অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
প্রতিবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম - সুনির্মল বসু

তিনি বলেছিলেন, বন্ধুগণ, আমি কবি হতে চাইনি, আমি নেতা হতে চাইনি, আমি মানুষকে ভালোবেসে ছিলাম, মানুষের ভালোবাসা পেতে চেয়েছিলাম, তাই যেদিন আমি এই পৃথিবীতে থাকবো না, সেদিন আমার কবিতা পড়ে যদি আপনার চোখে জল আসে, তাহলে মনে করবেন, এ হলো সেই নজরুল, যে কখন হারিয়ে গেছে, খিরকির দুয়ার পেরিয়ে।

কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। পিতা কাজী ফকির আহমেদ ও জননী জাহেদা খাতুন। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান তিনি। পিতা নাম রেখেছিলেন দুখু মিয়া। কারণ, তিনি জানতেন, এই ছেলেকে সারাজীবন দুঃখ দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বড় হতে হবে। নজরুল রেলের গার্ড সাহেবের বাড়িতে চাকরের কাজ করেছেন, চায়ের দোকানে বয়ের কাজ করেছেন,লেটোর যাত্রার দলে গান লিখেছেন। তবু এরই ফাঁকে তিনি মানুষের জন্য গল্প লিখতেন।

এই গ্রামেই তার বন্ধু ছিলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। লেখা নিয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা চলত। গ্রামের প্রকৃতি ও মানুষ দুজনের সাহিত্যে উঠে আসত। শৈলজানন্দ কবিতা লিখতেন, নজরুল লিখতেন গল্প। দুজনের কথা হয়েছিল, শৈলজানন্দ কবি হবেন, নজরুল হবেন কথা সাহিত্যিক। পরবর্তীকালে অবশ্য দুজনেরই পথ বদল হয়ে যায়।

নজরুল পড়াশোনা করেছেন শিয়ারসোল হাই স্কুলে। ফি এর টাকা জমা দিতে না পারায়, ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারেননি। এরপর যুদ্ধের সময় গৃহী সেনাবাহিনীতে হাবিলদার হিসেবে যোগ দেন। তখন গল্প লেখার মত সময় হাতে না থাকায়, কবিতা লিখতে শুরু করেন। অন্যদিকে, রানীগঞ্জের কয়লা খনিতে কাজ নিয়ে শৈলজানন্দ প্রথম উপন্যাস লেখেন কয়লাকুঠি। দুজনের পথ বদল হয়ে যায়। নজরুল কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান, অন্যদিকে শৈলজানন্দ ঔপন্যাসিক হিসাবে চিহ্নিত হন।

দু বছর বাদে সেনাবাহিনীর কাজ ছেড়ে দিয়ে, নজরুল কাঁধ থেকে রাইফেল নামিয়ে রাখেন, তখন তাঁর কলম হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ রাইফেল। মোসলেম ভারত পত্রিকায় প্রকাশিত বিদ্রোহী কবিতা তাঁকে দেশ জোড়া খ্যাতি এনে দেয়। তিনি লেখেন,
     আমি ভৃগু ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন,
     মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন।
ব্রিটিশ শাসকেরা তখন এদেশের বিপ্লবীদের জেলে বন্দী করছিলেন। নজরুল লিখলেন,
     ভেঙে ফেল কররে লোপাট যতসব বন্দীশালা,
     আগুন জ্বালা।

নার্গিসকে একসময় তিনি ভালোবেসে ছিলেন, কিন্তু সেই ভালোবাসা বিবাহের রূপ নিতে পারেনি। অসম্ভব সুন্দর সুন্দর নজরুল গীতিতে কবির মনোবেদনার সেই ছবি ধরা রয়েছে। নজরুল গীতি বাংলা সাহিত্যের সেরা সম্পদ। তিনি একে একে লিখেছেন, অগ্নিবীণা, সঞ্চিতা, বিষের বাঁশি প্রকৃতি কাব্য।

শিশুদের জন্য মজার মজার ছড়া আছে তাঁর।
      বাবুদের তাল-পুকুরে হাবুদের ডাল-কুকুরে
     সে কি বাস করলে তাড়া, বলি থাম্ একটু দাঁড়া।
আবার শিশুতোষ কাব্য রয়েছে,
     কাঠবেড়ালি কাঠবেড়ালি
     পেয়ারা তুমি খাও, দুধ-ভাত খাও, ছোঁচা তুমি,
     তোমার সঙ্গে আড়ি আমার যাও।

মানবতার অপমান দেখলে, তিনি কবিতায় তার প্রতিবাদ করতেন। লিখেছেন,
     দেখিনু সেদিন রেলে কুলি ব'লে এক বাবু সা'ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে, চোখ ফেটে এল জল, এমন করিয়া জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল।

পরবর্তীকালে তিনি বর্ধমানের কন্যা প্রমীলা সেনগুপ্ত কে বিবাহ করেন। নজরুল ছিলেন জাত-পাতের ঊর্ধ্বে। বলেছেন,
     একই বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু মুসলমান।

তিনি মানব ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। কোরআন বাইবেল যেমন তাঁর পড়া ছিল, তেমনি বেদ উপনিষদ তিনি খুলে খেয়েছেন। তাঁর মত শ্যামা সংগীত অন্য অনেকের পক্ষে লেখা, স্বপ্নের ব্যাপার।
তাঁর বড় ছেলে কাজী বুলবুল যেদিন মারা গেলেন, সেদিন তাকে গোরস্থানে সমাধিস্থ করে এসে নজরুল বলেছিলেন, আজ আমার মন গভীর ব্যথায় আচ্ছন্ন যখন, তখন বাড়ির মধ্যে ফুটে থাকা একটা হাসনুহানা ফুলের মধ্যে আমি ঈশ্বরকে দেখলাম।
রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তিনি ঢুকলে বলতেন, দে গরুর গা ধুইয়ে। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ওই যে জ্যৈষ্ঠের ঝড় এসে গেছে।

একসময় তিনি তারাপীঠের মন্দিরে নিয়মিত যেতেন। এই সময় তাঁর মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়। আমি সুভাষ বলছি গ্রন্থের লেখক শৈলেশ দে ছিলেন নজরুলের তৎকালীন কাছের মানুষ। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তখন মনোবিদ নজরুলের চিকিৎসা করছেন, শৈলেশ দের উপর দায়িত্ব পড়ল, রাতে তিনি কি করেন, তার বিবরণ চিকিৎসক কে জানাতে হবে।
ফলে, ফলে শৈলেশ দে নজরুলের দরোজার কাছে শুয়ে পড়লেন। রাত বারোটার সময় নজরুল খাট থেকে নেমে, শ্যামা সংগীত গাইতে লাগলেন। তারপর শৈলেশকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, শৈলেশ,
     আমাকে দেখতে পাচ্ছ,
     শৈলেশ দে বললেন, হ্যাঁ কাজীদা, আমি আপনাকে দেখতে পাচ্ছি।
নজরুল মনে হয় খুশি হলেন না। সারারাত গান চালিয়ে গেলেন।
পরদিন মানোবিদকে এই কথা জানানো হলে, তিনি বললেন, আজ এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে, শৈলেশদা যেন বলেন, তিনি নজরুলকে দেখতে পাচ্ছেন না।
     পরদিন রাতে নজরুল জিজ্ঞাসা করলেন, শৈলেশ,
     আমাকে দেখতে পাচ্ছ,
     না কাজীদা, আমি আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না।
উনি খুশি হলেন। বিছানায় গিয়ে শান্তভাবে শুয়ে পড়লেন।

শৈলেশ দে আমাকে বলেছিলেন, এই সময় নজরুলের ধারণা হয়েছিল, সাধনার স্তরে এত উঁচুতে তিনি আছেন যে, তিনি সবাইকে দেখতে পারছেন, কিন্তু কেউ তাঁকে দেখতে পাচ্ছে না।
ক্রিস্টোফার রোডের বাড়িতে তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গান গাইতেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
     ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি।

এরপর তিনি বাংলাদেশের চলে যান। সেখানেই ঢাকা শহরের একটি নার্সিংহোমে কবির জীবনাবসান ঘটে। দুই বাংলা সেদিন শোকে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
এপার বাংলার কবি অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন,
     সব ভাগ হয়ে গেছে বিলকুল,
     ভাগ হয়নিকো শুধু নজরুল।

দুই বাংলায় বিদ্রোহী কবি হিসেবে তাঁর পরিচিতি, অথচ তিনি শান্ত জীবনের রূপকার, কৃষ্ণের মতো আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রেমের বাঁশি বাজাতে চান। যেখানে অন্যায় অবিচার, সেখানে তিনি প্রতিবাদী। তাঁর ধর্ম হল, মানবতার লোকায়ত বাণী।

সুনির্মল বসু । পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
লেখক পরিচিতি, সুনির্মল বসুর জন্ম ১৯৫০ সালের ৩রা নভেম্বর কলকাতায়। পিতা সুবোধ কুমার বসু ও মাতা গীতা রানী বসু। শিক্ষাগত যোগ্যতা, এম এ, বিএড। অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক।
প্রকাশিত গ্রন্থাবলী, ভালোবাসার কবিতা মালা ও শিকড়ে বৃষ্টির শব্দ।
যৌথ গ্রন্থ, পাঁচে পঞ্চবান, পানকৌড়ি চেতক।
লেখক ভারত বর্ষ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকার নিয়মিত লেখক। প্রকৃতি ও মানব সম্পর্ক তাঁর রচনার প্রধান উপজীব্য বিষয়।