অটোয়া, রবিবার ৫ মে, ২০২৪
হাসির দেশে অর্কিডের মাধুরীতে – চিরঞ্জীব সরকার

থাইল্যান্ডের অবস্থান দক্ষিন পূ্র্ব এশিয়ায়। অসংখ্য সমূদ্র সৈকত, রাজকীয় প্রাসাদ, প্রাচীন স্তুপ, কারুকার্যময়ী বুদ্ধমন্দিরে ভরপুর দেশটি। থাইল্যান্ড শব্দটির অর্থ ‘Land of Free” অর্থাৎমুক্ত ভূমির দেশ কেননা দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার একমাত্র দেশ থাইল্যান্ড যেটি ইউরোপিয়ানদের কলোনী ছিল না। অর্কিডের দেশও থাইল্যান্ড। প্রায় পনের’শ ধরনের অর্কিডের দেখা মেলে থাইল্যান্ডে। দেশটিকে ল্যান্ড অফ স্মাইল বা হাসিমুখের দেশও বলে। হাসিমুখে সবাইকে বরন করা থাইবাসীদের ঐতিহ্য। পৃথিবীর অন্যতম চাল রপ্তানীকারক দেশ থাইল্যান্ড। এটি একটি বৌদ্ধপ্রধান দেশ। শতকরা ৯৫ ভাগ জনগোষ্ঠী তেরেভাদা বৌদ্ধ। সারা দেশে নানা আকৃতি ও ধরনের ৩৫০০০ এর অধিক বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে। দেশটিতে রয়েছে ১৪৩০টির মত দ্বীপ। এর ভিতর কিছু কিছু দ্বীপ খুবই নয়নাভিরাম। এ নয়নাভিরাম দ্বীপগুলির কারনে হলিউডের অনেক বিখ্যাত ছবির কিছু কিছু অংশের সুটিং হয়েছে থাইল্যান্ডের বিভিন্ন দ্বীপে। শ্বেত হস্তির দেশও বলা হয় থাইল্যান্ডকে। কিন্তু একসময়ে এ দেশটির জঙ্গলে লক্ষ হাতির বিচরন থাকলেও কালের বিবর্তনে তা আজ মাত্র কয়েক হাজারে এসে পৌঁচেছে। বিভিন্ন সময়ে জঙ্গল কেটে ফেলার ফলেই হাতিরা তাদের প্রাকৃতিক আবাস হারিয়ে নিজেরাই ক্রমে ক্রমে হারিয়ে যেতে থাকে। থাইল্যান্ডে বন উজাড় এত মাত্রায় ঘটতে থাকে যে থাই সরকার বানিজ্যিকভাবে জঙ্গল থেকে কাঠ কাটার ব্যাপারে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেয়।
ভৌগোলিকভাবে থাইল্যান্ডের চারপাশে রয়েছে মায়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওস ও মালয়েশিয়া। ৬ কোটি ৭০ লক্ষ জনসংখ্যার দেশটির আয়তন ৫১৪,০০০ বর্গকিলোমিটার। ১৯৩৯ এর আগ পর্যন্ত দেশটি স্যাম(Siam) নামে পরিচিত ছিল। এরপর থেকে দেশটি থাইল্যান্ড নামে পরিচিত যদিও ১৯৪৫ সালে তাঁরা আবার পূর্বের নাম স্যামদেশে ফিরে গিয়েও ১৯৪৯ সনে পুনরায় থাইল্যান্ড বা মুক্ত দেশের পরিচয়ে ফিরে আসে।
থাইরা এটিকেটের ব্যাপারে বেশ সংবেদনশীল। এদের কালচারে তর্জনী তুলে কাউকে দেখালে একে রূঢ় আচরন হিসাবে দেখা হয়। থাই মুদ্রায় যেহেতু তাঁদের রাজার ছবি আছে তাই তাঁরা মুদ্রা ব্যবহারের সময় বেশ সতর্ক থাকে যা কোনমতেই যেন পায়ে না লাগে। এছাড়া পা তুলে বসার সময়ও পায়ের পাতা যদি কারোর দিকে থাকে সেটাও থাই সমাজে ভালভাবে দেখা হয় না। কথা বলা সময় উচ্চস্বর অবশ্যই বর্জনীয়। এমনকি কেনাকাটার সময় দোকানীর সাথে দরকষাকিতে স্বরমাত্রা যথাসম্ভব নিম্নগামী রাখা বাঞ্ছনীয়। বয়স ও মর্যাদা অনুসারে  হাত জোড় করে মস্তক কিছুটা সন্মুখে নিম্নগামী করে ঐতিহ্যগত থাই অভিবাদনের ধরন ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী হয়। যেহেতু থাই সমাজে মাঙ্ক বা ভিক্ষুরা সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় তাই তাঁদেরকে শ্রদ্ধা ও সন্মান জানানোর সময় করজোড় হস্ত ঊর্ধ্বে রাখা হয়। 
লান্ড অফ স্মাইলঃ থাইল্যান্ডকে বলা হয় ‘এ ল্যান্ড অফ থাউজ্যান্ডস স্মাইল’ বা হাজারো হাসির দেশ। কে না হাসি পছন্দ করে। যে কোন কাজ হাসিমুখে করা থাইদের ঐতিহ্য। থাই এয়ারওয়েজে উঠলে অভিবাদনের সাথে জুটবে কিছু স্মাইল যেটা কিনা বুঝিয়ে দেয় গন্তব্যটা কিন্তু ‘লান্ড অফ স্মাইলে’। এছাড়া থাই অর্কিডের অপূর্ব  বিন্যাস ও সজ্জা যে কাউকে বিমোহিত করতে বাধ্য।
কসমোপলিটন ব্যাংককঃ পর্যটকদের জন্য আকর্ষনীয় জায়গা থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক। কত ভ্যারাইটির স্ট্রিট ফুড এখানে। রসনা বিলাসীদের জন্য থাইল্যান্ড একটি আদর্শ জায়গা। সারা রাত জেগে থাকে ব্যাংকক। ব্যাংককের নাইট মার্কেটের স্ট্রীট ফুড ব্যাকপ্যাকারদের হট ফেভারিট। থাইরা রান্নায় অনেক সুগন্ধী লতাপাতা ব্যবহার করে বিধায় এ খাবারগুলি খেতে বেশ উপাদেয়। এছাড়া থাই রান্নায় টক, মিষ্টি, ঝাল ও লবনাক্ততার একটা মিশেল থাকে। নানা রকম ফলে ভরপুর দেশটি। এত সুন্দর কেটেকুটে পরিবেশন করে যে এটা না খেয়ে যাবার উপায় থাকে না। এত সস্তার প্যাসন ফল আর ডুরিয়ান থাইল্যান্ড ছাড়া দুনিয়ার আর কোথাও মিলবে কিনা সন্দেহ আছে। ডুরিয়ান দেখতে অনেকটা কন্টকযুক্ত কাঠালের মত। এটার গন্ধ বেশ তীব্র। এ তীব্র গন্ধের কারনে ফাইভস্টার হোটেলে নাকি ডুরিয়ান পরিবেশন করা হয় না। ছোটকালে শুনেছি তীব্র গন্ধের কারনে হাস্নাহেনা ফুলগাছে নাকি সাপ আসে। আমাদের পাশের বাড়িতেই একটি হাস্নাহেনার গাছ ছিল। গাছটিতে যখন ফুল ফুটত তখন সুগন্ধে চারদিক মৌ মৌ করত। আমি বেশ সতর্কতার সাথে খেয়াল করতাম আদৌ কোন সাপ এসেছে কিনা গাছটিতে এ সৌরভে আকর্ষিত হয়ে। খোকার যেমন নাদের আলী কর্তৃক বিল দেখা হয়নি আমারও তেমনি হাস্নাহেনার গন্ধ কর্তৃক আকর্ষিত সর্প দর্শনের সৌভাগ্য হয়নি।
ব্যাংককের গ্র্র্যান্ড প্যালেস সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান। ওয়াট ফোতোর শায়িত বুদ্ধ, ওয়াট অরুন, কাওসান রোডও পর্যটকদের পদচারনায় মুখরিত থাকে। অনেকে চলে যান ফ্লোটিং মার্কেটে। স্কাই ট্রেনে চড়াও বেশ আকর্ষনীয়। শপিং এর জন্য পসরা সাজিয়ে রেখেছে চাটচুয়াক বাজার। চাও প্রায়া নদীতে নৌবিহারও ব্যাংককে খুব জনপ্রিয়। সিয়াম প্যারাগন এখানের আর একটা হাই এন্ডিং সপিং প্যারাডাইজ। এত কিছু করার পর লুম্পিনী পার্কে ঘুরতে গেলে নিশ্চয়ই ক্লান্তি মুছে যাবে অনায়াসে।
ব্যাংকক ছড়াও পাতায়া, ফুকেট, চিয়াং মাই, ক্রামি আয়ল্যন্ড, ফি ফি আয়ল্যান্ড, সিমিল্যান আয়ল্যান্ড, কাও সক ন্যাশনাল পার্ক, আইওথিয়া হিস্টোরিক্যাল পার্ক ইত্যাদি জায়গাগুলিও পর্যটকদের খুব পছন্দ।
আমার সর্বমোট তিনবার থাইল্যান্ড ভ্রমনে একটা জিনিস সবসময়ে মনে হয়েছে যে একটা কোমল শান্তির পরশ লেপ্টে আছে থাই জল বাতাসে। সর্বশেষ গিয়েছিলাম ২০১৬ এর অক্টোবরে। পাতায়াতেই জীবনের প্রথম প্যারাগ্লাইডিংয়ের স্বাদ নেই। প্রথমে ভয় পেলেও যখন সমূদ্রের উপরে বাতাসে ভাসতে থাকি তখন ভয়টা পুরোপুরি কেটে যায়। ব্যাস্ততার বাতায়নে থাইদের জীবন ঘিরে থাকলেও জীবনের প্রবাহমানতায় হাসিমুখের প্রাধান্য বেশী।

চিরঞ্জীব সরকার। অটোয়া, কানাডা