এ টেল অফ এ সিটি স্টেট – চিরঞ্জীব সরকার
সিঙ্গাপুরের সম্বন্ধে আমার আগ্রহ জন্মে একটি বিশেষ কারনে। আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন ‘লাভ ইন সিঙ্গাপুর’ নামে একটি মুভি মুক্তি পায়। তখন খুব রেডিও শুনতাম। রেডিওতে নতুন ছবিগুলির বিজ্ঞাপন খুব প্রচার হত। মহা আগ্রহ নিয়ে সে বিজ্ঞাপনগুলি শুধু শুনতাম বললে ভুল হবে গিলতামও বটে। উদাহরন দিলে ব্যাপারটার খোলাসা হবে। যশোরের মনিহার সিনেমা হলের বিজ্ঞাপন তখন রেডিওতে প্রচার হত। এটা নাকি তখনকার সময় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রেক্ষাগৃহ ছিল, বিজ্ঞাপনে অন্তত তাই প্রচার করে যাচ্ছিল। এমন একটা অবস্থায় মনে হচ্ছিল মনিহারে সিনেমা দেখতে না পারলে তো জীবন ব্যর্থ। তাই অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে গ্রামের বাড়ী থেকে যশোর গিয়ে সিনেমা হলের টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে সরাসরি মনিহারে ঢুকলাম। ঢোকার সময় মনে হচ্ছিল যেন বিশ্ব জয় করে ফেলেছি। সেদিন ওখানে কি ছবি দেখেছিলাম সেটা আজ আর মনে নেই। তবে সে ছবিটার একটি গানের কথা এখনও মনে আছে। গানটি হল ‘তোমার গরুর গাড়িতে বৌ সাজিয়ে’। তখন গ্রামে গঞ্জে রেডিওর যুগ। শহরে ছিল সাদা কালো টেলিভিশন। এমনকি রেডিও নামক এ যন্ত্রটি সব ঘরে ছিল না। বিয়েতে উপহার হিসেবে বরপক্ষকে রেডিও দিতেও ছোটকালে আমার গ্রামে দেখেছি। যা হোক ‘লাভ ইন সিঙ্গাপুর’ দেখার পর আমিও ভাবতে থাকি কবে ববিতার মত সানগ্লাস পড়ে প্লেনের সিড়িতে দাঁড়িয়ে সিঙ্গাপুরের নীল আকাশ দেখব। এরপর পদ্মা যমুনায় অনেক পানি বয়ে গেছে। আমারও সিঙ্গাপুরে যাওয়া হয়েছে বেশ কয়েকবার। একদিন যখন মেরিনা বে স্যান্ডস টাওয়ার হোটেলের ৫৬ তলার ছাদে স্কাই পার্কে দাঁড়িয়ে সিঙ্গাপুরকে পাখির চোখে দেখছিলাম তখন মনে মনে ভাবছিলাম আমিও কি তাহলে সিঙ্গাপুরের প্রেমে পড়ে গেছি ।
শহর রাষ্ট্র সিঙ্গাপুরঃ
৭১২.৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার একটি ছোট রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর যা একটি সিটি স্টেট। এ রাষ্ট্রটি একটি সমৃদ্ধশালী অর্থনৈতিক কেন্দ্রও বটে। এখানে বিজনেস বা ব্যবসার সুব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। সিঙ্গাপুর নামটি এসেছে সিংহা ও পুরা এ দুটি সংস্কৃত শব্দ থেকে যার অর্থ দাঁড়ায় Lion City যদিও একমাত্র চিড়িয়াখানা ছাড়া সিঙ্গাপুরের কোথাও সিংহের দেখা মিলবে না। দেশটিতে ছোট বড় ৬৪ দ্বীপ আছে যার ভিতর বৃহত্তম হল সেন্তোসা। পৃথিবীতে বর্তমানে টিকে থাকা যে তিনটি সিটি স্টেট এখনও আছে তার একটি হল সিঙ্গাপুর। বাকী দুটি হল ভ্যাটিকান সিটি ও মোনাকো। মূল দ্বীপ ছাড়া সিঙ্গাপুরের বেশীরভাগ দ্বীপগুলি জনমানবহীন। পৃথিবীর ২০তম ক্ষুদ্র রাষ্ট্র এটি। আয়তনে ছোট হবার কারনে দেশটিতে তেমন একটা কৃষিজমি নেই। পৃথিবীর অন্যতম ভাল ও দক্ষ এয়ারপোর্ট সিঙ্গাপুরের চাঙ্গী এয়ারপোর্ট। এদেশের সরকারী ভাষা হল ইংরেজী, মান্দারিন চাইনিজ, তামিল ও মালয়। তবে সিঙ্গাপুরের সংবিধানে মালয় ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। জাতিগত ভাবে চীনারা এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ, এরপর রয়েছ মালয় ও ভারতীয় তামিলরা।
কিভাবে দেশটি সৃষ্টি হলঃ
ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে বৃটিশদের ব্যাবসা বানিজ্যের ছোটখাট একটি কলোনী ছিল সিঙ্গাপুর। বৃটিশদের কাছ থেকে তারা স্বশাসনের অধিকার পায় ১৯৫৯ সালে। ১৯৬৩সালে এটি মালয়েশিয়ান ফেডারেশনের সাথে সংযুক্ত হয়। কিন্তু ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়ান ফেডারেশন থেকে তাঁদেরকে বের হয়ে আসতে হয়।
নেটওয়ার্ক-রেডি কান্ট্রিঃ
পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত কোম্পানী তাদের আঞ্চলিক সদর দপ্তর সিঙ্গাপুরে স্থাপন করেছে। ভাল এয়ার পোর্ট, সি পোর্ট, ব্যাবসা বান্ধব ব্যাংকিং ব্যাবস্থা ও অন্যান্য অবকাঠোমো সিঙ্গাপুরকে এ অঞ্চলে পুজি আকর্ষনের একটি শ্রেষ্ঠ গন্তব্যে পরিনত করেছে। তাইতো ব্যাবসা বানিজ্যের জন্য দেশটিকে একটি ‘নেটওয়ার্ক- রেডি কান্ট্রি’ বলা হয়ে থাকে।
লেগাসি অফ লি কুয়ানঃ
সিঙ্গাপুর রাষ্ট্রটির সাথে যার নামটি গভীরভাবে লেগে আছে সে হল প্রয়াত রাষ্ট্রনায়ক লি কুয়ান ইউ। লি কুয়ানের জন্ম ১৯২৩ সনে এবং তিনি মৃত্যু বরন করেন ২০১৫ সনে। তিনি সিঙ্গাপুরের পিপল অ্যাকশন পার্টির একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। তাঁকে সিঙ্গাপুরের ফাউন্ডিং ফাদারও বলা হয়ে থাকে। সিঙ্গাপুর রাট্রটির জন্ম থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় জেলেপল্লী থেকে সিঙ্গাপুর একটি আধুনিক ও সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিনত হয়। মালয়েশিয়ান ফেডারেশনের সাথে লি কুয়ান যখন সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন চাওয়া পাওয়া নিয়ে দরকষাকষি করতে ছিলেন এবং একি সময়ে সিঙ্গাপুরের কিছু ঘটনাপ্রবাহে অনেকটা বিরক্ত বা অতিষ্ঠ হয়েই মালয়েশিয়ান ফেডারেশনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টুংকু আব্দুল রহমান সিঙ্গাপুরকে সে সময় মালয়েশিয়া থেকে একরকম বের করে দেন। কৃষিজমি ও খনিজসম্পদহীন ছোট্ট সিঙ্গাপুর কিভাবে টিকে থাকবে এ ভাবানায় সেদিন লি কুয়ানকে খুব ভারক্রান্ত করেছিল। তিনি দুঃখ পেলেও দমে যাননি। পরিকল্পনা করতে থাকেন একটি আধুনিক সিঙ্গাপুর বিনির্মানের। দূ্র্নীতিকে তিনি শক্ত হাতে ঝেটিয়ে বিদায় করেন। সহজে ব্যাবসা বানিজ্য করার জন্য এমন একটা বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ সৃ্ষ্টি করেন যা বড় বড় কোম্পানিকে দেশটিতে আকর্ষিত করে। এখন এটি এশীয় অঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক কেন্দ্র। সিঙ্গাপুর সমূদ্র বন্দর আজ পৃথিবীর একটি দক্ষ ও ব্যস্ততম বন্দর।
মারমেইড টু মারলায়নঃ
মারমেইড বা মৎসকন্যা বলতে রূপকথায় এমন এক কন্যা বুঝায় যার মুখ মানুষের, দেহ মৎসের। সিঙ্গাপুরকে একসময় মৎস বেচাকেনা করেই মুখে আহারের জোগান দিতে হত। কিন্তু আজ সিঙ্গাপুরের প্রতীক মারলায়ন যার মুখ লায়ন বা সিংহের মত এবং দেহ মৎসের। ২৮ ফুট উচ্চতার জাতীয় প্রতীকের এ ভাস্কর্যটি রয়েছে সিঙ্গাপুরের মারলায়ন পার্কে। এটি সিংগাপুরের ইতিহাসের কথা বলে যার শুরুটা হয়েছিল জেলেপল্লীর মাছ থেকে যেটি কিনা এখন সিংহে পরিনত হয়ে গর্জন করতে সক্ষম।
এ কান্ট্রি অফ ফাইনঃ
আইনকে কঠোর ভাবে প্রয়োগ করে সিঙ্গাপুর। অমান্য করলে মাফ নেই। জরিমানার টাকা গুনতে হবেই। এখানে আইন প্রয়োগে কোমলতা প্রদর্শন করা হয় না বিধায় নাগরিকরা সদা সতর্ক থাকে। জনপরিবেশ যাতে সুন্দর থাকে সেজন্য নানা রকম বিধিনিষেধ রয়েছে এখানে। বিশেষ করে পাবলিক নুইসেন্স যাতে কোনভাবেই ক্রিয়েট না হয়। চুইংগাম, থুথু ফেলা, ময়লা নিক্ষেপ, ভ্যান্ডালিজম, শরীর প্রদর্শন, প্রকাশ্য অংগভঙ্গী ইত্যাদি অসংখ্য বিষয়ে সিংগাপুরে আইন রয়েছে এবং এগুলির লঙ্ঘনে জরিমানা সহ কখনো কখনো জেলেও যেত হয়। এ কারনে দেশটিকে কেউ কেউ “এ কান্ট্রি অফ ফাইন’ ও বলে।
দর্শনীয় স্থানঃ
সিঙ্গাপুর দেশটি ছোট হওয়াতে পুরো দেশটি ঘুরতে তেমন একটা বেগ পেতে হয় না। গার্ডেনস বাই দ্য বে, মেরিনা বে স্যান্ডস, বোটনিক্যাল গার্ডেন, চায়না টাউন, সিঙ্গাপুর জু, হিস্ট্রি মিউজিয়াম, সেন্তোসা দ্বীপ, মারলায়ন পার্ক, টুথ রেলিক টেম্লল এলাকাগুলি পর্যটকদের পদচারনায় সর্বদা মুখরিত থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে পানি থেকে শুরু করে খাদ্যশস্যসহ নানাবিধ পন্য আমদানী করতে হয় বিধায় সিঙ্গাপুর পৃথিবীর একটি অন্যতম ব্যয়বহুল দেশ।
সিঙ্গাপুরে এসে যদি আড্ডাপ্রিয় বাংগালী মোস্তফা সেন্টারে না আসে তবে তাঁকে ব্রাত্যের খাতায় নাম লিখাতে হবে। সিঙ্গাপুরে এটি আমাদের অঞ্চলের লোকদের মিলনমেলা। রসনা থেকে শুরু করে শপিং বাসনা সবি মিটানো যায় এখানে। এখনকার আড্ডা দেখলে সৈয়দ মুজতবা আলী বেশ খুশিই হতেন বলে আমার ধারনা।
চিরঞ্জীব সরকার। অটোয়া, কানাডা
-
গ্রন্থালোচনা // ভ্রমণ
-
27-05-2020
-
-