অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
সাহিত্যে নন্দনতত্ত্ব : বিচার ও প্রয়োগ - ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ

(প্রাসঙ্গিক আলোচনার সংক্ষিপ্ত রূপ)
ন্দনতত্ত্ব খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রিসে সক্রেটিস (খ্রি.পূ.৪৬৯-৩৯৯), প্লেটো (খ্রি.পূ.৪২৭-৩৪৭), আ্যারিস্টটল (খ্রি.পূ.৩৮৪-৩২২) প্রমুখের মাধ্যমে ব্যাপক প্রসার লাভ করে। তবে নন্দনতত্ত্বের সার্বিক বিকাশ ঘটে জার্মান দার্শনিক খ্রিস্টিয়ান উলফের শিষ্য বোমগার্টেনের (১৭৫০-?) হাতে; অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি তাঁর 'Aesthetica' গ্রন্থটি প্রকাশের পর। বোমগার্টেনকে নন্দনতত্ত্বের জনক বলা হয়।  

১) বিংশশতাব্দীর প্রথমার্ধে নন্দনতত্ত্ব নিয়ে যাঁর প্রাজ্ঞ পর্যবেক্ষণ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল তিনি হচ্ছেন ইতালির বেনদেত্তো ক্রোচে (১৮৮৬-১৯৫২)। তাঁর মেধাবী সম্পাদনায় 'La Critica' (১৯২০-১৯২১) নামে একটি পত্রিকা বের হতো যার  বিষয় ছিল সাহিত্য, দর্শন ও ইতিহাস। তাঁর মৌলিক প্রতিভার স্মারক যে গ্রন্থটি তার নাম হচ্ছে 'Aesthetic' (১৯০২); যা ক্রোচের  'Fundamental Theses of An Aesthetic as science of Expression and General Linguistic' প্রবন্ধের পরিবর্ধিত রূপ। বস্তুত নন্দনতত্ত্বের ইংরেজি রূপ 'Aesthetic' শব্দটি তিনিই প্রথম চালু করেন।

২) সাহিত্য নন্দনতত্ত্ব আলোচনায় ভাববাদ ও যুক্তিবাদের প্রবর্তক হিসেবে প্লেটো (৪২৮/৪২৭-৪২৪/৪২৩ ? - ৩৪৮/৩৪৭-? * ৮০ বছর) ও আ্যারিস্টটলের (খ্রি.পূ. ৩৮৪-৩২২) নাম বিশেষ উল্লেখযাগ্য।খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে আমরা এ ভাববাদ ও যুক্তিবাদের বিস্তৃতি ও প্রসার লক্ষ করে থাকি, যা সাহিত্যতত্ত্বে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে বলে মনে করা হয়। এক্ষেত্রে প্লেটো ও আ্যারিস্টটলের ভূমিকা অনস্বীকার্য  ২। প্লেটো ও আ্যারিস্টটলের মধ্যে নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক বিচার-বিশ্লেষণে তাঁদের বিশ্লেষিত মতবাদের চারটি বিশেষ প্রেক্ষিত বিষয়ানুগ মতপার্থক্যও লক্ষ করা যায়। এ মতপার্থক্য পর্যালোচনায় যে ভিন্নতা রয়েছে তা ছিল সাহিত্য রচনার উৎস হিসেবে 'দৈবীপ্রেরণা' বা উচ্চপরিকল্পনার স্থান বিষয়ে- সৌন্দর্যের ভাবগত-বস্তগত উপলব্ধিতে - অনুকরণে প্রকৃত তাৎপর্য বিশ্লেষণে এবং সাহিত্যে নন্দনতত্ত্বের যৌক্তিক আদর্শ প্রকাশের মাধ্যম সম্পর্কে।
বস্তুত পঞ্চম শতকে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে এথেন্সের বিশেষ পরিচিতি ছিল। সাহিত্যতত্ত্বের- বিশেষ করে সাহিত্যরচনার কৌশল,অধ্যয়ন ও প্রণয়ন প্রচেষ্টা, সাহিত্যরচনা, চর্চা ও শিল্পের উন্নতি সাধনের বিচার ও বিকাশের বিষয়টি আমরা পাই খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে পেরিক্লিন যুগের পরে! এক্ষেত্রে ৪০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আ্যারিস্ট্রোফিনিস এর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ 'ফ্রগস্ ' (খ্রি.পূ.৪০৫) এর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে ৩। যা সাহিত্যে শিল্প বিকাশের অব্যাহত ধারাবাহিক ক্রমোন্নতির বিষয়টিকে অর্থবহ করে তুলেছিলো। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে দার্শনিক প্লেটোর আবির্ভাবকাল। উল্লেখ্য সক্রেটিসের মৃত্যুর কয়েকবছর পর-ই প্লেটোর বিখ্যাতো গ্রন্থ 'আয়োন' প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থের পুরো বিষয়টিই ছিল দার্শনিক তত্ত্বে সমৃদ্ধ। তাঁর অপর বিখ্যাত গ্রন্থ 'রিপাবলিক' (খ্রি.পূ.৩৮০)। প্লেটোর সামগ্রিক দার্শনিক চিন্তা-চেতনা এবং সাহিত্য রচনার প্রেরণা, অনুকরণ ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর বিশ্লেষিত যৌক্তিক মতবাদের অনেকাংশই পাওয়া যায়  'রিপাবলিক' গ্রন্থেরর দ্বিতীয়, তৃতীয় ও দশম পরিচ্ছেদে। প্লেটোর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে  'ফিড্রাস' (খ্রি.পূ.৩৭০ ? ) (Phaedrus) এবং 'মেনো' (খ্র.পূ. ৩৮০?)  ( Meno) ৪।

৩) প্লেটোর অন্যতম শিষ্য আ্যারিস্টটল (খ্রি.পূ.৩৮৪-৩২২) যাঁকে তিনি 'Nous'(নউস) অর্থাৎ 'মূর্তিমান প্রজ্ঞা' বলে মনে করতেন।৫  একজন সার্বভৌম পণ্ডিত হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল প্রচুর। পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র, ন্যায়শাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে অবাধ সহজ বিচরণ-ই তাঁর অসাধাররণ পাণ্ডিত্য ও প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে। প্লেটো তাঁর জীবনের শেষ আঠারো বছর (খ্র.পূ.৩৬৭-৩৪৯) আ্যারিস্টটলকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রাজ্ঞ দার্শনিক আ্যারিস্টটল রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ছিল প্রায় চারশো। সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ লিখেছেন মাত্র দু'টি। তার একটি হচ্ছে 'রেটরিকস' (Rhetorics) বা 'অলঙ্কারতত্ত্ব' এবং 'পোয়েটিকস' (Poetics) বা 'কাব্যতত্ত্ব'।  উল্লেখ্য যে, কেবলমাত্র তাঁর 'এথিকস', 'পলিটিক্স', এবং 'মেটাফিজিকস' গ্রন্থে সাহিত্যের নন্দনতত্ত্ব ও সাহিত্যের তাত্ত্বিক মন্তব্যের বিষয়টি স্বচ্ছতার সাথে ওঠে এসেছে।৬

৪) সাহিত্যে নন্দনতত্ত্বকে অধিবিদ্যার বলয় থেকে মুক্ত করে যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে যাঁরা অসামান্য অবদান রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে হেগেল (১৭৭০-১৮৩১) ও মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) অন্যতম। তাঁরা সাহিত্যের শৈল্পিক সৌন্দর্য বিশ্লেষণে দ্বান্দ্বিন পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন। পূর্বের দ্বান্দ্বিক চেতনার খণ্ডিত অবয়ব হেগেলের হাতে সুসামঞ্জস্য ও সুসংবদ্ধ রূপ লাভ করলেও পূর্ণতা পায় মার্কস এর হাতে।
বস্তুত হেগেলের দ্বান্দ্বিক মতবাদের দুর্বলতা সম্পর্কে মার্কস ও এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫) বিশেষ অবহিত ছিলেন বলেই তাঁদের রচনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সঠিক প্রয়োগরীতির বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

৫) সাহিত্যে নন্দনতত্ত্বের বিচার ও প্রয়োগের প্রেক্ষিত আলোচনায় হেগেল তাঁর মতবাদকে তিনটি মৌলিক স্তরে বিভক্ত করেছেন, যা হেগেলের 'নন্দনতত্ত্ব-চারুকলা দর্শন' রূপে প্রতিষ্ঠিত সত্য। একথা স্বীকার করতেই হয় সাহিত্যে নন্দনতত্ত্বের বিশ্লেষণ ও মতবাদ প্রদানে হেগেল ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। শিল্পের লক্ষ্য ও স্বরূপ সম্পর্কে হেগেলের বক্তব্য সুস্পষ্ট ও অর্থবহ।  চলবে...
দ্র. তথ্যসূত্র পরে দেয়া হবে।

ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ। বাংলাদেশ