অটোয়া, সোমবার ৬ মে, ২০২৪
সূর্যোদয়ের দেশে কয়েকদিন – চিরঞ্জীব সরকার

সূর্যোদয়ের দেশ জাপান। দুটো আনবিক বোমার আঘাত খেয়েছেও দেশটি। অনেক সময় একা একা ভেবেছি জাপান কেনইবা পার্লহারবার আক্রমন করে পারমানবিক বোমা নামক ভয়ংকর এ দৈত্যকে ডেকে আনল। আবার এও ভাবি ভুলতো মানুষ করবেই। সাধারন কোন ভুলে হয়ত ক্ষতি অল্প কিন্তু বৃহৎ ভুলের পরিনতি ব্যাপক। জাপান সম্বন্ধে আমার নানা কারনে  আগ্রহ ছোটকাল থেকেই ছিল। যেমন জাপানের চেরী ফুল ফোটা উপলক্ষে উৎসব আয়োজনের কথা। কিভাবে জাপানীরা ভূমিকম্পের হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লন্ডভন্ড জাপান কিভাবে বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে উঠেছিল, জাপানীদের দীর্ঘায়ুর রহস্য কি, অর্থনৈতিক অবস্থা এত ভাল হলেও তাঁরা কেন এত আত্মহত্যা করে। এসব নিয়ে যতই ভাবি ততই দেশটিতে ভ্রমনের ব্যাপারে এক ধরনের ব্যকুলতা অনুভব করি। অবশেষে যখন ২০১৮ সালের সেপ্টেবরে  টোকিওর হানেদা এয়ারপোর্টে হাওয়াইযান প্রশান্ত মহাসাগরের পারে  অবতরন করতে যাচ্ছে তখন মনে হল মনের গভীরে লুকানো একটি সুপ্ত বাসনা এতদিনে পুরন হতে যাচ্ছে।

টোকিয়োতে কয়েকদিন ছিলাম। অনুজ সহকর্মী আরিফ অনেক যত্ন করল। ও বছরখানেক আগে পড়াশুনা করতে জাপান এসেছে। একদিন আমাকে হোটেল থেকে ওর ডরমিটারিতে নিয়ে আসল। কয়েকদিন পর ও ঢাকায় ফিরে যাবে কারন ওর কোর্স ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছে। আরিফের ডরমিটরিটা টোকিও বে ঘেষে। ব্যালকনিতে বসে সন্ধ্যার আলোআধারীতে অবলোকন করলাম পন্যবাহী জলযানের ধীরগতির চলন। ডরমিটারী থেকে নেমে এসে আরিফের সাথে পদব্রজে অনেকক্ষন ঘুরলাম। টিপটিপ করে হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। দুজনে জাপানের নানা বিষয় আলোচনা করছি আর হাঁটছি। এমন সময় আরিফ বলল জাপান দেশটা এত পরিচ্ছন্ন হওয়ার অন্যতম কারন হল ওখানে ছোটদেরকে জীবনের শুরুতেই একটা জিনিস শিখিয়ে দেয়া হয়। সেটা হল গার্বেজ থ্রো না করে কেরি করবে এবং অবশ্যই এটা নির্দিষ্ট বিনে ফেলবে। এর ফলে তাঁদের অবচেতন মনে এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে যে তাঁরা কোথাও কোন পাবলিক প্লেসে ভুলেও যদি কেউ কিছু  ফেলে রাখে তবে অন্য একজন জাপানী সেটা সযত্নে তুলে সেটা নিজের কাছে রাখবে এবং পরে সেটা বিনে ফেলে দিবে।

জাপান নামটির সাথে হিরোশিমা ও নাগাসাকি নামক দুটো শহরের নাম জড়িয়ে রয়েছে যাদেরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘লিটল বয় ও ফ্যাটম্যান’ নামক দুটো পরমানবিক বোমার আঘাত সহ্য করতে হয়েছে। আনবিক বোমার আঘাতে মুহূর্তের ভিতর প্রান হারায় কয়েক লক্ষ মানুষ। পারমানবিক তেজষক্রিয়তার প্রভাবে এখনো সেখানে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হচ্ছে। এটম বোমার এ ভয়াবহতা দেখেও মানুষ মনে হয় তেমন একটা শিক্ষা নেয়নি। হিরোশিমা নাগাসাকিতে যে ধরনের বোমা ব্যবহার করা হয়েছে তার চেয়ে বহুগুন শক্তিশালী এটম বোমার অধিকারী আজ পৃথিবীর বেশ কিছু রাষ্ট্র।

টোয়াইস-বম্বড ম্যান 
জাপানী ইঞ্জিনীয়ার সুতুমু ইমাগুচি ১৯৪৫ সনে দুটো আনবিক বোমার আঘাতের সময় যথাক্রমে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে থাকা সত্বেও প্রানে বেঁচে যান। সে সময়ের ২৯ বছর বয়সের ইমাগুচি ১৯৪৫ সালের ৬ আগষ্ট জাপানের হিরোশিমার যে জায়গাটায় প্রথম আনবিক বোমাটি ফাটে তাঁর মাত্র দুমাইল দূরেই  ছিল এবং বিস্ফোরনের শক্ওয়েভ তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে দূরের একটা আলুর ক্ষেতে ছিটকে ফেলে। ৭আগষ্ট ট্রেনে করে কোনমতে সে তাঁর হোমটাউন নাগাসাকির দিকে প্রানে বাঁচার জন্য যাত্রা শুরু করেন এবং ৮ আগষ্ট সকালে সে নাগাসাকিতে পৌঁছান। আবার ৯ আগষ্ট যখন নাগাসাকিতেও আমেরিকা তাদের দ্বিতীয়  আনবিক বোমাটি ড্রপ করে তখন সে একটি অফিসে ছিল এবং এবারও সে বেঁচে যায়। এখানেও তাঁর অবস্থান ছিল বিস্ফোরনের স্থান থেকে দুই মাইল রেডিয়াসের ভিতর। মৃত্যুর এক বছর আগে ২০০৯ সালে জাপান সরকার তাঁকে টোয়াইস-বম্বড ম্যান হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ইমাগুচি ৯৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরন করেছিলেন।

হারিকিরি
স্যমুরাইদের জাতি জাপানীরা। এখানে অসন্মানের চেয়ে মৃত্যুকে বরন করাকে শ্রেয় মনে করা হয়। চাকু দিয়ে নাভির নীচে পোঁচ দিয়ে এ ধরনের আত্মহত্যা জাপানী সমাজে হারিকিরি নামে পরিচিত। আত্মহত্যাতো জীবন থেকে পালানোর মনোবৃত্তি। প্রকৃত বীরদেরতো এরকম আচরন অনুচিত। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের হাতে ধরা না দিয়ে সায়ানাইড বড়ি খেয়ে অনেক যোদ্ধা আত্মহত্যার আশ্রয় নিয়ে নিজেকে গৌরবান্বিত করে। কিন্তু জীবনযু্দ্ধের মাঠে সামাজিক সংকটে হারিকিরিই কি জাপানী সমাজের একমাত্র সমাধান, এ প্রশ্ন করেছিলাম জাপানে অনেকদিন ধরে থাকা সহকর্মী জিয়াউল আবেদিন ভাইকে। তিনি এত সুন্দর করে আমাকে বুঝালেন যে জাপানী সমাজ ব্যবস্থায় কেন ডেথ ইজ প্রেফারেবল দ্যান এনি সর্ট অফ ডিজঅনার। আমি পাল্টা যু্ক্তি দিয়ে তর্কে অবতীর্ন হলাম না। মনে মনে ভাবি জীবন তো অনেক বড়। জীবনের পথের বেশীরভাগটাই কন্টকাকীর্ন। কন্টকে পা ক্ষত হলে কন্টক না তুলে পা কেটে ফেলাই একমাত্র চিকিৎসা হতে পারে না।

দীর্ঘায়ুর দেশ
জাপানীরা একটা বয়স্ক জাতি। বহু শতবর্ষী মানুষ আছে এখানে। শারিরীক পরিশ্রম ও খাদ্যাভ্যাসই প্রধানত তাঁদের এ দীর্ঘায়ুর পিছনে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করছে। কাজপাগল এ জাতি নান্দনিকও বটে। তাইতো তাঁদের যে কোন কাজে সৌন্দর্যের একটা প্রলেপ লেগে থাকে। খাবার পরিবেশনের সময় টেবিল থেকে শুরু করে চপস্টিক পর্যন্ত সবজায়গাতেই নান্দনিকতার একটা হালকা আবেশ পাওয়া যায়। জীবনের এ নান্দনিকতাকে সযত্নে লালনের  ধারাও হয়ত জাপানীদের জীবনে আনন্দের এক অমিয়ধারা দিচ্ছে যেটা হয়ত তাঁদের দীর্ঘায়ুর রহস্যের অন্যতম একটা টনিক।
ভূমিকম্পের সাথে সহাবস্থানজাপানকে নিয়মিত বিরতিতে বড় বড় ভূমিকম্প সহ্য করতে হয়। এ শতাব্দীতে আবার যুক্ত হয়েছে সুনামী। জাপানের ভূপ্রকৃতিগত অবস্থানের কারনেই এরকম প্রাকৃতিক প্রতিকুলতা সহ্য করতে হয়। প্রচন্ড ভূমিকম্প তাঁদের নগরীগুলিকে ধংসস্তুপে পরিনত করলেও তাঁরাও আবার ধংসস্তুপ পরিস্কার করে নতুন নগরী নির্মান করে। তাইতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে দেশটি এত ক্ষত বিক্ষত ছিল আজকের জাপানে সে ক্ষতের কোন দেখা মিলবে না।


সময়কে শ্রদ্ধা
আমি জাাপানে গিয়েছিলাম একটি সস্মেলনে যোগ দিতে যেখানে এশীয় ও ইওরোপের অনেকগুলি দেশের প্রতিনিধিরা সমবেত হয়েছিল। সন্মলেন শেষ হওয়ার কথা বিকেল পাঁচটায় কিন্তু আলোচনা দীর্ঘায়িত হওয়ার কারনে সভাটি পাঁচটার ভিতর শেষ করার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ঠিক যখন ঘড়িতে পাঁচটা বাজে জাপানী প্রতিনিধি ফ্লোর নিয়ে সভাপতিকে সভাটি এখনি শেষ করার জন্য অনুরোধ জানাল। সময়ের কাজ সময়েই শেষ করতে হবে এটাই জাপানীজ কালচার। এ কালচারের কারনেই হয়ত সমৃদ্ধিতে আজ জাপানীরা পৃথিবীতে অনন্য।

চিরঞ্জীব সরকার। অটোয়া, কানাডা