অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
সিলেটের হাসন রাজা একজন অনশ্বর কবি : বিবেচনা এবং পুনর্বিবেচনা

    ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদঃ- সমকালে সিলেট জনপদের মরমি হাসন ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন অনশ্বর কবি। বাংলা সাহিত্যে- কাব্য সমীক্ষণে তাঁর অবাধ বিচরণ উল্লেখযোগ্য। সমকালীন সাহিত্যাসরে রবীন্দ্রনাথও তাঁকে জানতেননা। তবে '১৮৬১' সাল রবীন্দ্রনাথের জন্মই বলে দেয় তিনি ছিলেন হাসন রাজার সমসাময়িক।
     হাসন রাজার মৃত্যুর (১৯২২) দুই বছর পর ১৯২৪ সালে সিলেটের এম সি কলেজের 'প্রথম বর্ষের' ছাত্র প্রভাত কুমার শর্মার 'মরমি কবি হাসনরাজা' শীর্ষক একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ ১৯২৪ সালে কলেজ পত্রিকায় প্রকাশ পায়। প্রবন্ধটি সমকালে প্রাজ্ঞজনের প্রচুর প্রশংসা পেয়েছিল। এ ধারায় এ উদিয়মান তরুণ লেখক সাহিত্যচর্চায় প্রাণিত বোধ করেন। সাহিত্যচর্চায় অভিনিবেশের কারণেই আবেগ- উত্তেজনায় প্রভাতকুমার ১৯২৫ সালে শান্তিনিকেতনে যান। প্রাপ্ত তথ্যে প্রকাশ এ তরুণ ছাত্রটিই সেখানে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের সামনে নির্দ্বিধ চিত্তে দাঁড়িয়ে এই প্রথম সিলেটের কোন এক অখ্যাত কবির অবিনাশি গানের আটটি পাণ্ডুলিপি (মতানন্তরে আশিটি) পৌঁছে দেন। যার গান রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলে দেয়া হলো তিনি হলেন মরমি সাধক হাসনরাজা (১৮৫৪ - ১৯২২)। বলাচলে এরকম আকস্মিকভাবেই হাসনের গান কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের আনুকূল্য পেয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় হাসন রাজার দীপ্র প্রতিভা রবীন্দ্রনাথের তাৎকক্ষণিক মনোযোগ আকষণ করে। এ কালজয়ী দিনটি ছিল, ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৫। রবীন্দ্রনাথ সমকালে কলকাতার সিনেট হলে অনুষ্ঠিত ' ভারতীয় দার্শনিক কংগ্রেস' এর সভাপতি ছিলেন। ঐ দিনই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষণে বলেন, "পূর্ববঙ্গের এক গ্রাম্য কবির গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই,  সেটি এই যে, "ব্যক্তিস্বরুপের সাথে সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্ব সত্য"। বাউল দর্শনেও ওঠে এসেছে "মানবাত্মার মধ্যেই পরমাত্মার ঠাঁই;'  মানুষের মধ্যে অনুসৃত আলেক সাঁই'। অর্থাৎ "মানব জীবনের ও মানবজ্ঞানের ভিত্তিতেই বিশ্বচরাচরের" সবকিছু সত্য। এ অমূল্য মর্মবাণীই হাসন রাজার গানে প্রচারিত তাত্ত্বিক সত্য। দর্শন সভায় রবীন্দ্রনাথ যে,  গানটি তুলে ধরে হাসন রাজাকে বাংলা সাহিত্যে প্রাজ্ঞতায় মূল্যায়নের প্রয়াস নেন তারই উজ্জলতম পঙক্তিগুলো হচছে; 
 " মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন,
কর্ণ হইতে পয়দা হইছে মুসলমানি দিন। 
শরীলে করিল পয়দা শক্ত আর নরম
আর পয়দা করিয়াছে  ঠাণ্ডা গরম।
নাকে পয়দা করিয়াছে খুসবয় আর বদবয়,
 আমি হইতে সর্বোৎপত্তি হাছন রাজা কয়।"

     এ মরমি সাধক তাঁর প্রজ্ঞার আলোকে ক্রমাগত অনুসন্ধান থেকে প্রাপ্ত সত্যকে চেতনায় ধারণ করে বলেন যে "শাশ্বত পুরুষ তাঁরই ভেতর থেকে বের হয়ে তাঁর 'নয়ন পথে' প্রকাশিত। এ বিশেষিত তত্ত্বের আলোকে বৈদিক যোগীরাও সমধারায় উচ্চারণ করেন "পুরুষ তাঁর মধ্যে; তিনিই আধিত্যমণ্ডলে অধিষ্ঠিত"। হাসন রাজার গানেও তা উচ্চারিত  হয়;
 " রুপ দেখিলাম যে নয়নে আপনার রুপ দেখিলামরে,
আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা দিল আমারে।"

      হাসন প্রসংগ পুনর্বিবেচনার প্রেক্ষিত পর্যালোচনায় লক্ষ করা যায় হাসনের উল্লিখিত গান দুটোর অনুবাদসহ মূল ভাষণ রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে উপস্থাপন  করেছিলেন। সমকালে বিদ্বজ্জনের সমাবেশে উপস্থাপিত রবীন্দ্রনাথের ভাষণটি জানুয়ারি ১৯২৬ সালে "বিশ্ব ভারতি কোয়াটারলি" এবং "মডার্ন রিভিউ" পত্রিকায় প্রকাশ পায়। বিদগ্ধ সুধী সমাবেশে বহুল প্রচারিত এ ভাষণটি পরে তাঁরই অনুমোদিত বাংলা ভাষান্তর প্রকাশ পায় মাঘ ১৩১২,  কলকাতা, 'প্রবাসী', ও 'বঙ্গবাণী'  মাসিক পত্রিকায়। এ 'দর্শন সভায়' উপস্থাপিত ভাষণে হাসন রাজার প্রতি কবি গুরুর সংবেদনশীল মনের বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রশংসার বিষয়টি বিজ্ঞমহলে বিস্তৃত আলোচিত হয়। এ মহান কবি রবীন্দ্রনাথ বিনয়ের সাথেই হাসন রাজার "গুণের কদর ও সম্মান করলেন।" এভাবেই তিনি সিলেটের নিভৃতচারী মরমিসাধক হাসন রাজাকে বাংলা সাহিত্যে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁকে লালনের সমান মর্যাদায় অলংকৃত করেন।
     এ ধারায় ইতিহাসের আরো একটি অধ্যায় অপেক্ষমান ছিল। সেটিও পেয়ে যাই দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ১৯৩০ এ। এ বছরই "অক্সফোর্ড"(১৯৩০)"হিবার্ট" লেকচারে- রবীন্দ্রনাথের, হাসনের গান দুটোর পুনঃ উল্লেখের প্রয়াস কালজ্ঞ বিবেচনায় বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। বস্তুত এখান থেকেই বাংলা সাহিত্যে মরমি কবি হাসন রাজার  অনশ্বর কবি ও মরমিসাধক পরিচয়ের বর্ণাঢ্য অভিযাত্রা। তাঁর এ পরিচয় শুধু যে বাংলাসাহিত্যে তা নয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্য তথা বিশ্বসভায়ও তাঁর মরমি কবিপরিচয় ক্রমাগত প্রোজ্জ্বলিত হতে থাকে। এ স্বীকৃতি দ্যোতিত করে হাসনের মরমি ও অনশ্বর কবিসত্তাকে। উল্লেখ্য রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী "হিবার্ট" লেকচারটি "The Religion of Man" শীর্ষক গ্রন্থেও মুদ্রিত হয়েছিল। এখানে উপস্থাপিত এ প্রবন্ধে স্বল্প পরিসরে খুব কমই আলোচনার সুযোগ ছিলো। তারপরও হাসনকে জানার ও চর্চার অভিপ্রায় থেকেই এ লেখা।

পরে আরও হাসন প্রসঙ্গে বিস্তৃত  তুলে ধরার ইচ্ছে  আছে।

ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ। শ্রীমঙ্গল, বাংলাদেশ