অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
অদৃশ্য উদ্বিগ্নতায় কাটেনা সময় - মুতাকাব্বির মাসুদ

. এক অদৃশ্য উদ্বিগ্নতায় কাটেনা সময়। এসব বলতে তো আর তত্ত্ব-তথ্য-উপাত্ত লাগে না! জীবন থেকে নেয়া আর সময় থেকে নেয়া অভিজ্ঞতা-ই যথেষ্ট! তবে এমন অদ্ভুত আকষ্মিক মৃত্যুভয়ে উদ্বিগ্নতায় পরিবৃত সময় ইতিহাস খুব কমই দেখেছে। হয়তো প্রতি একশো বছরে এসেছে এমন ভয়ংকর মৃত্যু দূত- ইতিহাস যার সাক্ষী! ১৭২০ এ প্লেগ- মৃত্যু এক লাখ, ১৮২০ এ কলেরা- মৃত্যু এক লাখ, ১৯২০ এ স্প্যানিশ ফ্লু- মৃত্যু ১০ কোটি! কিন্তু আমরা ছিলাম না তখন! এই মহাজগতে বিষয়টি কাকতালীয় হলেও তা জীবন বাস্তবতায় চরম সত্য। আজ ২০২০ এ আমরা চলমান এই অদৃশ্য মৃত্যু দানবের মুখোমুখি যেমন - সাক্ষীও তেমন!

২. এই দুর্দমনীয় করোনাক্রান্ত ক্রান্তিকালে এসেও আমার স্বদেশ কখনো বলছে 'ঝোল খাবোনা মাংস খাবো!' আবার কখনো বলছে 'মাংস খাবোনা ঝোল খাবো!' আরে ঝোল ঢালতে গিয়ে যদি মাংস চলে আসে?  আর সে মাংস খেতে গেলে হাতেতো ঝোল লাগতেই পারে- তখন কী হবে?  তাই আমার দেশ সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) কঠিন ও ভয়াবহ পর্যবেক্ষণটিও মাথায় রাখা দরকার! বিদ্যমান বৈশ্বিক অনাকাঙ্ক্ষিত এই দুঃসময়ে 'করোনা' কোভিড-১৯ সম্পর্কে এ মুহূর্তে আমাদের রাষ্ট্রের মৌলিক ভাবনা কী?  জানতে ইচ্ছে হয়!

৩. প্রশ্ন হলো মানুষ আগে না অর্থনীতি আগে?  কোনটা 'এলাইভ' থাকবে?  মানুষ বাঁচলে একসময় অর্থনীতি গতিশীল হবে। এমনটাই মানুষ বিশ্বাস করে। এখন অর্থনীতিকে গতিশীল করতে চাইলে মানুষের কী হবে?
একবার ভাবুনতো বর্তমান প্রেক্ষিত প্রতর্ক্যে অর্থও নাই মানুষও নাই তখন কী হবে?  অনেকটা সেই শোলক বলার কাজলা দিদির মতোই - "দিদিও নাই আমিও নাই কেমন মজা হবে?" এই কঠিন সময়ে রাষ্ট্রকেই তার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখানে দুটো উপাদানই সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। একটি অপরটির পরিপূরক!
দুটোরই প্রাধান্য সমান সমান-ধরে নিলেও কোনটাকে প্রথম 'প্রায়োরিটি' দেবেন?  সময় কম। এখনই -এ মুহূর্তেই ভাবতে হবে।

৪. মনে রাখবেন মানুষই যদি না থাকে তাহলে বাকি উপাদানটি দৃশ্যত অচল। তাই বলতে চাই আমি বাঁচলে যদি পরিবার বাঁচে- পরিবার বাঁচলে যদি সমাজ এবং সমাজ বাঁচলে যদি রাষ্ট্র বাঁচে তাহলে 'করোনাকাল' চলে গেলে আমরা সবাই মিলে কি হারানো অর্থনীতি ও রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি / কাঙ্ক্ষিত জিডিপি অর্জন করতে পারবো না?

৫. রাষ্ট্রের নির্বাহী এই ভয়াবহ দুর্যোগময় মুহূর্তে কি শুধু একাই সিদ্ধান্ত নেবেন?  বাকিরা কোথায়? প্রতিটি মূল্যবান 'সেকেন্ড' এখন আমাদের অসহায় দুর্বল হাত থেকে দ্রুত থেকে দ্রুততম সময়ে হারিয়ে যাচ্ছে! আসন্ন এই ভয়াবহ মহামারীর সোনামিতে আমাদের প্রয়োজনীয় সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্তও যদি ভেসে যায় তাহলে আমরাও হারিয়ে যাবো। হারিয়ে যাবে দেশ - শতবছরের অর্জিত যত অর্জন! হারিয়ে যাবে জাতির জনকের স্বপ্ন!

৬. আমরাতো বাঁচতে চাই! অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই বাঁচতে চাই। সে এক ইতিহাসের অন্যরকম যুদ্ধ! এ যুদ্ধে কোনো মারণাস্ত্র নেই। আছে শুধু সাময়িক বন্দি সময়। কেবল নীরবে ঘরে থাকা সাথে একটু সচেতন থাকা। ঘরের ভেতর নাতিদীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর শেষে এ যুদ্ধে কেবল জয়ী হওয়ার জন্য নিঃসঙ্গ 'সঙ্গনিরোধ'র প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া! আর এ সকল প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একটি সঠিক প্রচল সিদ্ধান্তই পারে চূড়ান্ত সফলতা এনে দিতে।

৭. এখানে আবেগ নয়। বাস্তবতাই সর্বোচ্চ মাত্রায় বিবেচ্য। রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণে সিদ্ধান্তহীনতা এবং রাষ্ট্রের ও জনমানুষের কল্যাণে সিদ্ধান্তের সমন্বয়হীনতা আমাদেরকে ও এ প্রজন্মকে হয়তো একটি ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকেই ঠেলে দেবে যা, আমাদের কারোরই কাম্য নয়।

৮. তাই ভাবুন মানুষ বাঁচবে না অর্থনীতি বাঁচবে?
যন্ত্র চলবে না মানুষ বাঁচবে? প্রবৃদ্ধি না মানুষ?
মানুষ না অর্থনীতি? কোনটা আগে? রাষ্ট্রের কণ্ঠেই বিঘোষিত হোক।

৯. মনে রাখা প্রয়োজন রাষ্ট্রের যন্ত্র চালিত প্রকোষ্ঠগুলোই রাষ্ট্রের উন্নয়ন বা অর্থনীতির একমাত্র মাপকাঠি নয়! আমরা মনে করি রাষ্ট্রযন্ত্রের সার্বিক উন্নয়নের মূলে প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে মানুষ। অতীতে বহুসময় নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও হরতাল - আন্দোলন- সংগ্রামে বর্তমানের বন্ধ্যা সময়ের চেয়েও অধিক সময় কারখানাগুলো কর্মবিরতিতে থেকেছে। যা ছিল দৃশ্যমান সত্য! এতে যদি দুর্যোগোত্তর সময়ে রাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি অর্জন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছতে পারে তাহলে এই ভয়াবহ 'পেন্ডামিক' দুর্যোগে কারখানাগুলো সাময়িক বন্ধের পর (আর মাত্র ক'টাদিন) এ দেশ উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেনা কেন?  কতিপর যান্ত্রিক সেক্টর খুলে দিলেই কী উন্নয়নের চাকা সচল হয়ে ওঠবে?  এই ভয়ঙ্কর অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত অবশেষে আপাত উন্নয়নের মহড়ায় বুমেরাং হয়ে শতগুণ করুণ পরিণতিকেই এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে বিজ্ঞাপিত করতে পারে। হয়তো ইতিহাসও তা কখনো ক্ষমা করবে না!

১০. আরো আছে সিদ্ধান্তে যদি ভুল করা হয় তাহলে বিদ্যমান সমাজে স্বাস্থ্য বিধির সবগুলো অপশনই ভেস্তে যাবে। স্টে হোম, স্টে সেইফ , সেনিটাইজার, কোয়ারান্টাইন, আইসোলেশন, সোসাল ডিস্টেন্সিং, লকডাউন এসকল বিগত দিনের না শোনা অধুনা প্রচল জীবন সম্পৃক্ত বিজাতীয় শব্দগুলোর মর্মার্থ এই জনজীবনে বাস্তবায়নের প্রাণান্তকর প্রয়াস আর কোনো কাজেই আসবে না! এটাই সত্য! প্রতিদিন দিবসের শুরুতে মিডিয়ার ব্রিফিংয়ে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ও মৃত্যুর প্যারামিটার রকেট গতিতে বাড়ছে এবং বাড়তেই থাকবে! এধারায় 'করোনার'  অপ্রতিরোধ্য গতি রুখবেন কী দিয়ে? একবারও কি ভেবেছেন? ভাবুন। ভাবতে হবে।

১১. ঝাঁকে ঝাঁকে এসব দারিদ্র্যের কষাঘাতে মুহ্যমান প্রান্তিক বিপন্ন জনগোষ্ঠী যাঁরা এখানে এসে জীবন নয় জীবীকার প্রয়োজনে- কিংবা জীবনসংগ্রামে টিকে থাকার প্রয়োজনে মরণকে তুচ্ছ ভেবে যন্ত্র চালাবে, উন্নয়নের চাকা ঘুরাবে, অর্থনীতিকে সচলধারায় এই অচলায়তনে ফিরিয়ে আনবে তাঁরা কী মানুষ?  না-কি রোবট?  তাঁরা কী সুস্থ না-কি মরণঘাতী একেকটি 'করোনা' বোমা ? এটিও মাথায় রাখতে হবে। তাই সময় থাকতে বিশেষজ্ঞদের সাথে নিয়ে - বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাকে পর্যবেক্ষণে রেখে একটি জনকল্যাণমুখী সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি সঠিক ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন।

১২. নতুবা -হয়তো এক দীর্ঘ মেয়াদি 'করোনা' পেন্ডামিকের পথেই বাংলাদেশ এগুচ্ছে। সেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো পথই আমাদের থাকবে না। কারণগুলোও স্পষ্ট:- 
- বর্তমান সংক্রমণ দ্রুততার সাথে ধাপে ধাপে ছড়িয়ে পড়ছে। 
- সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাস্তবায়নে আমাদের ব্যর্থতা দৃশ্যমান সত্য। 
- বাহকের মাধ্যমে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় করোনা ছড়িয় পড়ার প্রবণতা আগের তুলোনায় এখন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেশি বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে। 
- তথ্য গোপন করার ভয়ঙ্কর প্রবণতা দিনদিন বেড়েই চলছে যা আমাদেরকে একটি ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। 
- যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ- তা হলো আমাদের ভঙ্গুর চিকিৎসা ব্যবস্থা! সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে এগুলোও মাথায় রাখুন। মনে রাখবেন পোশাক কারখানাই শেষ কথা নয়। শ্রমিকের কথা ভাবুন। সময়ের কথা ভাবুন। বিপন্ন মানুষ আর মানবতার কথা ভাবুন। ভাবুন বৈশ্বিক দুঃসময়ে দুখি স্বদেশের কথা ভাবুন।
আমরা সাধারণ নিরীহ জনগণ নির্বাহীর সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রইলাম।

ঘরে থাকুন
নিরাপদ থাকুন
নিজে বাঁচুন
পরিবার বাঁচান
দেশ বাঁচান
৩০-০৪-২০২০
মুতাকাব্বির মাসুদ। শ্রীমঙ্গল, বাংলাদেশ