অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
অভিবাসীর প্রত্যাশা ও নতুন প্রজন্মের শিক্ষাসংকট - ড. মনজুর চৌধুরী

“আজীবন ছাত্র” হবার স্বপ্ন সেই বাল্যকাল থেকেই। দুভার্গ্যবশতঃ লেখার চর্চা করিনি কখনও। বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে গত কয়েক বছর আগে কিছু লিখার চেষ্টা করেছিলাম, যা অটোয়া থেকে প্রকাশিত “মাসিক আশ্রম”(মুদ্রিত)-এ প্রকাশিত হয়। এরপরে অনেকদিন লেখার চেষ্টা করিনি “সময় নেই” এই অজুহাতে।
২০২০ সালের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে এসে পুরো মানবজাতি যখন করোনা ভাইরাসের মহামারিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তখন হঠাৎ করেই মনে হলো আমার পুরোনো লিখাগুলো ‘আশ্রম অনলাইনে’ প্রকাশ করলে কেমন হয়? সেই চিন্তাতেই ‘আশ্রম অনলাইন’ পাঠকদের জন্য আমার পুরোনো এই লেখাটি। আপনাদের ভাল লাগলে ধন্য হব। - ড. মনজুর চৌধুরী

স্কো নগরীর শেষ শীতের এক ভোর। সেটা ১৯৯৭ সালের কথা। ঊষার সূর্য বসন্তকে অভিবাদন জানানোর জন্যেই যেন সোনার আলোয় উদিত হল। তাই অপূর্ব সৌন্দর্য্যের আভায় সেজে-গুজে সূর্যদেব আমাদের বাড়ীর ভিতরকেও অকৃত্রিম আলোর উজ্জ্বলতায় ভরপুর করে দিচ্ছেন। কর্মস্থলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ফোনের শব্দ বাজতেই আগ্রহেই ফোনটা ধরলাম। অপরপ্রান্তে মহিলার কন্ঠের উল্লসিত ধ্বনি শুনে অনুমান করলাম আমাদের আকাংখিত সুসংবাদবার্তা হয়ত। অভিনন্দন জানিয়ে মহিলা আমাকে অবগত করলেন যে মস্কোস্থ কানাডিয়ান হাই কমিশনে জমাকৃত আবেদনের ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, “হাই স্কীল্‌ড ইমিগ্রেশন” ক্যাটাগরীতে আমরা কানাডিয়ান অভিবাসী হবার সব শর্ত পূরণ করতে পেরেছি। সুতরাং, ইন্টারভিউ ছাড়াই আমাদের ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত কাগজ-পত্র হাই কমিশন থেকে নিয়ে আসার জন্যে আমন্ত্রণ জানালেন ভদ্রমহিলা। মুহূর্তের জন্যে হলেও হৃদয় মাতানো এক অনুভূতি যেন ভবিষ্যতের রঙ্গিন স্বপ্নের সাথে সখ্যতা গড়তে প্রস্তুত হয়ে গেল। মনে হল, আমাদের জীবনে যে খুশীর অধ্যায় আরম্ভ হয়েছে গত সপ্তাহে, এই সংবাদ যেন চলমান গতিধারার যোগসূত্র। 

গত সপ্তাহেই আমাদের অধীর অপেক্ষার সুখবর পেয়েছি যে আমার স্ত্রী সাহেদা সন্তানের মা হতে যাচ্ছে। আমাদের মেয়ে প্রমি তার গর্ভে। স্বপ্ন এবং বাস্তবতা। মানুষ কল্পনা করেই বাস্তবতার কাছাকাছি যাবার প্রয়াস পায়। ঐ মুহূর্তেই আমাদের জীবন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের তাগিদ অনুভব করতে লাগলাম গভীরভাবে। কে যেন আমার মনের খোলা জানালায় উঁকি মেরে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল “এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যেতে হবে”। মানব প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব আমাদের সবার। এবং তা এড়িয়ে যাবার প্রচেষ্টা নিজে নিজেকে ঠকানোর নামান্তর।

তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে আমার উচ্চশিক্ষা সমাপন করার সমসাময়িক সময়েই এই বিশাল দেশের এবং সামাজতান্ত্রিক বিশ্বে যেন কালবৈশাখী ঝড় সবকিছু ভেঙ্গেছুড়ে ওলটপালট করতে লাগল। অনুভব করলাম সারা পৃথিবীর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যেন রাসায়নিক পরিবর্তনের বিক্রিয়া আরম্ভ হল। সিদ্ধান্ত নিলাম মস্কোকে স্থায়ী কর্মক্ষেত্র করে আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত হয়ে শিক্ষার আন্তর্জাতিকিকরনের কাজে নিজেকে নিয়োজত করব। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশের দৃঢ় সম্পর্ক স্বাধীনতার পরীক্ষিত সময়ের বন্ধুত্বের সূত্র ধরে। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তাৎপর্যপূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করা ছিল তৎকালীন সোভিয়েত সরকারের উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে তাদের অবদানের একটি পদক্ষেপ। আর সেই সূত্র ধরেই আমার সোভিয়েত ইউনিয়নে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ। যদিও “সোভিয়েত ভাঙ্গন” পৃথিবীতে এই বিশাল শক্তির অবস্থান অকল্পনীয়ভাবে সবাইকে যেন ধাঁধার মধ্যে ফেলে দিল। কিন্তু এই সুবিশাল দেশ এবং দেশের মানুষের সক্ষমতার প্রতি আমার বিশ্বাস ছিল প্রচুর। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ীই মস্কোতে কাজ আরম্ভ করলাম। কাজের প্রারম্ভিকতার সাফল্যে আমি না যতটুকু আশাবাদী হলাম তারচেয়ে অনেক বেশী প্রশংসা এবং অনুপ্রেরণা পেলাম আমার সাথে সম্পর্কিত অনেক লোকজনের কাছ থেকে। কিন্তু সেই সাফল্যের ঊষার আলোকমালা যেন অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আমার ব্যক্তিগত পরিকল্পনার ভুলের কারণে এবং সোভিয়েত সমাজের রকেটের গতির মত পরিবর্তনরত আর্থ-সামাজিক অবস্থার অবক্ষয়িত মূল্যবোধে জন্মনেয়া দূর্নিতি আমার কঠোর পরিশ্রমে গড়া প্রতিষ্ঠানকে আঘাত করল নির্মমভাবে। আর এ জন্যেই সিদ্ধান্ত নিলাম কানাডায় অভিবাসী হবার।  

প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী অনুযায়ী আমি ‘শক্তি প্রকৌশলী’ এবং এই বিষয়ের গবেষক। কিন্তু আমার অন্তরের গভীরের যে নেশা এবং পেশার স্বপ্নকে লালন করে আসছিলাম শৈশবকাল থেকে তা আমার প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেটের সাথে সম্পর্কিত করা সহজসাধ্য নয় বলাই উচিৎ। আমার সেই স্বপ্নের পেশা এবং নেশা “আজীবন শিক্ষা (Life Long Learning) এবং তা অপরের সাথে ভাগাভাগি করে সমাজের জন্য, সারা বিশ্বের জন্যে বিতরণ করা। শিক্ষার অসীম সমুদ্রে অবগাহন করার তৃষ্ণায় আমি তৃষ্ণার্থ সেই ছোটবেলা থেকেই। সেই তৃষ্ণাকে স্থিমিত করতে পারিনি কোনো দিনই। তা অসীমের দিকে ধাবিত হচ্ছে কোয়ান্টামের গতিতে। অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনা, অদেখাকে দেখার তৃষ্ণা এখনও শিশুকালের মত। আর সেই অফুরন্ত জিজ্ঞাসার সুতা দিয়ে আমি জ্ঞানচর্চার মালিকা গেঁথে নিয়েছিলাম আমার হৃদপিণ্ডের ডান ও বাম অলিন্দের সাথে সেই পাঠশালা স্কুল থেকে। আর এ জন্যেই “শিক্ষার জগতে” নোঙ্গর ফেলেছি স্থায়ী নিবাস গড়ার নিমিত্তে। শিশুর মত হলেও হামাগুড়ি দিয়ে সামনের দিকে এগুচ্ছি এবং পণ করেছি একদিন এই প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগাব বৃহত্তর মানব সমাজের কল্যাণে। আর এই মনের অতলে বাস করা ইচ্ছাশক্তিকে পুঁজি করেই একবিংশ শতাব্দীর অফুরন্ত সম্ভাবনা অথচ পর্বতসমান বাধা বিপত্তির জন্য উপযুক্ত করে এবং অভিভাবকদের হৃদয়ের গভীরের চাহিদার সাথে খাপ খাইয়ে একটি “শিক্ষা মডেল” তৈরি করে যাচ্ছি আমি গত এক দশকেরও উপরে। এই মডেলের নাম “এলাইভ এডুকেশন”।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জাতির অগনিত মানুষের স্বপ্নের দেশ কানাডা। সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন মাপকাটিতে কানাডা পৃথিবীর শ্রেষ্টতম দেশের মধ্যে একটি হিসেবে স্থান করে নিয়েছে জেনেই উত্তর আমেরিকার এই ভূখণ্ডের অভিবাসী হবার লোভ আমার মত অনেকেরই। আর এই লোভের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। তাই, সন্তানদের সুন্দর জীবন গড়ার পরিকল্পনা থেকেই অসংখ্য অভিবাসীরা নিজেদের জন্মভূমির বহুমাত্রিক সুযোগ সুবিধা পরিহার করে এবং আপনজনদের দূরে রেখে চলে আসেন স্বপ্নের নীড় গড়তে এখানে। সু-শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সন্তানরা তাদের জীবনকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করে মা-বাবাদের বুকে আনন্দের ঢেউ যেন সঞ্চালন করবে এই বাসনা নিয়েই অভিবাসীরা দিন গুনতে থাকেন ভবিষ্যতের অপেক্ষায়। সুতরাং অনেক অভিবাসীর মত আমিও আনন্দে আপ্লুত হলাম ভবিষ্যতের সুন্দর দিনগুলোর কথা ভেবে যখন আমার স্ত্রীর এবং আমার প্রাণের প্রদীপ অতিথি-সন্তানকে পৃথিবীর শ্রেষ্ট দেশের একটিকে তার জন্মস্থান হিসেবে উপহার দিব যেখানে সে পড়াশুনা করে আমাদেরকে এবং সমাজকে উৎসর্গ করবে তার অফুরন্ত সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ঋতুরাজের হৃদয় মাতানো প্রাকৃতিক বৈচিত্রের সাথে আমার এই অনুভূতি একত্রীভূত হয়ে হতাশার গ্লানিকে ধুয়ে পরিস্কার করে সব প্রত্যাশার জানালা যেন খুলতে লাগল। আর এই সূত্র ধরেই ১৯৯৮ সালের আরেক বসন্ত যখন কানাডাকে তার আগমন বার্তা জানিয়ে মহাখুশী করায় ব্যস্ত, আমি এবং আমার স্ত্রী ঠিক সেই সময়েই মন্ট্রিয়লে আমাদের অভিবাসী জীবনের প্রস্তুতি পর্বের জন্য পাড়ি জমালাম।

কানাডিয়ান শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত মানের সুযোগ গ্রহণ করে অনেক পিতামাতাই তাদের সন্তানদের দ্বারা স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছেন বলে নিঃসন্দেহে তাঁরা ভাগ্যবান। কিন্তু সেই সৌভাগ্যবান পিতা-মাতার সংখ্যা কি সন্তুষ্টজনক? আমি আতঙ্কিত। সেই সংখ্যা শুধু আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে কমই না বরং দিন দিন নিম্ন গতির ধারায় ধাবমান। এই স্বাভাবিক কারণেই অনেক পিতা-মাতাই সন্তানদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই হতাশার কারণ বহুবিধ। কিছু পিতা-মাতারা এইসব প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে নিজেরাই বের করেছেন বিকল্প পন্থা। কেউ পাঠাচ্ছেন প্রাইভেট স্কুলে, কেউবা সাহায্য নিচ্ছেন স্কুল শেষ হবার পরের সময়ে সেবাদানকারী লারনিং সেন্টারের (যেমন কুমন, অক্সফোর্ড লারনিং, সিলভান লারনিং ইত্যাদির)। আর অনেকেই হয়ত চেষ্টা করছেন নিজেরাই নিজেদের সন্তানদের পড়াশুনায় সাহায্য করতে। যারা—স্কুলের বাইরের সাহায্য নিচ্ছেন তাদের মতামত অনুযায়ী তারা উপকৃত হচ্ছেন ঐ সাহায্যে। এ প্রসঙ্গে অটোয়াস্থ এক প্রাইভেট স্কুলের সাফল্যের উদাহরণ অনেক অভিভাবককেই অবাক করে দিবে হয়ত। Fraser Institute এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ‘আবরার স্কুল’ নামে একটি ইসলামিক প্রাইভেট স্কুল সামগ্রিক বিচারে অটোয়াস্থ সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। Fraser Institute এর রিপোর্ট অনুযায়ী আবরার ইসলামিক স্কুল ৯.৪ পেয়েছে ১০ এর মধ্যে এবং এই স্কুলের নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী হচ্ছে French Catholic School Georges Etienne Cartier (Ottawa Sun, February 16, 2013). CBC খবরের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে যে, অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ভর্তি করানোর জন্য অধীর আগ্রহে আবরার স্কুলের ‘অপেক্ষার লিস্টে’ আছেন। কারণ স্কুলের পক্ষে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে স্থান সংকুলান করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। স্কুলের অধ্যক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী অনেক গর্ভবতী মা ইতিমধ্যে ‘অপেক্ষার লিস্টে’ তাদের হবু সন্তানদের জন্য আগাম স্থান পাবার আশায় আবেদন করে রেখেছেন। নিশ্চয়ই এই উদাহরণ আমাদেরকে পরিস্কারভাবে জানিয়ে দিচ্ছে যে অনেক অভিভাবকরাই বর্তমান কানাডিয়ান শিক্ষা ব্যবস্থার সেবার চেয়ে আরও বেশী কিছু আশা করেন। আমার ধারনা আমাদের সন্তানদের শিক্ষা এবং তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এর সাথে সম্পর্কিত সমস্যা এবং সমাধান খুঁজতে হবে আরও গভীরে। বাহির থেকে সমাধানের চেষ্টা না করে সমস্যার অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে সঠিক (Inside-out approach) ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 

সন্দেহ নাই, আপেক্ষিকভাবে আমাদের কানাডিয়ান শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক সুযোগ সুবিধাই আমরা উপভোগ করতে পারি অভিভাবক হিসেবে যদি আমরা সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারি ব্যক্তিগতভাবে এবং সমষ্টিগতভাবে। কিন্তু আমরা কয়জন অভিভাবক সমষ্টিগতভাবে তো দূরের কথা, ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে আমাদের নিজেদের সন্তানদের স্কুল এবং তাদের প্রাত্যহিক জীবন কিভাবে পরিচালনা করছে তার খবর নিতে পারছি? এটা অনস্বীকার্য যে সন্তানদের সুন্দর জীবন গঠনে পিতামাতা এবং শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবতঃ এখানেই খুঁজতে হবে আমাদের আকাঙ্খিত সমস্যার সমাধান। পিতা-মাতা, ছাত্র-শিক্ষক সমীকরণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আসল সমাধান। এই সমীকরণ নিঃসন্দেহে সহজ সমীকরণ নয়। কারণ বহুবিধ সীমাবদ্ধতার (Constraints) শর্ত আরোপিত আছে সমীকরণকে ঘিরে। প্রথম সীমাবদ্ধতা হচ্ছে—একবিংশ শতাব্দীর “বাস্তবতা”। একদিকে মানুষ কোন কিছু চাওয়ার আগেই যেন তা তাকে দেবার জন্যে এক অলৌকিক শক্তি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে মানুষের “অসন্তুষ্টি”র মাত্রা দিনের পর দিন বেড়েই যাচ্ছে। “প্রাচুর্যতা” যেন হয়ে গেছে আমাদের প্রতিদিনের চাহিদা। যতই বেশী পাচ্ছি ততই যেন বেশী অসন্তুষ্ট হচ্ছি। কমেডিয়ান Louis CK এর ভাষায়, “Everything is amazing right now and nobody is happy.” আর এই সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত মানবগোষ্ঠীর সবাই। অবাক হবার কারণ নেই যে, এরই প্রতিফলন ঘটছে অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে আমাদের সন্তানদের উপরে। পিতামাতা এবং শিক্ষকদের যেখানে হতে হবে Role model সেখানে তারা যদি ‘ইন্টারনেটের’ আসক্তিতে আসক্ত হয়ে ‘Facebook’ আর ‘YouTube’ এ নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখেন, শিশুরাও সেই আসক্তিতে আসক্ত হলে মনঃক্ষুন্ন হবার কোন যুক্তি আছে কি?

তাই, চলুন আমাদের মূল সমীকরণে ফেরা যাক। সমীকরণে পিতামাতাদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে সমাজ এবং সময়ে জীবন-যাপন করছি সেখানে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই পিতামাতা দু’জনকেই দিনের দীর্ঘ সময় পরিবারের অর্থনৈতিক চাহিদা মেটানোর জন্য কাজ করতে হয়। তাই ঘরের এবং বাইরের কাজ করার শেষে সন্তানদের জন্য গুণগত সময় বের করা প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে অনেক পিতামাতাই নিজেদের সন্তানদের পড়াশুনায় সাহায্য করতে খুব সফল হতে পারেন না এমনকি স্কুলের বিষয়ের উপর দক্ষতা থাকলেও আবার এমনও পিতামাতা আছেন যাদের ইচ্ছা থাকলেও দক্ষতার অভাবে খুব একটা সাহায্য করতে পারেন না। কিন্তু এতো গেল পড়াশুনায় সাহায্য করার ব্যাপার। অন্য বড় দুশ্চিন্তার বিষয় যা আমাদের সবার জন্যে প্রযোজ্য তা হচ্ছে ‘ইন্টারনেট’। ‘ইন্টারনেট’ যেমন করতে পারে উপকার তারচেয়ে আরও বেশী করতে পারে অপকার। ওঠা মূলতঃ নির্ভর করে বিশেষ ব্যক্তিটি কিভাবে সুযোগটাকে কাজে লাগাচ্ছেন, নাকি বাজে কাজে ব্যয় করছেন। সাম্প্রতিক কানাডিয়ান এবং আমেরিকান সমীক্ষায় দেখা গেছে যে আমাদের সন্তানরা গড়ে দিনে ১১ ঘন্টা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে তাদের সময় অতিবাহিত করে। এই সময় অবশ্য স্কুল চলাকালীন তাদের বিভিন্ন কার্যবিধির সাথে যুক্ত করা। তবে যে কোন অভিভাবককেই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ করে যখন আমরা কানাডিয়ান সমীক্ষায় দেখি (Survey by market researcher IPSOS) যে কানাডিয়ান তরুণরা প্রতিদিন গড়ে ৫ঘন্টা স্মার্টফোন, Texting, Social networking, Gaming এবং ভিডিও দেখে কাটায়। সমাজবিজ্ঞানীরা চিন্তিতঃ যে এই অবস্থা আমাদের নতুন প্রজন্মের মানব সদস্যদের জন্য এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে যে তাদের পক্ষে ফোকাস (Focusing) করে এবং গভীরভাবে কিছু চিন্তা করে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। পিতামাতা এবং শিক্ষাবিদরা চিন্তিতঃ এটা দেখে যে নূতন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তাদের দিনের দীর্ঘ সময়ের ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবহার করার কারণে “দুঃশ্চিন্তা” (anxiety) তাদের জন্য সংক্রামক ব্যাধি হয়ে দেখা দিচ্ছে। সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে যে অনেক ছেলেমেয়েরাই আজকাল তাদের ঘুমের সময় কমিয়ে ৩ থেকে ৪ঘন্টা করে ফেলেছে। স্মার্টফোন তাদের বালিশের নীচেই পাওয়া যায় ভোরে। তাছাড়া On line bullying যে অনেক সন্তানদের জন্যে কি করুণ পরিস্থিতি তৈরি করছে তা বর্ণনাতীত। ইতিমধ্যে কিছু কিছু বাবা মা তাদের সন্তানদের চিরজীবনের জন্য হারিয়েছেন সেই On line bullying এর শিকার হয়ে। ৩ জনের মধ্যে ২ জন বাচ্চাদের কথায় বাড়ীতে তাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবহারের কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। আরেক জরিফে দেখা গেছে ৬০ শতাংশ তরুণরা রাতের অন্ধকারে অর্থাৎ বাড়ীতে বাবা মা ঘুমানোর পরেও Text প্রেরণ অথবা গ্রহণ করে (after “light out”)। স্বাভাবিক কারণেই তারা স্কুলে মনোযোগ দিতে পারে না এবং পরিশ্রান্ত (Tiredness) অনুভব করে।

এখন শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়ে আলাপ করা যাক। একবিংশ শতাব্দীর কানাডিয়ান শ্রেণীকক্ষ ইলেকট্রনিক মিডিয়া দিয়ে পরিপূর্ণ থাকবে এটাতে অবাক হবার কারণ কমই। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীদের হাতে স্মার্টফোন, আইফোন, আইপেড ইত্যাদি যাবে এটাও স্বাভাবিক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একজন শিক্ষক কিভাবে এ দায়িত্ব পালন করবেন যাতে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীই সেই ইলেকট্রনিক মিডিয়া যথাযুক্ত কাজে যেন ব্যবহার করে। সাধারণতঃ একটা শ্রেণীকক্ষে ২৫ থেকে ৩০ জন ছাত্রছাত্রী অধ্যয়ন করে। শিক্ষকের দায়িত্ব প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী যেন তাঁর দেয়া নির্দেশিত কার্যবিধি পালন করে। ইন্টারনেটের ক্ষমতা আজ অচিন্তনীয়। মাল্টিটাস্কিং হচ্ছে ইন্টারনেটের সেবা প্রদানের অন্যতম কাজ। তাই ছাত্রছাত্রীরাও সেই সুযোগের সবকিছু গ্রহণ করতে কার্পণ্য করে না একটুও অন্ততঃ অনেকেই। কিছু ব্যতিক্রমধর্মী ছাত্রছাত্রী অবশ্যই আছে যারা স্কুলে আসে সত্যিকারের শিক্ষা গ্রহণের জন্যই। তাই দেখা যাচ্ছে, ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে এবং বাড়ীতেও ইন্টারনেটের বহুমুখী ক্ষমতার কারণে তারা নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী উপকার এবং অপকারের জন্যে কাজ করতে পারে একইভাবে। অভিভাবক এবং শিক্ষকরা ইচ্ছা করলেই তাদেরকে বিরত করতে পারেন না অনেক সময়ই অসহায়ভাবে। আর এ জন্যে এই সমীকরণের ভিতরে ঢুকে বের করতে হবে সমাধান। কিন্তু এই সমাধানের জন্য প্রয়োজন আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ। মানব ইতিহাসের যে ‘সময়’ দিয়ে আমরা পরিভ্রমণ করছি তাকে অনুধাবন করতে হবে আরও গভীরভাবে। বুঝতে হবে মানুষের ক্ষমতা এবং তার সীমাবদ্ধতা। মানুষ তার নিজের ক্ষমতা দিয়ে যা করতে পারছে তা দেখে নিজেই আতঙ্কিত হচ্ছে এই ভেবে যে তারই দ্বারা তৈরি “সৃষ্টি” তাকে পিছনে ফেলে সেই “সৃষ্টি” মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এই প্রসঙ্গে Neil Turok আজকের যুগের প্রথম সারির তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার পণ্ডিত এবং বিখ্যাত শিক্ষাবিদ এর গ্রন্থ “The Universe Within : From Quantum To Cosmos” এ বর্ণীত তার চিন্তার আলোকে আমার এই অতি সাধারণ চিন্তার পরিসরে প্রতিফলন করতে চাই। তাঁর ভাষায়, “ Short-term thinking is endemic, as is natural when things are moving fast. It is as if we are driving a speeding car through a fog, swerving avoid potholes, roadblocks, or oncoming vehicles, anxiously anticipating the dangerous with no power to protect them. Politicians tend to think in further than the next election, scientists no further than the next grant.” আর এ জন্যেই আমি বার বার ফিরে যাই Stephen Covey’s বিখ্যাত উদ্ধৃতি, “We begin with the end in mind.” শিশুকাল থেকেই আমাদের সন্তানদের প্রকৃতিকে জানার উৎসাহে উৎসাহিত করতে হবে। তারা কোথায় এবং কি তাদের কাজ এই পৃথিবীতে সেটা তাদের বুঝাতে হবে, তাদেরকে প্রাণবন্ত করে তুলতে হবে। স্কুলে আমাদের সন্তানদের প্রথম বুঝাতে হবে তাদের স্কুলে যাবার উদ্দেশ্য। ‘শিক্ষা’ গ্রহণের আসল উদ্দেশ্য কি সেটা আমরা যারা অভিভাবক, শিক্ষক তাদেরকেও আরও গভীরভাবে বুঝতে হবে। আমি পদার্থ বিজ্ঞানী নীল টিউরক এর সাথে একমত যে, আমাদের একটু পিছনে যেতে হবে “ডিজিটেল এইজের” মনমাতানো (Overwhelming) অবস্থান থেকে। এটা সহজেই বোধগম্য যে মানুষ ইন্টারনেটের তথ্যের সমুদ্রে সাতার কাটতে গিয়ে গভীরভাবে কিছু বোঝার চেয়ে হাবুডুবু খেয়েই শুধুমাত্র হালকা কিছু খবর জেনেই শেষ করে দিচ্ছে তার জানার পরিধি। কিন্তু আজকের এই পৃথিবীর প্রয়োজন অনেক গভীর চিন্তার মানুষ। ইতিহাসের যে কোন সময়ের চেয়ে আজকের সময়ের জন্য ঐ মানবগোষ্ঠীর প্রয়োজন অনেক বেশী।

“সহযোগিতা” (Collaboration) আজকের সময়ের সবচেয়ে বড় প্রয়োজনীয় হাতিয়ার। স্কুলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার বিষয়বস্তু এবং শিক্ষা প্রদানের ধরন সময়ের সাথে তাল মিলাতে পারছেনা কোনভাবেই। আজকের তরুণ এবং যুব সমাজ গতানুগতিকভাবে জ্ঞান অর্জনের পন্থা গ্রহণ করতে রাজী না। কারণ প্রায় সবকিছুই তো ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে পাওয়া যাচ্ছে। সবচেয়ে যে জরুরী দক্ষতা তাদের দরকার তা হচ্ছে তাদের নিজেদের ব্যাপারে তাদেরই চিন্তার আলোকে পছন্দ করে নিতে হবে কি তাদের শিখতে হবে, বিকাশ করতে হবে তাদের চিন্তাকে এবং অন্যের সাথে তা ভাগাভাগি করতে হবে। খুঁজতে হবে বড় ভাবনা, বড় চিত্র। How to see the big picture? জ্ঞান অর্জনের আসল উদ্দেশ্য এবং ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন করতে হবে। আর এরই যোগসূত্রে স্বকীয়তা, গঠনতান্ত্রিকতা, সৃজনশীলতা এবং মননশীলতা হবে আজকের শিক্ষার বড় বিষয়। একই সাথে পশ্চিমা সমাজ যে হাতিয়ারকে পুঁজি করে বিশ্বের অর্থনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল তারও পরিবর্তন অপরিহার্য। বলাইবাহুল্য ঐ হাতিয়ার ছিল “Knowledge Worker” তৈরি করা। তাই তারাই আজ অনুধাবন করছে শুধুমাত্র “Knowledge Worker” তৈরি করে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব না।

উল্লেখিত বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা থেকে এটা পরিস্কার যে একটা Optimum শিক্ষা মডেল (সবার জন্যে গ্রহণযোগ্য) তৈরি করতে হবে যা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সেবা দান করতে সক্ষম হবে। আর এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অভিবাসী সদস্যদের এই সেবার প্রয়োজন আরও বেশী সংগত কারণেই। এই সবকিছু বিবেচনা করেই আমাদের “এলাইভ এডুকেশন” এর সেবা দানের যথার্থতা আমরা প্রমাণ করি। প্রথমতঃ এটা অভিনব (Innovative) এবং কার্যকরী (Effective) শিক্ষা প্রদান এবং শিক্ষা গ্রহণ এর এক মডেল যা প্রচলিত কানাডিয়ান প্রাথমিক এবং হাই স্কুলের শিক্ষার ক্যারিকুলামের উপর ভিত্তি করে সম্পূরক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। এটাকে আমরা ত্রিভূজ আকৃতির (Triangular) মডেল হিসেবে চিত্রায়িত করি। আর এই ত্রিভূজের ভিত্তি (Base) হচ্ছে- ‘উদ্দেশ্য’ (purpose) অন্য বাহু হচ্ছে ভাষায় দক্ষতা বা আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে অত্যন্ত জরুরী অঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত। কারণ মানুষ মানুষের সাথে যোগাযোগ করবে অর্থপূর্ণভাবে। ত্রিভূজের তৃতীয় বাহু যা হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর সময়কে, বিশ্বকে, বিজ্ঞানকে মানব সভ্যতার কাজে লাগানোর জন্য তা হচ্ছে গণিত। কারণ গণিত হচ্ছে প্রকৃতির ভাষা, গণিত এর ভিতরে ঢুকেই আমরা পারি প্রকৃতির রহস্যকে অনুধাবন করতে। গণিত প্রমাণ করে দিয়েছে মানব সভ্যতার সাফল্যে তার অবদান বিশেষ করে একাবিংশ শতাব্দী আজ যে পর্যায়ে সভ্যতাকে নিয়ে এসেছে। আমরা বলছি আমাদের মডেল Optimum কারণ আমরা সবকিছু বিবেচনা করেই সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম (Option) -কেই গ্রহণ করেছি। উপরের আলোচনায় আমি দেখিয়েছি যে কিছু অভিভাবক তাদের সন্তানদের প্রাইভেট স্কুলে পাঠিয়ে লাভবান হচ্ছেন। অন্যরা স্কুল ছুটির পরের সময়টুকুতে লারনিং সেন্টারে পাঠাচ্ছেন। অন্যদিকে কানাডিয়ান পাবলিক স্কুল সিস্টেম থেকে যে সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে তাও সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারছেন না বেশীরভাগ পিতা-মাতারাই। তাই আমাদের মডেল এই সবকিছু বিবেচনা করেই সেবা প্রদান করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। প্রথমতঃ আমরা কানাডিয়ান সনদপ্রাপ্ত শিক্ষক যারা এই মডেল তৈরি করেছি এবং আমরাই এই মডেলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী শিক্ষা দান করি ছাত্রছাত্রীদের। দ্বিতীয়তঃ আমরা কারো প্রতিযোগী নই বরং আমরা পাবলিক স্কুল সিস্টেমের সাথে সহযোগিতা করে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দান করি। অভিভাবকরা যারা মনে করেন স্কুলের বাইরের সাহায্য নিলে অথবা প্রাইভেট স্কুলে পাঠালে তাদের সন্তানদের উপকার হবে বেশী কিন্তু সময় এবং সুযোগ কোনটাই তাদের পক্ষে নেই আমরা ঐ অভিভাবকদের সাহায্য করতে পারি নিশ্চিতভাবে। কারণ আমরা প্রাইভেট এবং পাবলিক স্কুলের মধ্যখানে অবস্থিত। পাবলিক স্কুল বিভিন্ন কারণে অভিভাবকদের প্রত্যাশিত চাওয়াকে যখন দিতে পারছে না আমরা সেই চাহিদা মিটানোর কাজ করি। অন্যদিকে প্রাইভেট স্কুলে পাঠানোর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করার প্রয়োজনীয়তা সরিয়ে আমরা অভিভাবকদের প্রদান করতে পারি তাদের প্রত্যাশিত শিক্ষা দান। আমাদের সাফল্যের গোপনীয়তা হচ্ছে আমাদের শিক্ষকদের Enthusiastic commitment. আমাদের শিক্ষকদের দর্শন হচ্ছে—ছাত্রদের শিক্ষা প্রদান করতে প্রথমতঃ শিক্ষকদেরও পড়াশুনা করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ ছাত্রদের মনের ভিতরে শিক্ষা গ্রহণের চাহিদাকে পুলকিত করতে হবে উৎসাহের আলো জ্বালিয়ে। আর এ জন্যেই সম্ভব তাদেরকে ইন্টারনেটের সর্বনাশকারী আসক্তি থেকে বের করে মানব সমাজের জন্যে, তার নিজের জন্য সর্বোপরি এই বিশ্বের জন্যে কাজে উদ্যোগী করতে। এর পাশাপাশি ইন্টারনেটের ভালটুকুও গ্রহণ করে নেবার সুযোগ হাতছাড়া করা চলবে না।

অভিভাবকদের স্বপ্নের বাস্তবায়নের প্রথম এবং অপরিহার্য শর্ত তাদের নূতন প্রজন্মকে সুন্দর জীবনের জন্যে প্রস্তুত করা। সন্দেহ নাই, সেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে বহুমুখী বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। আশার আলো কিন্তু চারিদিকেই এবং একটু গভীরভাবে খুঁজলেই তা পাওয়া সম্ভব। অন্যদিকে চোখ-কান বন্ধ রাখলে রাস্তা হারানোর বিপদই স্বাভাবিক। আর এই সঠিক দিক নির্দেশনার জন্যে প্রয়োজন গুণগত শিক্ষা (Quality Education)। একবিংশ শতাব্দীর সন্তানদের শিক্ষার উপাদান, শিক্ষা প্রদানের পদ্ধতি সর্বোপরি সময় আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে কি চাচ্ছে তার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সামনে চলার পদক্ষেপ। বিংশ শতাব্দীর সন্তানদের কাছে অভিভাবকদের প্রত্যাশা ছিল স্কুলে ভাল ফলাফল করে ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সুন্দর বাড়ী, সুন্দর গাড়ী এবং সমাজের অন্যান্য সদস্যদের মাঝে সুপ্রতিষ্ঠিত হবার। ঐ শতাব্দীরই শেষ দিকে নূতন প্রজন্মের কাছে ঐ আহবান খুব উৎসাহ তৈরি করতে পারছিল না। বরং পড়াশুনায় ভাল করলে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা ব্যবসায় ডিগ্রী (MBA) নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবার ঢেউ তাদেরকে প্লাবিত করতে লাগল। Peter Drucker এর ভাষায় মানব সমাজ “Knowledge-worker” তৈরি করতে লাগল। আর এই “Knowledge-worker” হবার জন্যে পশ্চিমের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নতুন প্রজন্মের সন্তানরা কিছু specific বিষয়ের উপর দক্ষতা নিয়েই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবার টিকেট পাবার সুভাগ্য পাচ্ছিল।

২০১৪ সালে কিন্তু সেই টিকেট আর সহজেই পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষ আজ প্রবেশ করছে আরেক নতুন যুগে। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী এর নামকরণ করেছেন বিভিন্ন নামে। Daniel H. Pink তাঁর বহুল সমাদৃত বই “A Whole New Mind”-এ এই যুগকে বলেছেন—Moving from the information age to the conceptual age. বিশ্বায়নের এই সময়ে আমরা যে অর্থনীতি এবং সামাজিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করছি তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই সমাজের ভিত্তি হবে inventive, empathic, big picture capabilities এর উপরে। Neil Turok এই সময়কে বর্ণনা করেছেন “The Opportunity All Time” হিসেবে। তিনি মানব সভ্যতা “Quantum Age” এ প্রবেশ করছে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

আমি বিশ্বাস করি যে, আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা পারব আমাদের সন্তানকে Quantum Age এর কারিগর বানাতে। কিন্তু সেই কারিগর শুধু যান্ত্রিক কারিগর হলেই হবে না এবং এটা সময়েরও দাবী না। বিজ্ঞানকে সমাজ থেকে আলাদা করার উপায় আর নেই। আমাদের সন্তানদের সমাজকে বুঝতে হবে আরও যত্ন নিয়ে। আমরা পশ্চিমা সমাজের “প্রাচুর্যতা” দেখছি এবং অনেকেই তা উপভোগ করছি। কিন্তু সেই “প্রাচুর্যতা” যে আমাদের ভিতরের আকুতি এমনকি মানবগোষ্ঠীর কাউকেই সন্তুষ্ট করতে করতে পারছে না—তা হয়ত আমার মত অনেকেই অনুধাবন করছেন।

আর তাই আমাদের প্রচেষ্টা নতুন প্রজন্মকে নতুন উদ্দীপনায় সু-শিক্ষিত করতে সহায়তা করা যাতে তারা আনন্দ উৎসাহে সমাজ গড়ার কাজে প্রস্তুত হয়। সম্ভবতঃ এ জন্যেই Albert Einstein মন্তব্য করেছিলেন- “Education is not the learning of facts, but the training of the mind to think.” আমরা এই মতে বিশ্বাসী। তাই আমাদের প্রতিষ্ঠান AliveEducation আমাদের সন্তানদের মনের ভিতরে আলো জ্বালানোর কাজের প্রতিজ্ঞায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আর সেই আলো তাদেরকে উদ্দীপ্ত করবে প্রথমতঃ নিজেদের ভবিষ্যৎকে সুন্দর করতে, সাথে সাথে তারা উদ্দীপ্ত করবে সমাজকে এবং সারা মানব গোষ্ঠীকে। আর তখনই বিশ্বায়নের উপকারিতা অনুভব করবে বিশ্বের সর্বশ্রেনীর মানুষ। তাই আমরা AliveEducation এর সেবাদানকারী শিক্ষকরা বিশ্বাস করি যে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা যখন সত্যিকারের শিক্ষা গ্রহণের দায়িত্ব অনুভব করবে তখন তারা যেমন তাদের স্ব স্ব স্কুলে আকর্ষণীয় ফলাফল অর্জন করবে তেমনি তাদের পরিবারে এবং সমাজে অবদান রাখতে পারবে আশাতীতভাবে।

ড. মনজুর চৌধুরী। অটোয়া, কানাডা 
Sources
1)The Universe Within: Quantum to Cosmos (Neil Geoffrey Turok)
2)A Whole New Mind (Daniel H. Pink)
3)The Age of Empathy (Frans De Waal)