অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
ডিমেনশিয়া - রুমা বসু

মি নার্সিং পড়তে যেয়ে, সেকেন্ড ইয়ার শেষ হওয়ার পর, প্রথম কো-অপ পেলাম একটা বৃদ্ধাশ্রমে। এর আগে আমি কখনোই কোন বৃদ্ধাশ্রম দেখিনি বা শুনিওনি  যে পরিচিত কেউ বৃদ্ধাশ্রমে থাকে। এই প্রথম একসাথে এতোগুলো বুড়ো-বুড়িকে দেখে কেমন একটা অদ্ভুত বোধ হতে লাগলো। এরা অনেকদিন থেকে একা থাকে বলে মনে হয় এখানের বাসিন্দারা লোক দেখলে কথা বলতে খুব ভালোবাসে। প্রতিদিন আমার  যার সাথেই ডিউটি থাকে সেই আমাকে খুব আদর করে কথা বলে আর ওদের জীবনের কতো কথা যে আমার  সাথে এমনভাবে বলে যায় যেন ওরা আমার সমবয়সী বন্ধু!

এই নার্সিংহোমের এক ভদ্রমহিলা, নাম মেরী, অনেক বছর ধরে ডিমেনশিয়াতে ভুগছেন। এখন উনি কাউকেই চিনতে পারেন না। কিন্তু সবার সাথে খুব আগ্রহ নিয়েই কথা বলেন। ওনার বর - বব, এখনো নিজের বাড়িতেই থাকেন আর উনি এখানে থাকেন। প্রতিদিন ওনার বর সকালে সেজে গুঁজে আসেন, তারপর ওনার সাথে একসাথে প্রাতরাশ করেন, আর প্রতিদিনই একটা করে গোলাপ নিয়ে আসেন। কিন্তু একেক দিন একেক রঙের গোলাপ আনেন, আর এসেই হাসি মুখে জিজ্ঞেস করেন, “ আজকে আমার ডেটকে কেমন দেখতে লাগছে, আমাকে কি ওর পাশে মানাবে?” আর সত্যি সত্যি যেন প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন, এমন আচরণ করেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো যে মেরী  ববকে একদমই চিনতে পারে না। তাই প্রতিদিন যেয়ে নতুন করে নিজের পরিচয় দেয় আর এমনভাবে কথা বলে যেন সত্যি দুজন অল্প বয়সের ছেলে মেয়ে প্রথম প্রেম করছে। ওনাদের দেখে আমি অবাক হয়ে যাই যে একজন মানুষ আর একজন মানুষকে কী করে এতো ভালোবাসতে পারে! 

একদিন ভদ্র মহিলার রাতে শরীরটা একটু খারাপ ছিল, তাই সারারাত নাকি ঘুমোতে পারেননি। আমি যখন  সকালে যখন ওনার ডিউটিতে এসেছি, তখন রাতের নার্স  আমাকে  বললো যে ভদ্রমহিলাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে কিছুক্ষণ আগে ঘুম পাড়িয়ে  রাখা হয়েছে, বব ব্রেকফাস্ট করতে আসলে যেন আজকে আর ভদ্রমহিলাকে  না ডাকা হয়। ভদ্র মহিলার বর আসার পর আমি  সব বুঝিয়ে বলে দিলাম। তখন ভদ্রলোক আমাকে  বললো আমার যেহেতু  এখন এঘরেই ডিউটি, তবে ভদ্রলোকের  সাথে কি ওনার বানানো ব্রেকফাস্টটা একসাথে বসে খেতে পারি? আমার  এতো কষ্ট হচ্ছিলো কথাগুলো শুনতে, তাই সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম। ভদ্রলোককে বললাম আপনি বসুন আমি সব বেড়ে দিচ্ছি। ভদ্রলোক সাথে সাথে বলে উঠলো, “ না না আমি করছি, এই আনন্দটুকু আমাকে পেতে দাও”। তারপর দুজনের জন্য ওনার আনা স্যান্ডউইচ, হ্যাসব্রাউন, এগ ডেভিল আর ফ্লাস্কে করা কফি দুজনের কাপে ঢেলে একেবারে ফর্মাল ভাবে টেবিল সাজিয়ে বসলেন। তারপর খেতে খেতে পুরো জীবনের গল্প বলে গেলেন।

উনারা দুজন পাশাপাশি বাড়িতে থাকতেন, দুজনের পরিবার ছিল একদম পাশাপাশি বাড়ির প্রতিবেশী। দুজনের মা-ই একই সময়ে প্রেগনেন্ট হয়েছিলো, আর একই দিনে লেবার পেইন ওঠাতে ভদ্র মহিলার বাবা দুই মাকে নিয়ে হসপিটালে যান। একই দিনে ভদ্রমহিলা তিনঘন্টা আগে উনি তিনঘন্টা পরে জন্ম নেন। তারপর থেকে একসাথেই বড় হয়েছেন, একই স্কুল, ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন। দুজনে একসাথে থাকার জন্য ইকোনমিক্স পড়েছে। মানে তাদের বয়স যতোদিন তাদের সাথে সম্পর্কও ততোদিন। কী অদ্ভুত জীবন, দুজনে কীরকম একে অন্যকে ভালবেসে ৭৬ বছর পার করে দিয়েছেন। এরপরও ভদ্রলোক বলছেন যে সেই ভদ্রমহিলা যদি কোন দিন আবার এক মুহূর্তের জন্যও ওনাকে চিনতে পারে আর ‘বব’ বলে ডেকে ওঠে  তবে এ’জীবনে আর কিছুই চাওয়ার নেই। আর ভদ্রমহিলা যেন ওনার নিজের মৃত্যু পর্যন্ত বেঁচে থাকে। কারণ ওকে ছাড়া ভদ্রলোক বাঁচবেন না। আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না যে এইরকমভাবেও কী কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে! এই মায়া দয়া হীন  পৃথিবীতে এমন মানুষও আছে, যাদের এই  দীর্ঘ দাম্পত্যেও এরকম ভালোবাসা থাকতে পারে, এ যেন বিশ্বাস হতে চায় না, এটা তো শুধু রূপকথাতেই থাকে। আমি সেদিনের পর সারাক্ষণ ওনাদের কথা ভাবি আর বাড়িতে এসে আমার বরকে জিজ্ঞেস করি ও কি আমাকে সারাজীবন এমনভাবেই ভালবেসে যাবে কিনা। ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসে আর প্রতিদিনই ঐ ভদ্রমহিলার কথা জিজ্ঞেস করে। আমি যেন মনে মনে এমন ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ডিমেনশিয়ার মতো অসুখকেও পাত্তা দিচ্ছি না। আমার জীবনের যেন একটাই লক্ষ্য হয়ে গেল যে সারাজীবন এমনভাবে ওর ভালোবাসা পাওয়া। শয়নে  স্বপনে এই বব-মেরী দম্পতিকেই চোখের সামনে দেখতে পাই। 

এর মধ্যে একদিন আমার বেলা বারোটা থেকে ঐ নার্সিংহোমে ডিউটি ছিল, ওখানে যেয়ে দেখি হুলস্থুল কাণ্ড বোধে গেছে। প্রতিদিনের মত সেদিনও বব সকালে মেরীর সাথে প্রাতরাশ করতে এসেছিল। তারপর নির্দিষ্ট সময় থেকে চলে গেছে। কিন্তু ঝামেলাটা হলো বব চলে যাওয়ার পর থেকে মেরীকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। সারা নার্সিংহোম তন্নতন্ন করেও মেরীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারপর ববের বাড়িতে ফোন করেছে যে ওখানে গেছে কিনা। বব তো সব শুনে একেবারে অবাক হয়ে গেছে। ও আবার নার্সিংহোম হোমে চলে এসেছে এবং যত পরিচিত জায়গা আছে সব জায়গায় খোঁজ করছে কিন্তু কোথাও কোন আশার আলো নেই। তারপর পুলিশের সাথে যোগাযোগ করার পর তারা জানালো যে তারা এমন একজনকে পেয়েছে কিন্তু তার কাছে কোন আইডি নেই শুধু ব্যাগের মধ্যে একটা ১০-১২ বছরের ছেলের পুরোনো ছবি পাওয়া গেছে। এরপর মেরীকে নিয়ে আসার পর জানা গেল যে সেদিন তো বুধবার ছিল, আর বুধবারে অটোয়াতে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য বাস রাইড ফ্রি। তাই মেরী হয়তো কারো পিছে পিছে কোনভাবে বাইরে বের হয়ে গেছে, আর গেটের বাইরে যেয়েই বাস পেয়ে যেয়ে বাসে উঠে গেছে। আর বাস ড্রাইভারও বয়স্কা মানুষ দেখে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। এই বাসটা ডাউনটাউনে গেলে মেরী কোন একটা স্টপে নেমে গেছে। সেখানে নেমে বাসস্টপে সাইড ওয়াকের উপর একটা বেন্চে অনেকক্ষণ একা বসে থাকতে দেখে একজন পথচারী কোন বাসে যাবে সেটার সাহায্য লাগবে নাকি ভেবে প্রশ্ন করেছে। তখন বলেছে যে ওর বর আসবে, তারপর ওরা একসাথে যাবে। তারপর পথচারী চলে গেছে। একঘন্টা পর ঐ পথচারী মহিলা যখন আবার ঐ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল দেখে মেরী তখনও সেখানেই কেমন একটা উদ্ভ্রান্ত চাহনী নিয়ে বসেই আছে।তখন তার সন্দেহ হওয়াতে সে আবার এসে কাউকে ফোন করতে হবে নাকি সেটা জিজ্ঞেস করে। তখন মেরী ওর পার্স খুলে ওর ছেলের ছবিটা দিয়ে বলে একে ফোন করতে। তখন মেরী দেখতে পায় ওর হ্যান্ড ব্যাগ একদম খালি, ওখানে ঐ ছবিটা ছাড়া আর কোন আইডি পর্যন্ত নেই। তাই সে তখন একটু আড়ালে গিয়ে ৯১১ কল করে পুলিশকে সব বলে এসে পুলিশ আসা পর্যন্ত মেরীর সাথে বসে গল্প করতে থাকে। পুলিশ আসার পর তো মেরী এদের কাছে কোন কথা বলেনা, বরং রাগ করে। তারপর অনেকক্ষণ বোঝানোর পর পুলিশের গাড়ি করে  ওকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে এসে কোন মিসিং ডাইরী আছে নাকি খোঁজ করতে থাকে। আর তখনই মেরীর নার্সিংহোম  থেকে ফোন এলে সব ঠিক হয়ে যায়। এই ঘটনার পর আমার মনে ডিমেনশিয়া নিয়ে একটা তীব্র ভয় ঢুকে গেছে।তখন মনে হয় না বরের ভালোবাসা এভাবে পাওয়ার জন্য যে অসুখটাও আমি মেনে নিতে চেয়েছিলাম, সেটা হলে তো পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম ভালোবাসাটা আমি বুঝতেই পারবো না। আর বুঝতে না পারলে, তাহলে সেই অমৃত পেয়ে আমার লাভ কী হবে। অমৃত পেয়ে যদি তার স্বাদই না বুঝতে পারি, তবে সে অমৃতে আমার দরকার নেই।

উপরওয়ালার কী মহিমা কে জানে, একদিন ভদ্র মহিলার সিভিয়ার হার্ট এটাক করাতে ভদ্রলোককে খবর দিতে যেয়ে দেখে উনার ফোন কেউ ধরছে না, তারপর ওনার ছেলেকে ফোন করা হলে ছেলে বললো যে আগের রাত থেকে বাবা হসপিটালে ছিল আর কিছুক্ষণ আগে সব শেষ হয়ে গেছে। উনারা ওর মাকে কয়েক ঘন্টার জন্য নিতে আসবে। আর এ কথাগুলো হওয়ার মাঝেই ভদ্রমহিলাও বরের কাছে চলে গেলেন। ভগবানের কাছে মনে হয় মন থেকে কিছু চাইলে তা পাওয়া যায়। তাই তো এদুজন একই দিনে জন্মালেন, আবার চলেও গেলেন এক সাথে। এক গাড়িতে করে মায়েরা হসপিটালে গেছে, আর এক গাড়িতে করেই দুজন চিরসাথী শেষ যাত্রায় যাবে। এ’ পৃথিবীতে কতো কী যে মিরাক্যাল হয় আমরা তার কতোটুকু জানি। আমি  শুধু বার বার একই কথা ভাবছি ভগবান  যেন আমাকেও এমন একটা জীবন দেয়, যেথায় আমার মনের সবচেয়ে বড় চাওয়াটা পূরণ করে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়তে পারবো।

রুমা বসু
অটোয়া, কানাডা