অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
জানা অজানায় প্রাণের কবি, বিশ্ব কবি রবি ঠাকুর - বটু কৃষ্ণ হালদার

    বৈশাখ মাসের সঙ্গে বাঙ্গালীদের নাড়ির সম্পর্ক যুগ যুগ ধরে। পয়লা বৈশাখ যেমন বাঙ্গালীদের কাছে এক অতি প্রিয় লোক উৎসব, তেমনি ২৫ বৈশাখ হলো বাঙালির কাছে অত্যন্ত আনন্দের। ১২৬৮ সালের ২৫ শে বৈশাখ মঙ্গলবার কলকাতার জোড়াসাঁকোতে বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সারদা দেবীর কোল আলো করে জন্ম নিলেন রবি ঠাকুর। পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভোরের আকাশে পূব দিকে সূর্য যেমন ওঠে হেসে হেসে, ঠিক তেমনই আমাদের হৃদয়ের আকাশে ছেয়ে আছে তোমার স্মৃতি পট। বর্তমানে করোনা আতঙ্কে আমরা সবাই অনিচ্ছাকৃত গৃহবন্দি। কিন্তু ছোট্ট রবির শৈশবকাল ছিল গৃহবন্দী। ঠাকুর পরিবার তৎকালীন জমিদার বংশধর হওয়াতে ছোট্ট রবির শৈশব কেটেছে প্রাচুর্য, বিলাস বৈভবের মধ্যে দিয়ে। ঘর বন্দী ছোট্ট রবির শৈশব জীবনকাল খুব অনুশাসনের মধ্যে দিয়ে কেটেছে। এই সময় তার সঙ্গী ছিল বইপত্র ও ঘরের চাকর বাকর। এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সে পড়াশোনা করতে ভালোবাসতো না, কিন্তু উপায় ছিল না। গৃহবন্দী সবার প্রিয় সেই ছোট্ট রবি শ্রেষ্ঠ উপাধির শিরোপায় হয়েছেন বিশ্বকবি। সমাজের বাস্তব আঙিনায় এমন কোন স্থান নেই যে তার কলম আঁচড় কাটেনি। তাইতো ভারতবর্ষের তিনি লক্ষণরেখা সীমান্ত অতিক্রম করে সমগ্র বিশ্বে তার নামের জয়গান গাওয়া হয়। তিনি ছিলেন বিনি সুতোর গাঁথা মন্ত্র মালা। তিনি ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির সেতু তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। আজও মায়েদের ঘুমপাড়ানি গানে তাঁর গানের সুরের ছোঁয়া পাই আমরা। বাঙ্গালীদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা বা অন্যান্য পূজার পরশেও দূর থেকে বহু দূর হতে ভেসে আসে গীতবিতানের সুর। তাই ২৫ শে বৈশাখ আমাদের হৃদয়ের বাণী ভারতের এক শিল্পকলা। বিশ্বকবি নিজেই ছিলেন একক অস্তিত্ব। তাইতো এক রবি আলো দিয়ে সমস্ত অন্ধকার ঘুচায়, অন্যদিকে রবি বিশ্বমাঝে তার জ্ঞানের আলো জ্বেলে ঘুচায় মনের অন্ধকার। তাই ২৫ শে বৈশাখের শুভ ক্ষণে লক্ষ্য লক্ষ্য শঙ্খ বাজে, গানে গানে মুখরিত হয়ে ওঠে আকাশ বাতাস।
     ছোট্ট রবির বাড়ির পরিবেশ ছিল সাহিত্যের আঙ্গিনায় পরিমন্ডিত। তার বোন স্বর্ণকুমারী তিনিও খুব ভালো কবিতা পাঠ করতে পারতেন, তিনি সাহিত্য কে খুব ভালোবাসতেন। তাঁর ঠাকুর দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকদের সুসম্পর্ক ছিল। নামকরা কবি সাহিত্যিকরা ঠাকুরবাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন আবার কখনো-সখনো ঠাকুরবাড়িতে সাহিত্যের সভা আসর বসতো। ছোট্ট রবি লুকিয়ে লুকিয়ে সাহিত্য রস আস্বাদন করতেন। রবির সেজদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁর জীবনের মূল কান্ডারী। রবির পরিবার চাইতেন সে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা শিখুক। কিন্তু তার সেজদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা শেখালেন। কবির যখন মাত্র আট বছর বয়স তখন তার বাংলার মাস্টারমশাই তাকে কয়েক লাইন কবিতা লিখে দিয়েছিলেন, "মিন গণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে /এখন তাহারা সুখে জলক্রীড়া করে"//। ছোট্ট রবি লিখেছিলেন_"আমসত্ত্ব দুধে ফেলি/তাহাতে কদলি দলি/সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে/হাপুস হুপুস শব্দ/চারদিক নিস্তব্ধ/পিঁপিঁড়া কান্দিয়া যায় পাতে"। 
     এভাবেই কবিতা লেখা শুরু হয় ছোট্ট রবির। রবি ঠাকুরের প্রথম ছড়া কবিতা "জল পড়ে পাতা নড়ে" আজও হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। বাংলা ভাষায় শিক্ষাদান এর জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহজ পাঠ লিখেছিলেন। সহজ সরল উপায়ের মধ্যে দিয়ে শিশুদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা তিনি করে যান। তবে সেই সময়ে যদি ও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয় এর প্রচলন ছিল সেকথাও কিন্তু ভুলার নয়। বঙ্গসন্তান ভারত সন্তান সর্বোপরি বিশ্ব জননী সন্তান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে যুগের পর যুগ গবেষণা চলছে। আগামী দিনেও চলবে। তিনি যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে। 
     ১৩১৭ সালের ৩১ শ্রাবণ "গীতাঞ্জলি" ছাপা হয়েছিল। এই গীতাঞ্জলি ইংরেজিতে অনুবাদ হওয়ার পর বিশ্বের লেখক কবিদের মধ্যে সাহিত্যে নবজাগরণের সূচনা করেছিল। এই "গীতাঞ্জলি" এনে দিয়েছিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্মান নোবেল পুরস্কার। সর্বপ্রথম এশিয়া মহাদেশের মধ্যে ভারতের গৌরব বাঙালি কবি রবি ঠাকুর। বিশ্বের দরবারে বাঙালি সত্তাকে তিনি প্রথম উন্মোচন করেছিলেন। সেই থেকে বাঙ্গালীদের আর ফিরে তাকাতে হয়নি। তবে সবথেকে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হলো ২০০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল চুরি ঘটনাটা হল এদেশের সর্বশেষ্ঠ কলঙ্ক। তিনটি দেশের জাতীয় সংগীত যাঁর অবদান, নোবেল চুরি করে সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হৃদয় থেকে মুছে ফেলে দেয়া সম্ভব নয়। কারণ তিনি আমাদের হৃদয়ের যুগে যুগে বিরাজমান। 
     রাজনীতি প্রসঙ্গ বিশ্বকবির অবদান কম নয়। তিনি বরাবরই স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন লেখনীর মাধ্যমে।যেমন"আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসির হুকুম হইয়া গেলে বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত দুই হাতে লোহার বেরি বাজাইতে বাজাইতে রবীন্দ্রনাথের গান ধরেন। তিনি গেয়ে ওঠেন_"সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে/সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে"। একদিন ভূপেন্দ্র কুমার বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত কে জিজ্ঞাসা করেন_"আচ্ছা দিনেশ তুমি তো ভীষণ চঞ্চল ছেলে, তুমি কি পড়ার সময় শান্ত হয়ে যাও? বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত বলে কবিতা। ভূপেন্দ্র কুমার জিজ্ঞেস করেন কার কবিতা? বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত উত্তর দেন রবীন্দ্রনাথের। ১৯১৯ সালে কুখ্যাত জালিয়ান ওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের কথা আজও কারো ভুলে যাবার কথা নয়। সেই নৃশংস ও জঘন্য হত্যাকান্ডের বিরোধিতা করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশদের দেওয়া "নাইট" উপাধি প্রত্যাখান করেন। এসবের মধ্যে দিয়ে তিনি দেশপ্রেমের নমুনা দিয়ে গেছেন। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার প্রচন্ড আন্তরিকতা ও ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। ১৩৪৮ সালের ২২ শে শ্রাবণ ভারতবর্ষের বুকে নেমে আসে মহা বিপর্যয়। বঙ্গ জননী চিরতরে হারিয়ে ফেলেন তার কোলের অমূল্য রতন কে। ওই দিনে মহাপুরুষ রবীন্দ্রনাথ চিরতরে বিদায় নিলেন। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এক মহাসন্ধিক্ষণের অবসান ঘটে গেল। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম আকাশবাণীর ভাষ্যকার হিসেবে বলেছিলেন "অস্তমিত রবি, নেই রবি", আজও আমরা শিঁউরে উঠি সেদিনের কথা কানে বাজলে। এমন মহান পুরুষের জন্মদিনে শতকোটি নতমস্তকে প্রণাম জানাই।

বটু কৃষ্ণ হালদার। কবর ডাঙ্গা