অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ভোগবাদ এবং বিশ্ব শান্তি – ফরিদ তালুকদার

ইলিয়াম রিস (William Rees), ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার (University of British Columbia) একজন নগর পরিকল্পনাবিদ, তিনি এক সমীক্ষায় দেখিয়েছেন যে, উন্নত বিশ্বের প্রতিটি নাগরিকের গড়পড়তা ভোগের জীবন ধরে রাখতে জনপ্রতি আনুমানিক প্রায় ৪-৬ হেক্টর জমির প্রয়োজন হয় (১ হেক্টর = ২.৪৭ একর)। অন্যদিকে ১৯৯০ সালের আরেক সমীক্ষায় দেখা যায় যে,  পৃথিবীতে পরিবেশগতভাবে উৎপাদনশীল জমির পরিমান মাথাপিছু বরাদ্দ হয় মাত্র ১.৭ হেক্টর। সুতরাং প্রচ্ছন্ন হলেও এটা সত্য যে, উন্নত বিশ্বের নাগরিকদের এই ভোগবাদী চাহিদা মেটানোর জন্যে দুটো পথ খোলা থাকে। এক-- তাদের নিজেদের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সীমিতকরণ, এবং দুই-- বানিজ্য বৈষম্যের মাধ্যমে অন্যদেশের সম্পদকে নিয়ে আসা। এই প্রক্রিয়াটিকে একরকম বানিজ্যিক দস্যুতা বৃত্তিও বলা যায়। অর্থাৎ উন্নত দেশ গুলোর জনগনের ভোগের অতিরিক্ত এই চাহিদা মেটাতে পৃথিবীর অন্য কোথাও না কোথাও কোন নাগরিককে বঞ্চিত করা হচ্ছে বা তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়া হচ্ছে। 

উপরের সমীক্ষাটি হলো ভোগবাদী পৃথিবীর একরকম চিত্র। আমাদের ভোগবাদী মানসিকতার কারনে সৃষ্ট দ্বিতীয় চিত্রটি হলো আরও ভয়াবহ। এবং তা হলো তৃতীয় বিশ্ব বা অনুন্নত দেশগুলোতে আভ্যন্তরীন ভাবে তাদের সম্পদের অসম বন্টনের ফলাফল। একটা উদাহরণ টেনে বিষয়টাকে অনুধাবন করার চেষ্টা করা যাক। উন্নত বিশ্বের বৈষম্য মূলক আচরণের কারনে ইতোমধ্যে রুগ্ন অর্থনীতির দেশগুলোতে যখন আমরা মাথাপিছু গড়পড়তা আয়ের সূচকটি দেখি তা আসলে ঐ দেশের আপামর জনসাধারণের জীবন মানের প্রকৃত চিত্র থেকে অনেক দূরে অবস্হান করে। কারন এই দেশগুলোর প্রায় ৮০% সম্পদের ভোগসত্ব থাকে হয়তো মাত্র ২০% জনগনের অধিকারে। সুতরাং, উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, তৃতীয় বিশ্বের কোন একটি দেশে যদি বলা হয় বছরে মাথাপিছু গড় আয় ১০০০ মার্কিন ডলার, তার অর্থ ঐ দেশের ৮০% মানুষের মাথা পিছু বার্ষিক আয় মাত্র ২৫০ মার্কিন ডলার! তবে আরও কঠিন বাস্তবতা হলো, এই যে ৮০% জনগন তাদের মধ্যেও বড়ো একটি অংশের বছরে গড় আয় এই ২৫০ মার্কিন ডলার এর ও অনেক নীচে থাকে।  নিঃসন্দেহে একটি ভয়াবহ চিত্র…! তাই নয় নাকি…?

কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন এতো হলো সম্পদের অসম বন্টন। এর সাথে ভোগবাদের কি সম্পর্ক?  ওকে… এমন একটি প্রশ্নের উত্তরে আমি বলতে পারি নিজেদেরকে মানবিক প্রাণী হিসেবে দাবী করে এমন একটি অমানবিক সমাজ ব্যবস্হা তৈরী করার পিছনে তাহলে আর কি কারন থাকতে পারে? যারা এমন প্রশ্ন করছেন তাদের কাছেই আমি এই প্রশ্নের উত্তরের দায়িত্বটা দিলাম। তবে তারপরও একটু খতিয়ে দেখা যাক আসলে ভোগবাদ (Consumerism) বলতে আমরা কি বুঝি…? “ভোগবাদ হলো এমন এক প্রকারের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনুক্রম যেখানে মানুষকে নিয়ত ক্রমবর্ধমান পণ্য ও সেবা অধিগ্রহণকে উৎসাহিত করা হয়”। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বিশেষ করে ২০ শতকে ব্যাপক উৎপাদন ঠেলে দিয়েছে অতি উৎপাদনের দিকে, যেখানে পণ্যের সরবরাহ ভোক্তার চাহিদাকে অতিক্রম করে যায়। আর এ কারনে প্রস্তুতকারকরা পরিকল্পনা করে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ক্রেতাদেরকে নূতন পণ্য কিনতে বাধ্য করছে (তথ্য সূত্র উইকিপিডিয়া)। 

বর্তমান পৃথিবীতে আমরা দেখি শুধুমাত্র চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন ই নয়, আরও হরেক প্রকারের কৌশল অবলম্বন করে ক্রেতাদের মনোজগতে শুধু চাপই সৃষ্টি করা হচ্ছে না, সময়ের সাথে সাথে তাদের মানসিক অবস্হার পরিবর্তন এমনকি সামাজিক মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতিতে ও আনছে এক ভোগবাদী পরিবর্তন। নীচে এর বেশ কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে আমি আরও পরিস্কার করার চেষ্টা করবো। তবে তার পূর্বে একটা কথা আমি এখানেই বলে যেতে চাই যে পৃথিবীর অধিকাংশ জনগোষ্ঠী কিন্তু এখনো সমাজ মানসে গড়ে ওঠা এই ভোগবাদী ব্যবস্হার সুবিধা (একটা শ্রেণীর কাছে এটা এতোই তীব্র যে আমি তাকে অসুস্থতা বলবো) থেকে বঞ্চিত। অর্থাৎ গোটা বিশ্বের মুষ্টিমেয় একটা শ্রেণী ই শুধু ভোগের উপরে ভোগের সৌধ গড়ে যাচ্ছে। ফলে সমাজে বাড়ছে বৈষম্য এবং অস্হিরতা। অল্প সুবিধাভোগী শ্রেণী যারা এই সোনার হরিনের পিছনে ছুটছেন তাদের জীবনের ন্যুনতম সুখ-শান্তি টুকুও হয়ে পড়ছে বিপন্ন।

এবারে কিছু উদাহরণ টেনে দেখা যাক যে এই ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্হা এবং বড়ো বড়ো বহুজাতিক কম্পানিগুলোর সীমাহীন মুনাফা লাভের লিপ্সা আমদেরকে কিভাবে প্রলুব্ধ করছে, জিম্মি করে ফেলছে অতিভোগের জন্যে। এখানে আমি যে উদাহরণগুলো টানবো তা বলা যায় মোটামুটি একটা উন্নত বিশ্বের প্রেক্ষাপট থেকে। প্রথমে ছোট থেকে শুরু করা যাক। হাল সময়ে আমরা কাপড়-চোপরের দোকান বা এমন কি সাপ্তাহিক গ্রোসারি দোকান গুলোতে গেলে হর হামেশাই লক্ষ্য করি দুটা কিনলে তৃতীয়টি (তিনটার মধ্যে সর্বনিম্ন মূল্যের টি) ফ্রী।  অথবা একই ধরনের শার্ট বা টি শার্ট এর কাছে লেখা থাকে একটির মূল্য ২৫ ডলার, দুটি নিলে ৪০ ডলার। গ্রোসারি দোকানে গেলে দেখা যায় এক আঁটি পালন শাকের দাম  ২ ডলার কিন্তু ২ আঁটি নিলে ৩ ডলার। এখন আমাদের হয়তো দরকার একটা শার্ট বা এক আঁটি পালন শাক কিন্তু দামের এমন নির্ধারণে ক্রেতাদের মনস্তত্ত্বের ওপরে একটা বড়ো রকমের চাপ সৃষ্টি হয় । এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ই দেখা যায় এক ইউনিট দরকার হলেও আমরা কিনে নিয়ে আসি দুই ইউনিট। ফলাফল? অংক খুব সহজ। আমাদের পকেট থেকে ১৫ ডলার এবং ১ ডলার হিসেবের চেয়ে বেশী চলে গেলো। এবং অবধারিত মাসের শেষে বাজেটে ঘাটতি। না না ভাববেন না…! তার জন্যেও ব্যবস্হা আছে! সে বিষয়টায় পড়ে আসছি। তবে আর একটা বিষয় ও উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। এবং তা হলো বিরাট মূল্য হ্রাসের বিষয়। এ বিষয়টি এখন সারা পৃথিবী ব্যাপিই বিদ্যমান বলে আমি মনে করি। হর হামেশাই দেখি ৫০% মূল্য হ্রাস! ওয়াও ১০০ ডলারের পণ্য এখন মাত্র ৫০ ডলার! সুবর্ণ সুযোগ! না কিনে যাই কই? কিন্তু এই মূল্য হ্রাসের পড়েও বিক্রেতা হয়তো ৩০ ডলার লাভ করছে। সুতরাং এক্ষেত্রে আমাদের একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত আসলে আমার পকেট থেকে কতো যাচ্ছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ, মূল্য হ্রাসের % নয়।

এবার আশা যাক ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি এবং ডিভাইস এর বিষয়ে। প্রকৃত পক্ষে এটাই এখন আমাদের ঘুম হারামের সবচেয়ে বড়ো কারন হয়ে দাড়িয়েছে এবং এরাই আমাদের জীবনকে সম্পূর্ণ শেকলে বেঁধে ফেলেছে।  আগেই স্বীকার করে নিচ্ছি যে এই নিবন্ধটাও আমি এখন একটি ট্যাবলেটে টাইপ করছি। আমি যে দেশ থেকে লিখছি এখানে কিন্ডারগার্টেন থেকে অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত পাবলিক স্কুল গুলোতে আনুমানিক ৯৫% এর অধিক ছাত্রই হোম স্কুলে যায়। এখানে প্রতিটা পাড়ায় ই একটি করে স্কুল আছে এবং স্কুল গুলোকে ঐ পাড়ার হোম স্কুল বলে। গড়ে প্রায় এক কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে বসবাসরত সব ছাত্র-ছাত্রীরা ঐ স্কুলে যায়। সুন্দর হাঁটা পথ। দূরত্ব একটু বেশী হলে তার জন্যে থাকে স্কুল বাসের ব্যবস্হা। এছাড়া পরিবার থেকে নিজস্ব গাড়ীর ব্যবস্হা তো থাকেই। সুতারং এই স্কুলের স্টুডেন্টদের হাতে কি কোন স্মার্ট ফোন থাকার দরকার আছে? কিন্তু সমাজ চিত্রটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বলা যায় পঞ্চম শ্রেণীর পর থেকেই প্রায় সবার হাতেই একটা সেল ফোন!?  আপনার সন্তানকে যদি এই দলে সামিল না করান তাহলে সে শুধু একরকম হীনমন্যতায়ই ভুগবে না, অন্য স্টুডেন্ট এর দ্বারা মারাত্মক ভাবে তিরস্কার এর স্বীকার হবে। গড়পড়তা এমন একটি সেল ফোনের জন্যে আপনার মাসিক খরচ প্রায় ৫০ ডলার। সম্পূর্ণ অপচয়। আপনার শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে। স্টুডেন্ট রা সৃষ্টিশীল কাজ থেকে দূরে থাকছে। এমন সব অনুসঙ্গ জড়িত থাকলেও আপনার কিছু করার নেই। কারন আপনি একটি ভোগবাদী সমাজের কাছে জিম্মি হয়ে গেছেন। শুধু আপনি না, মনে হচ্ছে রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক সবাই ই।   কারণ তারা সবাই ই হয়তো আ্যপল, স্যামসাং এর বিলিয়ন ডলার মুনাফার পকেটে। অর্থের যোগান? আবারও বলছি ভাববেন না। আপনাকে বাকী খাইয়ে আপনার কষ্টার্জিত টাকার উপরে তাদের সার্বক্ষণিক একটা হাত আছে। স্কুল ছাত্রদের গন্ডী পেরিয়ে এবার আসা যাক আমরা যারা বয়স্ক অভিভাবক গোত্রে পরি। আপনি আমি আমাদের হাতে যে ফোন এবং ল্যাপটপটি নিয়ে ঘুরছি আমাদের বেশীরভাগই এই ডিভাইস গুলোর ক্ষমতার ১০% ও ব্যবহার করি না। কিন্তু প্রতি ছয়মাস বা বছরের মধ্যে নূতন ভার্সন বাজারে এনে দ্রুতই আমাদের হাতের টা একরকম বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়া হয়। ওকে আমরা ভাবতে পারি যে না আমি পরিবর্তন করবো না। ভুল ভাবছি। এই ডিভাইসটি আমাদের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে কিনলেও এটার মালিকানা আমদের না। আমরা শুধু এটার ব্যবহার কারি। কারন প্রয়োজন না হলেও প্রস্তুতকারি কম্পানিগুলো নির্দিষ্ট বিরতিতে আপডেট এর মাধ্যমে বছর দুয়েকের মাধ্যমেই এটাকে স্লো করে ফেলবে। ব্যাটারী গরম হয়ে যাবে। বিভিন্ন উপসর্গ। এই আপডেট গুলোর উপরে আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই! আর ইতোমধ্যে চোখ ধাঁধাঁনো বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাজারে তারা নূতন মডেল তো ছেড়ে দিয়েছে ই। সাথে আছে গত শতবছর ধরে আমাদের মগজের ভোগবাদী ধোলাই।  আমরা এখন যেন ভাবতেই ভুলে গেছি আসলেই কি আমাদের এটা দরকার?

এবারে আসা যাক আমাদের বাকী খাওয়ার অভ্যাসের দাস হওয়ার গল্পে। অর্থাৎ, আর একটু সভ্য ভাষায় ক্রেডিট কার্ড নির্ভর জীবন। ষাটের দশকের মাঝমাঝি ব্যাংক আমেরিকার্ড (BankAmericard) হলো প্রথম লাইসেন্স প্রাপ্ত ক্রেডিট কার্ড। সেই থেকে শুরু, আর এখন বর্তমান বিশ্বের কেনা কাটায় ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারের চিত্রটা দু’একটা পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই ধারণা করা যাবে। এক সমীক্ষায় দেখা যায় ২০১৮ সালে শুধুমাত্র আমেরিকাতেই ৪১ বিলিয়ন ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন  হয়েছে যা অর্থের পরিমানে দাঁড়ায় ৩.৮ ট্রিলিয়ন ডলার। সুতরাং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের লেনদেনে ক্রেডিট কার্ড ই যে ক্যাশ লেনদেনের চেয়ে অনেকগুন বেশী ব্যবহৃত হয় তা পরিস্কার। এবারে অন্য আর একটি চিত্রের দিকে তাকানো যাক। টরোন্টো ক্রেডিট রেটিং কম্পানি ইকুইফ্যাক্স (Equifax) এর ২০১৯ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায় একজন কানাডিয়ান এর গড়পড়তা ক্রেডিট কার্ড এবং লাইন অব ক্রেডিট ঋণের পরিমাণ হলো ৭২৯৫০ ডলার! এটাই হলো ভোগবাদী বিশ্বের একটি চমৎকার উদাহরণ। সুতরাং প্রকৃত হিসেবে কানাডার অনেক লোকই তৃতীয় বিশ্বের একজন নাগরিক যার কোন ঋণ নেই এবং তেমন কোন সঞ্চয় ও নেই তার চেয়ে গরীব। এই ধরনের লোকগুলো কাজ করে বেতন পায় কিন্তু কদাচিত ই আর কাগজের মুদ্রায় হাত রাখতে পারে! কারন তার গোটা জীবনটাই ঐ বাকীর ফাঁদে পড়ে আছে। সে ক্রেডিট কার্ডে খরচ করে এবং বেতন যা পায় তা ঐ ক্রেডিট কার্ডের সুদ আর কিস্তি ঋণ পরিশোধ করতেই চলে যায়। কিন্তু অসুবিধে নেই,  তার গাড়ি আছে, বছরে অন্তত একবার ডিজনিল্যান্ড বা অন্য কোথাও ভ্যাকেশন ট্যুর আছে। হাতে নূতন মডেলের আইফোন আছে। আর এইসব ভোগবাদী চাহিদা মেটাতে গিয়ে জীবনের রেস ট্রাকে আছে নিরন্তর দৌড়। কারন তার পিছনে চাহিদার চাবুক। লোভের চাবুক। তাহলে জীবনের শান্তির কি হলো? সে হয়তো ভুলেই গেছে ঐ শব্দটির সংগা কি বা অর্থ কি! শতবছরের লালিত ভোগবাদী দর্শন তার মগজ থেকে তা মুছে ফেলেছে! চাহিদার পূরণে নাভিশ্বাস উঠে যাওয়া এই ভোগের মাঝেই কেবল খুঁজতে থাকে শান্তির সোনার হরিন!

বিবর্তনের সাথে সাথে বৈশ্বিক বিশ্বায়নের সুফল গুলোকে আমরা কোনভাবে অস্বীকার করতে পারবো না। এ বিশ্বায়ন এখন আমাদের জীবন চলাচলের পথে অপরিহার্য এবং তা দিনে দিনে আরও বাড়বে। পৃথিবীর সকল মানুষ আরও কাছাকাছি বন্ধনে আবদ্ধ হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের জীবন চলাচলে এখন ক্রেডিট কার্ডের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য।  কিন্ত মজার বিষয় হলো অনেক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মতোই ক্রিডিট কার্ডের সুফল গুলোর সাথেই যেন ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে রয়েছে এর ক্ষতিকর দিকগুলো। যেমন, ক্রেডিট কার্ড আমাদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে আর এই ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির মাঝেই নিহিত রয়েছে এর কুফল। আমরা অনেকেই এই ক্ষমতার অপব্যবহার বা অধিক ব্যবহার করে আমাদের প্রকৃত ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশী খরচ করে ফেলি। এবং তারপর অতি উচ্চহারের (২০% এর মতো) এক সুদের কিস্তির চক্করে পড়ে যাই। ক্রেডিট কার্ডের আর একটি বড়ো সুবিধা হলো সাথে তেমন কোন ক্যাশ টাকা নিয়ে ঘুরতে হয় না। ওয়ালেটের একটি ছোট্ট কোনায় আমরা সবসময় ২০/৩০ হাজার ডলার নিয়ে ঘুরে বেড়াই। এই সুবিধাটার সবচেয়ে বড়ো সমস্যাটা হলো আমরা প্রায়শই ভুলে যাই আমাদের ব্যাংক একাউন্ট এ কতো আছে। আর আমাদের চোখের সামনে নিত্য নূতন ভোগ্যপণ্যে বাজার তো সয়লাব হয়ে রয়েছে ই। চোখের সামনে একটা শ্রেণী দেদারসে তা অতিভোগ করে যাচ্ছে। এবং সর্বোপরি  আমাদের মাথার মধ্যে আমরা নিয়ে ঘুরে বেড়াই শতবছরের পুঁজিবাদী,  ভোগবাদী ধোলাই। সুতরাং ভুলেই যাই যে আমি একটা ২০% হারের সুদের চক্করে পড়ে যাচ্ছি। কবর খুঁড়ছি আমার নিজস্ব শান্তির। প্রতিযোগিতা মূলক বাজারে ক্রেডিট কার্ড গুলো এখন অনেক রকম ছোটখাটো সুবিধা দিয়ে থাকে। যেমন, ১-২% ক্যাশব্যাক সুবিধা ইত্যাদি… ইত্যাদি...। একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে এর প্রতিটি পয়সাই তারা আমাদের পকেট থেকে নিয়ে নেয়। কিভাবে? ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কিনলে তারা প্রতি লেনদেনে বিক্রেতাদের কাছ থেকে একটা % পরিমাণ নিয়ে নেয়। আর সেখান থেকেই ঐ ক্যাশব্যাক। তাহলে বিক্রেতারা কি করেন? তারা পণ্যের মূল্য নির্ধারণে শুরুতেই ঐ পরিমাণটা বাড়িয়ে ধরেন। সুতরাং ফলাফল? আমরা ক্রেতারাই আমাদের পকেট থেকে ঐ বাড়তি মূল্যটা পরিশোধ করছি। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এমন কি ক্যাশটাকা দিয়ে কিনলেও। ভোগের সুবিধার দন্ডীটা আমরা তাই পদে পদেই দিয়ে যাচ্ছি। ক্রেডিট কার্ডের আরও সুবিধা অসুবিধার বিস্তারিত ব্যাখ্যায় এ মুহুর্তে আর যাচ্ছি না। 

বর্তমান বিশ্বে অতিরিক্ত ভোগবাদ চিত্রের উদাহরণ এর অভাব নেই।  সে পথে আলোচনা আর দীর্ঘ করার প্রয়োজন আছে বলেও মনে করি না। বেশী উৎপাদনের সাথে আমাদের কর্মসংস্থান এর সম্পর্কটি সরাসরি। সুতরাং উৎপাদনকে ব্যাহত করা বা উৎপাদন সূত্রের বিরুদ্ধে এ নিবন্ধ নয়। নিবন্ধের উদ্দেশ্য হলো আমাদের প্রয়োজন এবং উৎপাদনের সূচক এর মধ্যে ভারসাম্য এবং সম্পর্ককে নিয়ে আলোচনা করা। উৎপাদনের প্রকৃতি, সার্বিক মানব কল্যানের জন্যে কোন ধরনের পণ্য উৎপাদনের উপরে জোর দেয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনা করা। কারন আমরা দেখছি এই বাড়তি উৎপাদনের সুবিধাভোগী শ্রেণী হলো পৃথিবীর মুষ্টিমেয় কিছু লোক। আমাদের কি প্রতিবছর সেলফোনের মডেল পরিবর্তন করার দরকার আছে? যেখানে আমরা দেখছি গত তিরিশ বছরে ক্যানসার চিকিৎসায় মূলতঃ তেমন কোন অগ্রগতিই হয়নি। একই কথা বলা যায় ডায়াবেটিস এর ক্ষেত্রেও। প্রসংগত উল্লেখ করতে হয় যে সাধারণ মানের একটা  প্যাসেঞ্জার গাড়ি তৈরী করতে গড়পড়তা ৩৯০৯০ গ্যালন পানির প্রয়োজন হয়। একটি টায়ারের জন্যে প্রায়োজন হয় ৫১৮ গ্যালন। উন্নত বিশ্বের কতো লোকের গ্যারেজে এক, দুই বা ততোধিক লাক্সারি গাড়ি সপ্তাহের পর সপ্তাহ অব্যবহৃত পড়ে থাকে। যা পৃথিবীর সম্পদের জন্যে শুধু একটা বিশাল অপচয়ই নয়, পৃথিবীর পরিবেশের উপরেও সৃষ্টি করে ভীষণ চাপ। শুধু গাড়ি নয় একটু দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে এমন অনেক ক্ষেত্রই পাওয়া যাবে যা একটি সুস্হ শান্তিপূর্ণ এবং মানবিক পৃথিবীর দর্শনের পরিপন্থী। অথচ কেবল এই কোভিড-১৯ কালেই নয়, সাধারণ সময়ের প্রয়োজনেও উন্নত বিশ্ব থেকে শুরু করে পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশগুলোতে পর্যাপ্ত হসপিটাল বেড নেই, ডাক্তার নেই, সাধারণ মানুষের আর্থিক সক্ষমতার আওতার মধ্যে কোন ভালো চিকিৎসা ব্যবস্হা বা ওষুধ নেই। এখনো প্রতিদিন হাজার হাজার নারী শিশু খাদ্যাভাবে মারা যাচ্ছে।  অন্যদিকে মারনাস্র? তার জন্যে খরচ? মানুষ মারার জন্যে যে পৃথিবী, যে দেশ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে, সেই পৃথিবী, সেই দেশগুলোই আবার মানবিকতার কথা বলে!?  এর চেয়ে বড়ো প্রহসন আর কি হতে পারে?

পরিশেষে, উৎপাদন থাকবে, প্রয়োজন মতো উৎপাদন বাড়াতে হবে অবশ্যই। কিন্তু শুধু ভোগ নয়, ন্যুনতম একটি মানবিক পৃথিবী গড়ার জন্যে যে ধরনের উৎপাদন দরকার সেদিকে একটু লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। কর্মসংস্থান তাতেও হবে। হয়তো পুঁজিপতিদের মুনাফার অংশটা একটু কমে যাবে। কিন্ত পৃথিবীর আপামর মানুষের জীবনের নিরাপত্তা এবং শান্তি তাতে বাড়বে বলেই মনে হয়। একই ভাবে বলা যায় প্রতিযোগিতা না থাকলে জীবনের তথা পণ্যের উৎকর্ষতা হবে না এটাও সত্য। সুতরাং একটা প্রতিযোগিতা মূলক বাজার কাম্য। তাই বলে সেই প্রতিযোগিতা যদি কেবল সেলফোন, কম্পিউটার আর মারনাস্র তৈরীতেই নিয়োজিত থাকে তবে তা শুধু ভোগবাদ আর আধিপত্যবাদের কথাই বলে। একটা মানবিক, শান্তিপূর্ণ পৃথিবী তৈরীতে তার কোন অবদান আছে বলে মনে হয় না। সুতরাং এ বিষয়টা গুরুত্বের সাথে ভেবে দেখার সময়ও এখনই। 

উপসংহারে অতিরিক্ত ভোগবাদ এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারনে বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্হায় যে সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে তার একটি উদাহরণ টানতে চাই। CDC ( Centers for Disease Control and Prevention) এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ২০১৭--২০১৮ সময়কালে আমেরিকায় বয়ষ্কদের মধ্যে ৪২.৪% নাগরিকই শরীরে বাড়তি ওজন বহন করছে (Suffering from Obesity)। এর প্রধান কারণ অবশ্যই খাদ্যাভাস। প্রতিদিনের খাবারে প্রয়োজনের তুলনায় বেশী ক্যালোরি নেয়া। এখানেও আর একটা মজার চক্র লক্ষ্য করা যায়। এবং তা হলো এদের অনেকেই আবার এই বাড়তি মেদ কমানোর জন্যে হয় ফিটনেস সেন্টারে যায় বা কোন না কোন ডায়েট কন্ট্রোল চিকিৎসা কেন্দ্রের শরণাপন্ন হয়। বাহ্ বেশ চমৎকার…!  পয়সার খেসারত দু’দিকেই।  কিন্তু দুঃখজনক হলো এই অপচয়টার জন্যে পৃথিবীর অন্যকোন প্রান্তে কাউকে না কাউকে থাকতে হচ্ছে অভুক্ত, বিনা চিকিৎসায়! দারুণ আমাদের এই ভোগবাদী পৃথিবীর দর্শন!! তবে এখানেই শেষ নয়। এই অতিরিক্ত ওজনের সাথে সম্পর্কিত যে রোগগুলো তার মধ্যে হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া, টাইপ ২ ডায়াবেটিস এবং কিছু বিশেষ ধরনের ক্যান্সার অন্যতম। আর সেকারণেই আমেরিকার স্বাস্হ্যখাতে প্রতিবছর শুধু এ কারনেই খরচ হয় আনুমানিক ১৪৭ বিলিয়ন ডলার। এই হলো ভোগবাদের আর এক দিক।

একসময়ে দাসত্ব, রাজতান্ত্রিক এবং সামন্ততান্ত্রিক প্রভুত্ববাদ পৃথিবীর মানবতা এবং শান্তিকে পদদলিত করেছে। তার খাঁচা থেকে বেড় হতে না হতেই তার সাথে এখন যুক্ত হয়েছে পুঁজি এবং ভোগবাদ। সংস্থা হচ্ছে, সুরম্য সব অট্টালিকায় বসে শান্তি আর মানবতার কথা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে সবই যেন এক সাজানো প্রহসন! শান্তি আর মানবতা এখনো যে তাদের সবুজ শাখাটিকে বিকশিত করতে পারে নি…!!     

ফরিদ তালুকদার। টরোন্টো, কানাডা