অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক নজরুলের নিষিদ্ধ সাহিত্যকর্ম - আবু আফজাল সালেহ
নজরুল তাঁর চারটি সন্তানের নাম রেখেছিলেন হিন্দু মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য ও পুরাণের আলোকে। তাঁর সন্তানদের নাম যথাক্রমে কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। অসাম্প্রদায়িক নিদর্শন আর কী হতে পারে! মসজিদে গজল আর ইসলামী সঙ্গীত আর মন্দিরে শ্যামাগীতি; সমানভাবে জনপ্রিয়। বিশ্বের শীর্ষ দু’ধর্মেও অনুসারীদের কাছে ধর্মগ্রন্থের পরেই প্রিয় সঙ্গীত! ভাবা যায়! বিশ্বের আর কোন সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে বা আইডলের কাছে এমন হয়নি।
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাভাষার অন্যতম সাহিত্যিক বাংলাদেশের জাতীয় কবি কবিতা ও গান পশ্চিমবঙ্গসহ দুই বাংলাতেই সমানভাবে সমাদৃত। শিশু তরুণ বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষের কাছে কবির লেখা সমান জনপ্রিয়। কবিতা ও গানে বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়। তার কবিতার বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে, মানুষের প্রতি মানুষের অত্যাচার ও দাসত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
নজরুল বাংলা কাব্যের জগতে স্বকীয়তাসহ পা রাখেন ২০ শতকের দ্বিতীয় দশকে অগ্নি-বীণা (১৯২২) কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে। তাঁর আগে উনিশ শতকের শেষভাগ আর বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত যাঁরা বাংলা সাহিত্যের জগতে দাপটের সঙ্গে দাপিয়ে বেরিয়েছেন, তাঁদের বড় অংশই ছিল হয় ব্রিটিশ সরকারের সুবিধাভোগী, নতুবা সুবিধাপ্রত্যাশী। তাঁদের শিক্ষাদীক্ষা অথবা চিন্তাচেতনার সঙ্গে কোন না কোনভাবে রাষ্ট্রক্ষমতার সম্পর্ক ছিল। নজরুলের কাব্য-কবিতা আর চেতনা প্রবলভাবে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তসুলভ চাতুরি ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত। যেখানে আঘাত করার, সেখানেই তাঁর আঘাত। বাজেয়াপ্ত করা হয় তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতা ও প্রবন্ধের বই। শুধু তা-ই নয়, তাঁর সংবাদ সংগ্রহের জন্য পেছনে লাগিয়ে দেয়া হয় গোয়েন্দা। ১৯২২ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলামের পাঁচটি বই বাজেয়াপ্ত করা হয়। বাজেয়াপ্ত না হলেও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় তাঁর আরও কিছু বই। নজরুলের প্রথম যে বইটি নিষিদ্ধ হয় তার নাম ‘যুগবাণী’। ১৯২২ সালে ফৌজদারি বিধির ৯৯এ ধারানুসারে বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তৎকালীন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ‘যুগবাণী’কে একটি ভয়ঙ্কর বই হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়, লেখক বইটির মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রচার করছেন। ‘ক্রীতদাস মানসিকতার’ ভারতীয় জনগণকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে শাসনভার দখলের মন্ত্রণা জোগাচ্ছেন। ‘নবযুগ’ পত্রিকায় লেখা কাজী নজরুল ইসলামের কয়েকটি নিবন্ধনের সংকলন ‘যুগবাণী।
১৯২৪ সালে নজরুলের দুটি কবিতার বই পরপর নিষিদ্ধ হয়। প্রথমে ‘বিষের বাঁশি’; তৎকালীন বেঙ্গল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত পাবলিক ইন্সট্রাকশন বিভাগকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেন, ‘লেখক বিষের বাঁশির মাধ্যমে তার বিপ্লবী অনুভূতির প্রকাশ করেছেন এবং তরুণদের বিদ্রোহ করতে এবং আইন অমান্য করতে প্ররোচনা দিচ্ছেন’। ১৯২৪ সালের ২২ অক্টোবরের গেজেট ঘোষণায় ‘বিষের বাঁশি’ নিষিদ্ধ হয়।
‘বিষের বাঁশি’র প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদটি ছিল অপূর্ব। একটি কিশোর হাঁটু মুড়ে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। তাকে জড়িয়ে আছে বিশাল এক বিষধর সাপ। কিন্তু কিশোরের চোখেমুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। আর তার বাঁশির সুরে জেগে উঠছে নতুন দিনের সূর্য। এরপর ‘ভাঙার গান’ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয় ১৯২৪ সালের ১১ নবেম্বর। নিষিদ্ধ ঘোষণা করেও বই দুটির প্রচার বন্ধ করা যায়নি। এরপর সরকারী রোষের কোপে পড়ে কাব্যগ্রন্থ ‘প্রলয় শিখা’। কবির মনোজগতে তখন তোলপাড় চলছে। প্রিয় পুত্র বুলবুল মারা গেছে। চোখে জল কিন্তু বুকে আগুন। সেই আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ল ‘প্রলয় শিখা’র প্রতিটি শব্দে। বিদ্যুত গতিতে ‘প্রলয় শিখা’ ছুটল পুরো বাংলায়। তৎকালীন পাবলিক প্রসিকিউটর রায়বাহাদুর তারকনাথ সাধু ‘প্রলয় শিখা’ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে তৎকালীন কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনারকে জানান বইটি ভারতীয় পেনাল কোডের ১৫৩ এ ও ১২৪ এ ধারা ভঙ্গ করেছে। তাই বইটিকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণার পরামর্শ দেন তিনি। ‘প্রলয় শিখা’ আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেয়াপ্ত হয় ১৯৩১ সালে।
‘প্রলয় শিখা’র রেশ কাটতে না কাটতে বাজেয়াপ্তের খক্ষ নেমে আসে ‘চন্দ্রবিন্দু’র ওপর। এটি মূলত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের কবিতার বই। তৎকালীন সময়ের সমাজ ও রাজনীতির প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, শ্লেষপূর্ণ হাস্যরস ফুটে উঠেছে এর প্রতি ছত্রে। এর দুটি কবিতা- ‘মসজিদ পানে ছুটিলেন মিঞা মন্দির পানে হিন্দু,/আকাশে উঠিল চির জিজ্ঞাসা করুণ চন্দ্রবিন্দু।’ ‘কাফ্রি চেহারা ইংরেজী দাঁত,/টাই বাঁধে পিছে কাছাতে/ভীষণ বম্বু চাষ করে ওরা অস্ত্র আইন বাঁচাতে।’
চন্দ্রবিন্দু নিষিদ্ধ হয় প্রলয় শিখা নিষিদ্ধ হওয়ার এক মাস পর ১৪ অক্টোবর ১৯৩১ সালে। নজরুলের অন্যান্য নিষিদ্ধ বইয়ের মতো এটিও ভারতীয় দন্ডবিধির ৯৯(এ) ধারা অনুসারে বাজেয়াপ্ত করা হয়। উল্লিখিত পাঁচটি গ্রন্থ ছাড়াও অগ্নিবীণা, ফণিমনসা, সঞ্চিতা, সর্বহারা, রুদ্রমঙ্গল প্রভৃতি বই ব্রিটিশ সরকারের কোপানলে পড়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এগুলো বাজেয়াপ্ত হয়নি।
নজরুল তো বলেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’। হিন্দু-মুসলিম নিয়ে তাঁর উচ্চারণ ছিল পরিষ্কার, বলতে কুণ্ঠিত হননি। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধরা দেয় এভাবে। মানবতাই আসল। এছাড়া তিনি কিছুই বুঝতেন না। কবিতা-গান বা লেখায় ফুটে উঠেছে দৃপ্ত উচ্চারণ। কয়েকটি কবিতাংশ তুলে ধরছি। তাহলেই কবির অসাম্প্রদায়িক বা সাম্যবাদী চেতনতার সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যাবে। ‘হিন্দু-মুসলিম দুটি ভাই/ভারতের দুই আঁখি তারা/এক বাগানে দুটি তরু দেবদারু আর কদম চারা।’-(হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক)
‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াৎ করছে জুয়া/ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া/...জানিস নাকি ধর্ম সে যে বর্মসম সহনশীল/তাই কি ভাই ভাঙতে পারে ছোঁওয়া ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল?/যে জাত-ধর্ম ঠুনকো এত/আজ না হয় কাল ভাঙবে সে তো। যাক না সে জাত জাহান্নামে রইবে মানুষ নাই পরোয়া।’- (জাতের বজ্জাতি) সত্যের পক্ষে কবি নির্ভার। কোন কুণ্ঠা বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। তাই তো সহজেই কবিতার ভাষায় বলতে পারেন এভাবে- ‘মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্যম/মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল,/মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়/মোরা প্রকৃতির মতো সচ্ছল।/মোরা আকাশের মতো বাঁধাহীন/মোরা মরু সঞ্চার বেদুঈন,/বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন/চিত্তমুক্ত শতদল।’ -(মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্যম)
অত্যাচারের বিরুদ্ধে, অশুভের বিরুদ্ধে কলম চালাতে ভয় করতেন না। জেল-জুলুম পরোয়া করতেন না। মজলুমদের পক্ষে সবসময় দাঁড়াতেন। অত্যাচারীদের বিপক্ষে সুস্পষ্ট অবস্থান ছিল তাঁর। কয়েকটি কবিতাংশ তুলে ধরতেই হচ্ছে। ‘...আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।/ দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি, /ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?...’ -(আনন্দময়ীর আগমনে)
‘কারার ঐ লৌহকপাট,/ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,/ রক্ত-জমাট/শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।/ওরে ও তরুণ ঈশান!/বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!/ধ্বংস নিশান/উড়–ক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।’-(কারার ঐ লৌহ-কপাট,ভাঙ্গার গান) ১৯৭২ সালের ২৪ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি. লিট উপাধিতে ভূষিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে তাকে এই উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট সকাল ১০টা ১০ মিনিটে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আবু আফজাল সালেহ
লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
চুয়াডাঙ্গা।
-
নিবন্ধ // মতামত
-
25-05-2020
-
-