অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
মেঘবালিকার জন্য রূপকথা - তানিয়া নাসরীন

-আপনি কি তখন তার অফিসে গেলেন? 
-না, আমি বাসস্টপেই বসে থাকলাম বেশ কিছুক্ষণ। এরপর যে হোটেলে বুকিং দেয়া ছিলো সেখানে গেলাম।
-হোটেলের বুকিং ছিলো?
-হ্যাঁ, ছিলো। আমি স্বাভাবিক ভাবে চেক-ইন করে ফ্রেশ হলাম। একটা গাড়ি ঠিক করা ছিলো। ড্রাইভারকে ফোন করলাম।
-গাড়িটাও তাহলে সত্যিই ঠিক করা ছিলো?
-হুম। ড্রাইভার জানালো, যে স্যার তাকে ঠিক করেছে তাকে সে চেনে না, দেখেওনি। তবে সেই স্যার যে অফিসের ঠিকানা দিয়েছে সেটা সে চেনে। ওখানকার অনেককে সে আগে সার্ভিস দিয়েছে।
-আপনি তখন সেই গাড়ি নিয়ে ভদ্রলোকের অফিসে গেলেন?
-না, আমি বীচে গেলাম। তখন সূর্যাস্তের সময়। আমাদের এসময়টায় একসাথে সমুদ্রের কাছে যাওয়ার কথা ছিলো।
-কিন্তু আপনি সাথে সাথেই অফিসে খোঁজ করলেন না কেন?
-কারণ কুয়াকাটা অফিসে সে বসেনা। একটা ট্রেনিংএ আসার কথা ছিলো। থাকার ব্যবস্থাও ভেন্যুতেই, অফিসে তাকে পাবোনা আমি জানতাম।
-তা হলে ভেন্যুতেই কেন গেলেন না সাথে সাথে? 
-ভেন্যুতেই তো ছিলাম। যে হোটেলে আমার বুকিং ছিলো সেটাই ভেন্যু।
-তার মানে?
-সেখানে কোনো ট্রেনিং চলছিলো না।
-তাহলে সে কি কুয়াকাটায় আসেইনি?
-আমি জানি না। অনেক সময় নিয়ে টেনে টেনে কথাটা বলে তিনি কাঁপা হাতে চায়ের কাপটা নিলেন। কিন্তু ঠোঁট পর্যন্ত ছোঁয়াতে পারলেন না। নামিয়ে রাখলেন ফের।

ইন্সপেকটর আশরাফ এতক্ষণে ভালোমত লক্ষ করলো তাঁকে। বোঝা যায় বেশ যত্নে থাকা মানুষ। মুখমন্ডলে নিয়মিত চর্চার ছাপ। শরীরেও। কিন্তু আপাতত খুব একটা ধকল যাচ্ছে সেটাও স্পষ্ট। পরনের দামী পোশাক বিস্রস্ত। চোখের চাহনিতে ক্লান্তির সাথে আছে অসহায়ত্ব। আরো আছে সুদীর্ঘ বেদনার ছাপ। এমন দৃষ্টি আগে কখনো দেখেনি আশরাফ।

নিজের কাপটা তুলে নিয়ে চুমুক দেয় আশরাফ। অস্বস্তিকর নিরবতা ভাঙ্গার প্রথম চেষ্টা কাজে লাগেনা তার। খানিক পরে কিছুটা জোর করেই বলে ওঠে,  আপনাদের যোগাযোগটা কবে আর কীভাবে হয়েছিলো তাহলে? সব জানা গেলে কোন ক্লু পাওয়া যেতে পারে হয়ত।

কিছুটা চমকে তার দিকে তাকালেন তিনি। অন্যমনষ্ক কন্ঠে জবাব দিলেন, ফেসবুকে। বছর খানেক বা তারও আগে। আমি মেসেজে যোগাযোগ করেছিলাম, কথাও বলেছিলাম।
-তাহলে তো খুব ভালো কথা। আপনি ফেসবুক চেক করেছেন?
-করেছি। তার সাথে আমার ফেসবুকে অ্যাড ছিলোনা। আজ তার প্রোফাইল ডিঅ্যাক্টিভেটেড পেলাম।
-মানে কী হলো? আপনিই না বললেন, ফেসবুকে যোগাযোগ?
-ছিলো, কিন্তু পরে আমরা আনফ্রেন্ড হয়ে যাই। ওর স্ত্রীর আপত্তি ছিলো এই সম্পর্ক নিয়ে।
-অর্থাৎ তিনিও বিবাহিত?
-হ্যাঁ।

মনে মনে আশরাফ বলে উঠলো, হোলি শিট। মুখে বললো, আরেকটু পরিষ্কার করেন। আপনাদের পরিচয় ফেসবুকে?

এবার কেমন দিশেহারা দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি, বললেন, না,  আমরা একসাথে পড়তাম, ভার্সিটিতে। 

আশরাফ ছোট্ট একটা বিষম খায়। খুব রাগ লাগছে তার, এভাবে অর্ধেক কথা বলে থেমে যাবার মানে কী!
-ম্যাডাম, একটা অনুরোধ করি। আপনি আরেকটু ডিটেইলসে বলেন। গল্পের মত করে বলতে পারেন যদি মনে করেন। বুঝতেই তো পারছেন বিষয়টা খুব স্বাভাবিক নয়।

তিনি যেন সত্যিকারের বিপদে পড়লেন এবার। কী বলতে হবে যেন জানেনই না। আশরাফ হঠাৎ করেই হঠকারী একটা কাজ করে বসলো। উঠে গিয়ে তাঁর পাশে বসে এক হাতে হাত ধরে বললো, আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাইছি।

তিনি তাঁর গভীর চোখ দুটো তুলে তাকালেন আশরাফের দিকে। কয়েক সেকেন্ড, তারপর সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে শুরু করলেন, অনির্বাণ আর আমি একই ডিপার্টমেন্টে পড়তাম। পরিচয় তখন থেকে, ফার্স্ট ইয়ারে। কিন্তু তেমন করে কথা হয়নি সে সময়ে। তার সাথে সে সময়ের কোন স্মৃতিই নেই আসলে। আমার শুধু মনে পড়ে একবার পুকুর পাড়ে সবাই মিলে বসেছিলাম। অনির্বাণ যেন ইচ্ছে করেই আমার পাশে এসে বসলো। আমি সহজ হতে পারি নি, উঠেই গিয়েছিলাম মনে হয়। ও কিন্তু এই ঘটনা পুরোটা মনে রেখেছে। এই সেদিনও খেপিয়েছে আমাকে এই নিয়ে। 
পরে তো আস্তে আস্তে সবাই পড়াশোনার মধ্যে ঢুকে গেলাম। আলাদা আলাদা গ্রুপ গড়ে উঠলো। ওর সাথে মেশার বা বন্ধুত্বের সুযোগ তখন আর হয়নি। তাছাড়া খুব বেশি সময় আমি ছিলামও না। 
-কোথায় গেলেন?
-সেকেন্ড ইয়ারেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। থার্ড ইয়ারের শুরুর দিকে লন্ডন চলে যাই। আমার হাসব্যান্ড বার-এট-ল’ করতে গিয়েছিলেন, সাথে আমিও। আমার পড়াশোনা সেখানেই। ক্রিমিনাল সাইকোলজি নিয়ে পড়লাম। একসময় ফিরেও আসি। 
-আপনারা দুজনেই? মানে আপনাদের কোন বেবি...?
-আমার দুটি ছেলে। তবে তাদের জন্ম দেশে আসার পরে। ফিরে এসে প্রথমে ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে কাজ শুরু করি। আমার আর আমার শ্বশুরবাড়ির কেউ অবশ্য চায়নি আমি এনজিও-তে কাজ করি। তাঁরা চাইতেন আমি শিক্ষকতা করি। কিন্তু সেদিকে আমার ঝোঁক ছিলো না। 

এবারে বেশ কিছুক্ষণের বিরতি নিলেন তিনি। অবশেষে আশরাফ যখন জানতে চাইল তাঁর কিছু লাগবে কিনা, তখন বলতে শুরু করলেন আবার। 
-আমার ক্যারিয়ার অবশ্য খুব স্টিডি হয় নি। দুই ছেলের জন্ম, কিছু শারীরিক জটিলতা, বিভিন্ন কারণে গ্যাপ পড়ে। আবারও শুরু করি। বারবার নতুন করে শুরু করতে হয়। আমি আসলে খুব অভিমানী আর জেদী ছিলাম। ঝোঁকের বশে কাজ করতাম।
কী যেন ভাবলেন খানিকক্ষণ, ফের শুরু করলেন। বছর পাঁচেক আগে ফেসবুকেই ভার্সিটির কিছু বন্ধুর সাথে যোগাযোগ হয়। সে সময়েই অনির্বাণের ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাই। কিন্তু জমাই থাকে। কারণ ততদিনে তার কোনও স্মৃতিই আর আমার মাঝে অবশিষ্ট নেই। পরে একদিন অন্য এক বন্ধুর সাথে আলাপে জানলাম, অনির্বাণ আর আমার কাজ একই ধরনের। আমি তখন জুভেনাইল কাউন্সেলিং নিয়ে কাজ করছি। সেই বন্ধুর কথা শুনে অনির্বাণের প্রতি আগ্রহ হয়। ওর রিকুয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করি। কিন্তু ওর পোস্টে লাইক দেয়া ছাড়া কোনও কথা হয় নি তখনও। এরও বছর দুই পরে হয়তো, আমার কাজের প্রয়োজনেই যোগাযোগ হয়। আমিই করি। 
- তবে ঠিক আমরা আগে পরিচিত ছিলাম সেভাবে কথা হয় নি। মানে আমরা দু’জন নতুন পরিচিত হিসেবেই কথা শুরু করি। কারণ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দেখি কারোই ভার্সিটির কোন স্মৃতি নেই। তো, প্রথমবারের পর মাঝে মাঝেই কথা হতো। বিচিত্র কথাবার্তা আর কী। একসময়ে কথা বলাটা নিয়মিত হয়ে যায়। প্রতিদিন। একাধিকবার। 
- পছন্দের গান নিয়ে কথা হতো। কবিতা, সিনেমা, বই, নাটক নানা বিষয়। মানুষ নিয়েও কথা হতো। কথা অবশ্য ও-ই বলতো বেশি। আমি শুনতাম। কথা ছাড়াও ছিলো হারমোনিকা। কী অসাধারণ যে বাজাতো। সুরগুলো আমি যেন দেখতে পেতাম! সে যখন ‘নীল দিগন্তে, ঐ ফুলের আগুন লাগলো...’ বাজাতো আমি যেন সেই নীল দিগন্ত আর বিস্তীর্ণ সবুজ দেখতে পেতাম, আর আগুনরঙা ফুল। আবার বাঁশির মত সুরে বাজাতো, ‘দিনের শেষে, ঘুমের দেশে...’তখন আমি যেন সেই বাঁশিওয়ালাকেই দেখতে পেতাম,  যে তার শেষ খেয়ার অপেক্ষায় ঘাটে বসে আছে। ওঁর সুর থেমে যাবার পরও অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতাম আমরা দু’জন।
- অনির্বাণ আবৃত্তিও করতো মাঝে সাঝে। তবে একটা কবিতাই। খুব প্রিয় ছিলো তার ‘মেঘবালিকার জন্য রূপকথা’। আমাকে ডাকতো মেঘবালিকা। 
এই কথাগুলো বলতে গিয়ে ব্লাশ করলেন তিনি। এতক্ষণ পরে যেন কিছুটা স্বাভাবিক হলেন।

আশরাফ গল্পের মাঝে ঢুকে গিয়েছিলো। তার বেশ ভালোই লাগছিলো প্রায় মধ্যবয়স্ক প্রেমিকযুগলের চিত্র কল্পনা করতে।
- কথা বলতে বলতেই আমরা নিজেদের মাঝে নানান রকম মিল দেখতে শুরু করলাম। দেখা করার ইচ্ছে হলো দুজনেরই। তীব্র হতে থাকলো সে আকাংক্ষা। কিন্তু সব দিকে ম্যানেজ করা তো সহজ ছিলো না। ওঁর ফ্যামিলি জেনে গিয়েছিলো আমার কথা। ওঁর স্ত্রী আবার সে কথা আমার স্বামীকে জানায়। সে অনেক গোলমেলে ব্যাপার। কয়েকবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চেয়েছি। আবার থেমে গিয়েছি। 

আবার নিরবতা। ভদ্রমহিলা কী যেন ভাবতে শুরু করলেন। এদিকে রাত হয়েছে বেশ। আশরাফ একটু ইতস্তত করে বলে বসলো, ম্যাডাম, এক কাজ করি। আপনি তো বেশ ক্লান্ত আজ। এ পর্যন্ত থাক নাহয়। কাল বাকিটুকু শোনা যাবে। আমি সকালের দিকে আপনার হোটেলে যাবো একবার।
উনি উঠে পড়লেন। এলোমেলো পায়ে দরোজা দিয়ে বের হলেন। বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। 
আশরাফ একটা সিগারেট ধরালো। মাথাটা জ্যাম হয়ে আছে। সন্ধ্যা থেকে এই ঝামেলার মধ্যে পড়েছে। শ্যালিকার ছেলের আকিকায় যাবে বলে অফিস থেকে বের হচ্ছিলো। সেও প্রায় ছয়টার সময়। এমন সময় এই ভদ্রমহিলার আবির্ভাব। মিসিং ডায়রি লেখাতে চান। আশরাফ তো কালকের কথা বলে প্রায় না করেই দিয়েছিলো সেই সময়ে আইজি স্যারের কল। ভদ্রমহিলাকে যেন ভালোভাবে অ্যাটেন্ড করা হয়। 
কী আর করা!অ্যাটেন্ড করলো। কিন্তু এখন বেশ কিছু বিষয় অ্যাডজাস্ট করতে হবে। আগে স্যারকে ফোন করে রিপোর্ট করবে। কাজ শেষে বাসায় যোগাযোগ করবে। এর মাঝে তিনবার বউয়ের ফোন কাটতে হয়েছে। কপালে কী আছে কে জানে!

২।
আশরাফের কপাল মোটামুটি ভালোই ছিলো বলতে হবে। দশটার পর শ্যালিকার বাসায় পৌঁছে শোনে, শ্যালিকার বর এখনো আসতে পারেনি। হঠাৎ সচিব মহোদয়ের আগমন ঘটেছে, প্রোটোকলের দায়িত্ব পড়েছে তার ঘাড়ে। অল্প-স্বল্প ঝাড়ি খেয়ে অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে ১২টা। যদিও মাঝে বেশ কয়েকবার আশরাফের মনে হয়েছিল সন্ধ্যায় আসা সেই ভদ্রমহিলার কথা। কোথায় যেন একটু খটকা, ঠিক ধরা যাচ্ছে না।

পরদিন সকালটাও আশরাফের ব্যস্ততায় কাটে। বরিশালে জরুরি তলব পড়ে তার। ডিসির সাথে মিটিং শেষ করে ফিরতে ফিরতে বিকেল। মনে পড়লো, ভদ্রমহিলাকে বলেছিলো সকালের দিকে হোটেলে দেখা করবে। কিছু তো জানানোও হয় নি তাকে। আইজি স্যার দুবার ফোন করেছিলেন। কী অগ্রগতি জানতে। তাঁকেও কিছু জানাতে পারেনি। লাঞ্চের সময় স্যারের সাথে সামান্য কথা হয়েছিলো। ভদ্রমহিলার স্বামী নাকি অনুরোধ করেছেন তাকে সবরকমের সাহায্য করার জন্য। বড়লোকদের অনুরোধের মানে আবার আলাদা। আইজি স্যার তাই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছেন।

এইসব বড়লোকদের ব্যাপার আশরাফ বোঝেই একটু কম। স্ত্রী পরকীয়া করে বেড়াচ্ছেন, স্বামী আবার সবরকম সাহায্য নিশ্চিত করছেন! কী যে একটা অবস্থা।
দূর! দূর! পুলিশের চাকরি মানুষে করে!

থানা থেকেই হোটেলের দিকে রওনা হলো আশরাফ। রেকর্ড বই দেখে রুম নম্বর মিলিয়ে নিলো। ভদ্রমহিলা কোন ফোন নম্বর দেননি। ইচ্ছে করেই হয়তোবা। রিসিপশনে গিয়ে রুম নম্বর বলল আশরাফ। আজ তার সাথে একজন লেডি অফিসারও আছেন। পুলিশ দেখে হোটেলের লোকজনও তটস্থ। কিন্তু বিষ্ময়ের ব্যাপার ভিজিটরস বুকে ৩৪২ নম্বর রুমে কেউ উঠেছেন এমন তথ্য পাওয়া গেল না। হোটেলের লোকজন হলফ করে বলল ৩৪২ নম্বর রুম দুদিন ধরে খালি আছে। এখন অফ সিজন, খালি থাকা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
-বিষয়টা কী হলো! নিজের হতভম্ব ভাব কাটাতে সঙ্গে আসা ফারজানাকেই প্রশ্ন করল আশরাফ। ফারজানা আর কী উত্তর দেয়, ভেবে চিন্তে বলল, রুম নম্বরটা ঠিক দেখেছিলেন স্যার?
- আপনার সামনেই তো দেখে এলাম।
- ইয়ে, মানে, উনি ঠিকঠাক সব বলেছিলেন তো? মানে সব সত্যি বলেছিলেন?
- গত একমাসের ভিজিটরস লগ চেক করেন। অদিতি পারমিতাকে খুঁজে বের করেন। এই হোটেল না শুধু, যতগুলো হোটেল আছে সবগুলোতে। আর অনির্বাণ মুখার্জীর ডিটেইলস জোগাড় করেন। বলতে বলতে হোটেল থেকে বের হয় আশরাফ। মাথা কাজ করছে না, কী বলবে এখন আইজি স্যারকে!

থানায় ফিরতে ফিরতে মাগরীবের আজান শেষ হয়ে গেছে। বাইরে কেমন ধূসর লালচে আলো। আজও বৃষ্টি নামবে। ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত চলছে উপকূলে। একবার টহল দেয়া দরকার,  ভাবলো আশরাফ। ভদ্রমহিলার এখনো কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। আইজি স্যার আর ফোন করেননি, আশরাফের ফোন ধরেনও নি। একদিক থেকে রক্ষা, ভাবলো আশরাফ।

একজন কনস্টেবল নিয়ে বিচে টহলে গেলো আশরাফ। সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে ফিরতে ফিরতে ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি শুরু। থানার দরোজা জানালাগুলো বাতাসের তোড়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঝড় একদম পছন্দ নয় আশরাফের। আর সমুদ্রের ধারে তো নয়ই।

অস্বস্তি কাটাতে সিটে বসে কফির কাপে চুমুক দেয় আশরাফ। তখন হঠাৎই সামনের দরজাটা খুলে যায়। সাদা ফুলশার্ট আর নীল রঙের জিন্স পরা মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক,  চোখে মুখে অপ্রস্তুতভাব, ভেতরে আসবে কিনা স্থির করতে পারছেননা যেন,  এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রলোকের অর্ধেক চুলপাকা, বড় বড় এলোমেলো চুল তার মুঠিতে ধরা, অন্য হাতে চশমা। আশরাফ নিজেই উঠে দাঁড়ায়, আসুন প্লিজ।
-আসলে এই দুর্যোগে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। একটা বিশেষ বিপদে পড়ে এসেছি।

আশরাফ মনে মনে খুশিই হয়েছে ভদ্রলোককে দেখে, হাসিমুখেই বলে, বিপদে না পড়লে কেউ থানায় আসে মশাই? কী করতে পারি বলেন?
-আমার নাম অনির্বাণ মুখার্জী, আসলে এখানে তেমন কিছু চিনি না আমি, একজনকে খুঁজতে এসেছি।
-কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! আশরাফ বিড়বিড় করে।

অন্যমনষ্ক ভদ্রলোক তেমন কিছু খেয়াল না করেই বলে চললেন, আসলে আমার সমস্যাটা আসলে ঠিক সমস্যা কিনা বুঝতে পারছি না। 
-প্লিজ আপনি বসে কথা বলুন, আমি কফি বলছি। 

ভদ্রলোক হেসে ফেললেন, কফি মাঝে মাঝে আমারও পছন্দ। 
আশরাফ মুগ্ধ চোখে দেখলো ভদ্রলোকের হাসিমুখ, পুরুষ মানুষের গজদন্ত সে খুব একটা দেখেনি। 

কফির কাপে চুমুক দিয়ে ভদ্রলোক আবার বললেন, আসলে ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। আমার স্ত্রী কাল কুয়াকাটায় এসেছেন, কিন্তু যেখানে তাঁর ওঠার কথা সেখানে নেই। মানে কাল থেকে আমার সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি। তাঁকে খুঁজে পাচ্ছি না। এখন এই অবস্থায় কোথায় যাওয়া উচিত বুঝতে পারছি না।  আপনাদের আইজি স্যারের সাথে আমি কালই যোগাযোগ করেছি, কিন্তু তাঁকেও আজ একটা কাজে হঠাৎই মালয়েশিয়া যেতে হয়েছে। তাই আমি নিজেই চলে এসেছি। বুঝতেই পারছেন…বাক্য শেষ না করেই থামলেন ভদ্রলোক।

আশরাফ এতক্ষণ বোঝার চেষ্টা করছিলো, বলল, আপনার স্ত্রী? কী নাম বলুন তো?
-অদিতি, অদিতি পারমিতা। 
-আপনার স্ত্রী? আপনি ঠিক বলছেন?
-মানে, ঠিক বুঝলাম না? চোখে মুখে বিষ্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক।
-দেখুন, অদিতি পারমিতা নামে একজন ভদ্রমহিলা কাল এসেছিলেন আমার এখানে, আপনার মতই একজনকে খুঁজতে। আসলে মনে হয় আপনাকেই খুঁজতে। কিন্তু তার গল্পে অনির্বাণ মুখার্জী তার প্রেমিক, তিনি প্রথমবারের মত তার সাথে দেখা করতে এসেছেন।

ভদ্রলোককে কিছুটা বিহবল দেখালো। কিছুই ধরতে পারছেন না মনে হলো। শেষে আশরাফ নিজেই জিজ্ঞাসা করলো, আচ্ছা, আপনি কী করেন জানতে পারি? 
-আমাদের পারিবারিক ব্যবসা, সেটাই দেখাশোনা করি।
-আর আপনার স্ত্রী?
- উনি কিছু ভলান্টারি কাজ করেন, সেবামূলক বলতে পারেন।
- আপনাদের ছেলেমেয়ে? 
- আমাদের ছেলেমেয়ে নেই, নিঃসন্তান।
- আই সি। আশরাফ চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে সামনে রাখা ফাইল বন্ধ করতে করতে বলে, আপনার স্ত্রী যেই অনির্বাণ মুখার্জীর সাথে এখানে দেখা করতে এসেছিলেন, আমরা তার অফিসে খোঁজ নিয়েছি। তিনি …
- তিনি?
- তিনি বছর দুই হলো নিখোঁজ। উনার একটা ছবি আপনাকে দেখাতে পারি। আশরাফ হাতের ফাইল থেকে একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি বের করে সামনে এগিয়ে দেয়।
- কিন্তু এটা তো আমারই ছবি! চেয়ারে বসা অনির্বাণ যেন নিশ্চিত হতে চায়।
- হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। ছবির ভদ্রলোক আপনার থেকে কম বয়স্ক। চুল ছোট।
- এটা আমারই ছবি, চার বছর আগের। আমার পাসপোর্টের জন্য তুলেছিলাম। ফরমটা দেখাতে পারলে আপনি বুঝতেন।
- আচ্ছা মেনে নিলাম। কিন্তু আপনার স্ত্রী আপনাকেই কেন খুঁজে বেড়াচ্ছে বলেন তো? তাও আপনার পরিচয় গোপন করে? রহস্যটা কী? 

অনির্বাণ মুখার্জী রহস্য ভেদ করতে পারেন না। দুর্যোগের রাতে আশরাফও তেমন কোন তথ্য জোগাড় করতে পারে না। নয়টা পার হয়ে যাওয়াতে অনির্বাণকে হোটেলে পৌঁছে দেয় আশরাফ। এই হোটেলেই সকালে এসেছিলো সে। সাথে নেমে রুমটাও দেখে আসে, ৩৪২ নম্বর রুম।

পরদিন সকালে অফিসে আসার আগেই খবর পায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসছেন। প্রোটকলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। দুপুরে জানতে পারে নিজের বদলীর কথা। ঢাকায় পোস্টিং, ভাটারা থানা। এই পোস্টিং-এর জন্য এতদিন দেন দরবার কম করেনি সে। কদিন ধরে এরকম খবরেরই প্রতীক্ষা করছিলো। এখানকার কাজ যথাসম্ভব গুছিয়ে সকালের প্রথম ফ্লাইটে ঢাকা রওনা দেয় আশরাফ। জয়েন করে পরে ফ্যামিলি নিয়ে যাবে। অনির্বাণ মুখার্জী আর অদিতি পারমিতার গল্প আর এগোয় না।

ঢাকায় আসার বছর দুই পরের কথা। আশরাফ তার অফিসে অপেক্ষা করছে। থানার সব গাড়ী বাইরে। তার জিপটা আইজি স্যারের বাসায় পাঠিয়েছে। ফেরার তাড়া থাকলেও উপায় নেই। বাইরে মুষল ধারে বৃষ্টি। কিছুক্ষণ পায়চারি করে নিজের চেয়ারে বসে কফির কাপে চুমুক দেয় সে। মোবাইলটা বেজে ওঠে সেই সময়ে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ওসমানের নাম। ওসমান তারই ইউনিভার্সিটি জুনিয়র, কুয়াকাটা থানায় পোস্টিং। ফোন ধরে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে আশরাফ, খবর কী রে তোর? 

কিছুটা কুশল বিনিময়ের পর ওসমান বলে ওঠে, আর বলেন না ভাই, প্রোটোকল দিতে দিতে জীবন গেল। এত মানুষ কুয়াকাটায় কেন বেড়াতে আসে!
-তা ফোন করেছিস কি কোন কাজে?
-একজনের ইনফরমেশন দরকার ভাই। গুলশানে বাসা, বিজনেস ম্যাগনেট, অনির্বাণ মুখার্জী।

নামটা কানে যেতেই স্থির হয়ে যায় আশরাফ, কী ইনফরমেশন?

সংক্ষেপে বলে ওসমান, ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীর জন্য মিসিং ডায়রি করতে এসেছেন। অথচ তাঁর স্ত্রী যার নাম কি না অদিতি পারমিতা, একদিন আগেই অনির্বাণ মুখার্জী নামক একজনের খোঁজে এসেছিলেন যিনি আবার তার প্রেমিক।

-বড়ই গোলমেলে  ঘটনা, বুঝলেন আশরাফ ভাই। ভদ্রমহিলার সাথে আজ তার হোটেলে দেখা করতে গিয়ে দেখি তিনি নাকি আসেনই নি। অথচ কাল উনি থানায় এসেছিলেন। আমি নিজে কথা বলেছি। আজ আবার...বলে যেতে থাকে ওসমান।

আশরাফের কানে কিছুই আর ঢোকে না যদিও। সে জানে ওসমান কি বলবে এরপর। এরও পর।

তানিয়া নাসরীন
ধানমন্ডি, ঢাকা
বাংলাদেশ