম ছিল মিলু। 
কুসুম কুমারী দেবীরই লিখা একসময় এদেশের শিশু কিশোরদের মুখে মুখে ফিরা কবিতা - 
"আমাদের দেশে কবে সেই ছেলে হবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।"
অথবা 
ছোট নদী দিন রাত বহে কুল কুল 
পরপারে আমগাছে থাকে বুলবুল।
ছোটবেলা থেকেই তিনি লিখতেন কবিতা ও প্রবন্ধ, ছাপা হতো "প্রবাসী" ও "মুকুল" পত্রিকায়। সুতরাং সাহিত্যানুরাগ বা কাব্যানুরাগ ছিল কবির রক্তে। 
কবিতা লিখিয়ে বেথুনে পড়া এই কুসুমকুমারী দেবী সন্তানদের ঘুম ভাঙ্গাতেন স্বকণ্ঠে গান গেয়ে – 
মোরে ডাকি লয়ে যাও মুক্ত দ্বারে
তোমার বিশ্বের সভাতে
আজি এ মঙ্গল প্রভাতে
---- 
সব জড়তা হতে জাগোরে
সতেজ উন্নত শোভাতে
এই বাড়ির বর্ণনা পাওয়া যায় প্রভাত কুমার দাশের লিখাতে -
“বগুড়া রোড আর গোরস্তান রোডের কোণে পাঁচ ছ বিঘা জমি জুড়ে তাঁদের বসত বাড়ি, ফুল ফোটা কৃষ্ণচূড়া, বাতাবিলেবু, পোড়ো জমিতে সতেজ বেত বন আর কেয়া ঝোপ, নারকেল সুপারীর কুঞ্জ ঘেরা মাছের চোখের মতো ঝক ঝকে একটি পুকুর, আম কাঁঠাল, জামরুল, লিচু সব বড় বড় গাছ। পরিচ্ছন্ন আঙিনার তিন দিকে তিনটি পৃথক ভিটে বাড়ি। "
'রূপসী বাংলা'র কবিতার সকল উপাদান ছিলো এই বাড়িতেই। 
পূর্ববঙ্গীয় বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবার। গাছ গাছালিতে ছাওয়া তিনটি পৃথক ভিটে বাড়ি। এরই কোন একটির রান্নাঘরে কাটতো বেশীরভাগ সময় কোলকাতার বেথুনে পড়া কুসুমকুমারী দেবীর। এর মধ্যেই হয়তো হাজির 'ব্ৰহ্মবাদী' সম্পাদক, এক্ষুনি চাই কবিতা। এক হাতে খুন্তি, অন্য হাতে খাতা কলম, কুসুমকুমারী রান্নাঘরেই লিখতেন কবিতা।
এদিকে শিশু মিলুর সময় কাটতো ঠাকুমা’র কাছে গল্প শোনে। পূর্বপুরুষদের কথা, কীর্তিনাশা পদ্মাপাড়ের কীর্তির কথা। নয়তো মোতির মা’র দুই ছেলে মোতিলাল শুখলাল-কে নিয়ে বাড়ির ঝোপ ঝাড়, গাছ গাছালি চষে বেড়ানো। 
শৈশবেই অপার মমত্ব ছিল তরুলতার প্রতি। আম, জাম, নারিকেল, সুপারী, আনারস - প্রতিটি গাছের আর তাঁর ফলের বিবরণ ছিল কবির নখদর্পনে।  ফকির অলী মাহমুদ আসতেন নিত্য। কাজ না থাকলেও পিতা বলতেন, ‘বর্ষায় ঘাস বড্ড বড় হয়েছে’। সুতরাং কাস্তে চালাতো ফকির, তাই দেখে কাতর হতো বালক মিলু। সমঝদার ফকির প্রবোধ দিতেন বালক মিলুকে, “কিছু ভাববেন না খোকা বাবু, ক’দিনের মধ্যেই আবার খুব সূন্দর নরম কচি ঘাস হবে।” সুপোরি বাগানের কাঁচা আর পাকা সুপোরি বাছতে বাছতে অলী মাহমুদ বলে যেতেন চাষবাস থেকে শুরু করে গ্রামীন জীবনের গাঁথা। তন্ময় হয়ে তা শুনতো বালক মিলু । 

অশ্বিনী কুমার দাশের বাড়ি

একটু বড় হলে নিজের জমানো টাকায় কোলকাতা থেকে নার্সারির চারা আনায় মিলু। গোলাপ আর কৃষ্ণচূড়ার জন্য বরিশালে প্রসিদ্দি লাভ করে এই বাড়ি। 
গ্রীষ্মের দুপুরে ঠাকুমা উঠোনে শুকোতে দিতেন তাঁর যক্ষের ধন আচার আর আমসত্ব। উৎফুল্লিত চিত্তে কাক তাড়ানোর কাজটি করতো শিশু মিলু আর পিঠাপিঠি ভাইয়েরা। দিনে দিনে কমতো আমসত্ব আর আচার। দৃষ্টি এড়ানোর কথা নয় প্রখর দৃষ্টির ঠাকুমার, কিন্তু ছাড় ছিল নাতিদের বেলা। 
এই আমসত্ত্ব কমে যাওয়া নিয়ে দুষ্টোমী করে কৈশোরেই কবি লিখেছিলেন -
"এল-বৃষ্টি বুঝি এলো – 
জ’ল ধরে গেলে মাসী, তার পর কাঁথা গুলি মেলো!
এল-বৃষ্টি বুঝি এলো – 
গেলো গেলো আমসত্ব – পুড়োমুখো বৃষ্টি সব খেল! 
এল-বৃষ্টি বুঝি এলো – 
হরির মা কতগুলো ডাঁটো আম পেল।"
রাতে ঘুমিয়ে পড়লে রূপকথা শোনানোর লোভ দেখিয়ে খেতে নিয়ে যেতো মোতির মা। কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি পেতে খেতে বসতো প্রদীপের আলো আঁধারিতে। দু হাত নেড়ে মোতির মা বলে যেতো 'রূপকথার' নামে নিজ গাঁয়ের কথা। গল্প শুনতে শুনতে শেষ হতো খাওয়া। 
কিশোর কবি বাড়িতে যখন পাঠ করতেন বাংলা বা ইংরেজি কবিতা, এক হাঁটু কাঁদা নিয়ে হাতে দুধের কলসি নিয়ে গোয়ালা প্রহ্লাদ শুনতো ঠায় দাঁড়িয়ে। পড়া শেষ হলে বলতো, " খোকাবাবু, আপনি সুন্দর পড়েন"। কবিতার বিন্দুবিসর্গ না বুঝলেও কবিকণ্ঠের ধ্বনির সৌন্দর্যেই প্রহ্লাদের এই মুগ্ধতা। কবি জীবনানন্দ দাশের আবৃত্তির প্রথম গুণ মুগ্ধ শ্রোতা এই দিক থেকে প্রহ্লাদ। 
শিক্ষাজীবনে ব্রজমোহন বিদ্যালয়, পরে ব্রজমোহন কলেজ - এই বাড়িতেই কেটেছে কবির বাল্য ও কৈশোর। মেট্রিক, আই এ - তে ফার্ষ্ট ডিভিশন। অত:পর বি এ ক্লাশ কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। পরে ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনা নিয়ে আবারো আসেন বরিশাল।
এই ভিটাতেই ফুলশয্যার রাতে কবির অনুরোধে 'জীবন মরনের সীমানা ছাড়িয়ে’ গানটি গেয়েছিলেন নব বধু লাবন্য। ব্রজমোহন কলেজের ইংরেজীর অধ্যাপক ছিলেন কবি। একই সময় এই কলেজেরই আর বি এ ক্লাশের ছাত্রী কবি পত্নী লাবন্য দাশ। বাড়ির দোর গোরা থেকে দরজা বন্ধ ঘোড়ার গাড়িতে করে সোজা কলেজে যেতেন কবি পত্নী।

অক্সফোর্ড মিশন

লাবণ্য দাশ যখন বধু হয়ে আসেন, সময়টা ছিলো বাংলার  অগ্নি যুগ। বিনয়, বাদল, দিনেশ আর প্রীতিলতারা ছিলেন শিক্ষিত তরুণদের আদর্শ। বিয়ের আগে থেকেই কবি পত্নীর সংস্রব ছিল বিপ্লবী দলের সাথে। নজর ছিল বৃটিশ গোয়েন্দা আর পুলিশদের।  বিয়ের পরপর ইস্যু হয় লাবণ্য দাশের নামে ওয়ারেন্ট। এই বাড়িতে দল বেঁধে আসে পুলিশ। 'বিপজ্জনক হয় ঢাকার মেয়েরা' তেমনটাই অভিমত পুলিশ কর্মকর্তার। লাবণ্য দাশ ছিলেন ঢাকার মেয়ে। 
কবির প্রাণভোমরা কবিতার যে খাতাপত্র এক্তিয়ার ছিলো না কবিপত্নীরও স্পর্শ করার পুলিশ এসে তছনছ করে সব। পেয়েও যায় বিপ্লবের উজ্জীবনী আইরিশ বিপ্লবের বই একখানা। এক পুলিশ কর্মকর্তা উল্টেপাল্টে দেখেন টেবিলের 'ঝরা পালক' কাব্য গ্রন্থ। জ্বল জ্যান্ত কবিকে চোখের সম্মুখে দেখে পরিবর্তন আসে ক্ষীণ। আইরিশ বিপ্লবের বইটিকে ইতিহাসের রেফারেন্স আখ্যা দিয়ে কপাল গুণে রক্ষা পান কবি পত্নী। 
এই বাড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন হতো প্রতিটি সদস্যের জন্মদিন। কুসুমকুমারী দেবী পরনে জন্মদিনেও থাকতো একেবারেই সাদামাটা প্রাত্যহিক পোষাক। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারে শাড়ি বা পোশাক কেনার সিদ্ধান্ত দিতেন শুধুই গৃহকর্তা সত্যানন্দ, কবির পিতা। সাহস করে আবদার করেন বধু লাবন্য। বধুর জোর জবদস্তির মধ্যে অত্যন্ত লজ্জায় নুতন শাড়ি পরতে বাধ্য হন কুসুমকুমারী দেবী।
ঘরকুনো, নিভৃতাচারী, অন্তর্মুখী হিসেবে সর্ব্জন সমক্ষে পরিচিত কবি। বরিশালের এই বাড়ির চৌহদ্দির ভেতরে কিন্তু দুষ্টুমিতে কম যেতেন না কবি, এমনকি পরিণত বয়সেও।
বাড়ির ঝি খ্রিস্টান মহিলা সুন্দরমালা কবিকেই স্নেহ করতেন সবচাইতে বেশী। বার্ধক্যে তাঁকে বাড়ির ভেতরেই তুলে দেওয়া হয় আলাদা ঘর। খুব একটা দূরে নয় অক্সফোর্ড মিশনারি চার্চ। ফোকলা দাঁত কুঁজো বুড়ি প্রতি সপ্তাহে চার্চে যেতেন কনফেশন করতে। 
পাদ্রী হ্যাভক সাহেব বৃদ্ধাকে বলেন, " প্রভু যিশু বলসেন সকলকে প্রেম কোরটে। তাই হামিও টোমাকে প্রেম করি সুন্ডরমালা৷ সটিই হামিও টোমাকে প্রেম করি।" কথায় কথায় বৃদ্ধা বাইরে এসে বলে এই কথা। পাড়ার ছেলেবুড়ো সবাই মজা করে বৃদ্ধাকে বুঝিয়েছিলেন, ফাদার সত্যি তাকে ভালবাসেন। বৃদ্ধা রাজী হলে বিয়েও করতে পারেন। তবে, পড়ে যাওয়া দাঁতগুলো বাঁধিয়ে নিতে হবে। বৃদ্ধারও 'পেত্যয়' জন্মে দুষ্ট ছেলেপিলেদের এই কথায়।
বুড়ো ঝি'র গলা শুনলেই কবি দাঁড়াতেন বারান্দায়। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করতেন, ' কোথায় গিয়েছিলে? পাপ স্বীকার করতে বুঝি?'
কবিকে দেখেই একগাল হেসে উত্তর দিতো, " হয়, " কবি তখন মুখের উপর চিন্তার রেখা টেনে প্রশ্ন করতেন, "শুনলাম ফাদার হ্যাভক তোমার জন্য দাঁত বাঁধাতে দিয়েছেন। তোমায় কিছু বলেছেন কি? "
ঘর থেকে কবি মাতা চাপা গলায় বলতেন, " মিলু থাম। বুড়ো মানুষটার সাথে আবার লাগতে গেলি ক্যান? " 
মন ভালো থাকলে হাসতো বুড়ি। কিন্তু যেদিন রাগ থাকতো, সেদিন বলতো, " হ্যাবোগ্যারে মরন দহায় পাইসে। দেহা করেনের লেইগ্যা যতো চেষ্টাই করি, হেডায় কি দেহা দেয় না হামনে আহে? ক্যাবল আড়ালে আবডালেই রয়। হ্যার মতিগতি ভালা কইরা বুইজ্জা লই। বিয়া করনের ফিকির দেহায় - কাজের বেলা ঢনঢন। বড় ফাদাররে কইয়া দেহাইমুনা মজাডা?" 
মায়ের পরেই সবচাইতে আপন ছিলেন পিসিমা স্নেহলতা দাশ। চিরকুমারী, বরিশাল সদর বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী, সকলের ‘বড় দিদিমনি’ স্নেহলতা দাশ ছিলেন সর্বানন্দ দাশের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান । দেশভাগের পর গোটা দাশ – পরিবার কোলকাতা চলে যান বরিশাল ছেড়ে। স্নেহলতা দাশ অনেকদিন আঁকড়ে ধরে পরেছিলেন পৈত্রিক ভিটা।
রূপসী বাংলার রূপকার জীবনানন্দ দাশই শুধু নন, প্রথম দিকের মহিলা কবি কুসুমকুমারী দেবী, বিপ্লবী লাবণ্য দাশ, বরিশালের ‘বড় দিদিমনি’ স্নেহলতা দাশ, কবির মাঠের শিক্ষক ফকির অলী মাহমুদ, কবির কৈশোরের আবৃত্তির গুণমুগ্ধ শ্রোতা গোয়ালা প্রহ্লাদ, বুড়ি ঝি সুন্দরমালা - কবিকে ঘিরে থাকা আরো কতো স্নেহবর্ষী আত্মীয় অনাত্মীয় নারীপুরুষ। 
ফটকের থাম দুটি ছাড়া অবশিষ্ট নেই কিছুই এই বাড়ির। 'ধানসিড়ি' ফলকের ফটকের পাশেই, সম্ভবত কবির মূল বাড়ির সীমার মধ্যেই, একেবারে রাস্তার উপর সরাসরি তোলা শ্রী হীন সাদামাটা পি ডব্লিউ ডি মার্কা দ্বীতল এক বিল্ডিং - 'কবি জীবনানন্দ স্মৃতি পাঠাগার'। 

তথ্য সূত্র -
মানুষ জীবনানন্দঃ লাবন্য দাশ 
বাল্য স্মৃতিঃ অশোকানন্দ দাশ
জীবনানন্দ ও তাঁর কালঃ হরিশংকর জলদাস
লেখা ও ছবিঃ তপন রায়