অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
তুমি আছো সদা জীবন্ত বিশ্ববাসীর হৃদয়ে - শিবব্রত গুহ

    বৈশাখ মাস আসলেই আমাদের মনে পড়ে যায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। ২৫শে বৈশাখ, যে আমাদের সব্বার প্রিয় কবি, রবি ঠাকুরের জন্মদিন।
     বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রকে তিনি করে গেছেন সমৃদ্ধ। প্রথমে তাঁর কবিতার কথাই বলি। তিনি বিশ্বকবি, তাঁর কাব্য হল বহুবর্ণময়। তাঁর কবিতা কখনো রক্ষণশীল ধ্রুপদি শৈলীতে, কখনো হাস্যোজ্জ্বল লঘুতায়, কখনো দার্শনিকতায়, আবার কখনো আনন্দে মুখরিত।
     কবিগুরুর কাব্যে উপনিষদ রচয়িতা ঋষি কবিদের প্রভাব দারুণ ভাবে লক্ষ্য করা যায়। তাঁর লেখা কবিতা "দুই বিঘা জমি" - তে এক নিদারুন কঠিন কঠোর সামাজিক চিত্র ফুটে উঠেছে। তাঁর কবিতায় সুফি সন্ত কবীর ও ভক্তিবাদী কবি রামপ্রসাদের ভালোই প্রভাব পড়েছে।
     রবি ঠাকুরের কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে মানসী, সোনার তরী, বলাকা, গীতাঞ্জলি, পূরবী প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কবিগুরুর ছদ্মনাম ছিল ভানুসিংহ। তাঁর এক একটি কবিতার স্বাদ এক এক রকমের। এই রসাস্বাদনের অপূর্ব অনুভূতি আমি ভাষায় প্রকাশ করতে অক্ষম।
     রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাসগুলি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। ১৮৮৩ সাল থেকে ১৯৩৪ সালের মধ্যে তিনি রচনা করেছিলেন মোট ১৩টি উপন্যাস। তার মধ্যে চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে, শেষের কবিতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
     রবি ঠাকুরের ঘরে বাইরে উপন্যাসে, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে, ভারতীয় জনমানসে, জাতীয়তাবাদের উত্থানের দিক খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কবিগুরুর উপন্যাসগুলি, বাঙালি পাঠকসমাজে বিরাট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
     রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের একটি নতুন ক্ষেত্র উদ্ভাবন করেছিলেন। তা হল বাংলা ছোটগল্প। তাই, তাঁকে "বাংলা ছোটগল্পের জনক" বললেও একদম অত্যুক্তি হয় না। রবি ঠাকুরের ছোটগল্প গুলো নানা অলংকারে সমৃদ্ধ। মানুষের জীবনের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, ব্যথা, বেদনা, যন্ত্রনা সহ বিভিন্ন অনুভূতির অপূর্ব প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাঁর রচিত ছোটগল্পগুলির পরতে পরতে। যা বাংলা সাহিত্যের পাঠকসমাজকে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ করে রাখে।
     রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ বাংলা কথাসাহিত্যের এক অতি জনপ্রিয় গ্রন্থ। এই গ্রন্থের একাধিক গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা চলচ্চিত্র ও নাটক। তাঁর রচিত ছোটগল্পগুলির মধ্যে কাবুলিওয়ালা, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, দেনাপাওনা, পোস্টমাস্টার, শাস্তি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
     সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথই প্রথম আমাদের সমাজের একটি বিষময় প্রথা পণপ্রথার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন, করেছিলেন তীব্র বিষোদগার। তাঁর রচিত ছোটগল্প "দেনাপাওনা" - এর প্রধান চরিত্র নিরুপমা যেন আমাদের পরিবারেরই একটা সাধারণ নারী। সেই নারীর জীবন যে পণপ্রথা করে দিয়েছিল বিষময়, তা রবি ঠাকুর অসাধারণ ভাবে বর্ণনা করেছেন। যা আজ আমাদের সমাজে প্রায়শই ঘটে চলেছে।
     কবিগুরু অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর লেখা প্রবন্ধগুলি এককথায় অসাধারণ। তিনি তাঁর রচিত "অসন্তোষের কারণ" - প্রবন্ধে, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিগুলো খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর রচিত প্রবন্ধসমূহের মধ্যে কালান্তর, বিবেচনা ও অবিবেচনা, লোকহিত, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, ছোট ও বড়ো, শক্তিপূজা, শিক্ষার মিলন, চরকা, বৃহত্তর ভারত, শূদ্র ধর্ম, স্বরাজ সাধন প্রভৃতি বিশেষ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
     রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন অসাধারণ সংগীতস্রষ্টা। তিনি প্রায় ২৫০০০ গান রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রসংগীত নামে পরিচিত এই গীতমালা একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বাংলা তথা ভারতীয় সংস্কৃতির। রবি ঠাকুরের গান তাঁর সাহিত্যের সাথে জড়িত অঙ্গাঙ্গীভাবে। তাঁর অনেক কবিতা রূপান্তরিত হয়েছে গানে, তেমনই তাঁর উপন্যাস, গল্প, নাটকে, তাঁর গান নিয়েছে বিশেষ ভূমিকা।
     রবীন্দ্রনাথের গানের মূল উৎস হল হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের ঠুমরি শৈলী। নানা ধরনের শাস্ত্রীয় রাগের সুরগত সৌন্দর্য প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর গানে। গীতবিতান সংকলনে সংগৃহীত আছে রবি ঠাকুরের সব গান। রবীন্দ্রসংগীতে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছে কর্ণাটক শাস্ত্রীয় সংগীত, বাংলা লোকসংগীত, ইংরেজি ব্যালাড, স্কটিশ লোকগীতি ও বাউল সংগীত।
     কোলকাতায় তখন চলছে বাবুশ্রেণীর বাড়বাড়ন্ত। বাবু সংস্কৃতি ভাবাপন্ন মানুষেরা ক্রমশ দেশীয় সংস্কৃতিকে দেখতেন খাটো নজরে। তখন শিক্ষিত সমাজে নৃত্যকলার কোনও শ্রদ্ধার আসন ছিল না। তাই এই কলার মান গিয়ে ঠেকেছিল ক্রমশ তলানিতে। রবি ঠাকুর শিক্ষার অন্যতম বাহনরূপে নৃত্যকলার গুরুত্ব সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।
     কবিগুরুর প্রচেষ্টাতেই, আজ নৃত্যকলা সগৌরবে অধিষ্ঠিত শিক্ষার জগতে। এর জন্য অনেক ঝড় সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু, তিনি, তাঁর লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। তাঁর অসামান্য অবদানের জন্যই বর্তমানে সবাই নৃত্যকলা চর্চা করতে পারছে। রবি ঠাকুরের কাছে নৃত্যকলা ছিল দেহের চলমান শিল্প। তাঁর মনকে এক অনাবিল আনন্দে ভরিয়ে তুলতো এই নৃত্যকলা। সেইজন্য, তিনি আধুনিক ভারতে প্রথম গড়ে তুলেছিলেন শান্তিনিকেতনে নৃত্যকলা চর্চার এক উৎকৃষ্ট প্রতিষ্ঠান।
     চিত্রকলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন প্রথাগত শিক্ষা বা আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছিল না। তিনি শুরু করেছিলেন আঁকতে খেলার ছলেই। তারপর, ধীরে ধীরে তিনি এই শিল্পকলার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন।
     কবিগুরুর ছবিগুলোকে প্রধানত কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়ঃ
        ১. মুখমণ্ডল বা মুখাবয়বের ছবি।
        ২. অদ্ভুত কাল্পনিক প্রাণীর ছবি।
        ৩. প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি।
     তবে, এর বাইরেও, তাঁর আঁকা ছবি রয়েছে।
     কবিগুরুর আঁকা আত্মপ্রকৃতি আছে একাধিক। মুখাবয়ব বা মুখমন্ডল আঁকার প্রতি তাঁর বিশেষ পক্ষপাত ছিল। তিনি ছবি এঁকেছেন অদ্ভুতভাবে। কখনো কলম, কখনো পেন্সিল দিয়ে তিনি এঁকেছেন ছবি। তিনি ২৫০০-এর বেশি এঁকেছেন ছবি সারাজীবনে। তাঁর আঁকা ছবিগুলো এক একটি অমূল্য সম্পদ।
     রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন ধরে করেছিলেন সাহিত্য, শিল্প - সংস্কৃতির সাধনা। তিনি বাংলা তথা ভারতীয় তথা বিশ্ব সাহিত্য, শিল্প – সংস্কৃতিকে করে গেছেন নানাভাবে সমৃদ্ধ। তাই, বিশ্বকবির প্রতি আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে এই লেখার ইতি টানছি।
"হে বিশ্বকবি, তুমি আছো
সদা জীবন্ত
বিশ্ববাসীর হৃদয়ে।"

(তথ্যসূত্র সংগৃহীত)
শিবব্রত গুহ
গড়ফা, কোলকাতা