অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
নেপাল ঘুরে এসে - অমৃতাভ দে

পুজো মানেই বেরিয়ে পড়া
পাহাড়, সমুদ্দুর
লেকের জলে নৌকো ভাসে
রূপকথা ভরপুর।
বনের পথে পদ্য লেখে
নানান রঙের পাখি
ইতিহাসের পাতায় পাতায়
হাঁটতে শুধু থাকি।

সেই ছোটবেলা থেকেই ভূগোল বইয়ে ভারতের সীমানা পড়তে গিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর নাম মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। নেপাল ভুটান বাংলাদেশ ব্রহ্মদেশ-এর কথা পড়ে ভাবতাম কবে সেই দেশগুলি ঘুরে দেখব। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ থেকে ঘুরে এসেই প্ল্যান করে ফেলেছিলাম এবার পুজোয় নেপাল। আমাদের 'উঠল বাই টিম' তো প্রস্তুত। ৯ দিনের প্রোগ্রাম ঠিক হয়ে গেল। বিশুদা আর ভাস্করদা যেখানে আছে সেখানে টিকিট কাটা হোটেল বুকিং এসব নিয়ে কোন চিন্তা করতে হয় না। 

২০১৫ তে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল নেপালের বিভিন্ন জায়গা। অনেকের মুখেই শুনেছিলাম নেপালের আগের সেই রূপ আর নেই। ধ্বংসপ্রাপ্ত নেপালের কথা বলতে গিয়ে সমীরদা কেঁদে ফেলেছিল। ট্রেক করতে যাঁরা ভালবাসেন, তাঁদের কাছে নেপাল পর্বতারোহণের প্রবেশদ্বার। ছোট্ট একটি দেশ অথচ ছবির মতো সাজানো। ধ্বংসপ্রাপ্ত চেহারাটা একটু একটু করে পাল্টাচ্ছে। রওনা হলাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা নেপালের উদ্দেশ্যে। ব্যান্ডেল থেকে বিকেলবেলা ট্রেন ধরে পরদিন সকালে পৌঁছালাম রক্সৌল। স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলেন কমলেশ দা। নেপালের ট্যুর অর্গানাইজার। টাঙ্গা গাড়িও রেডি ছিল। নেপালের প্রবেশদ্বার অতিক্রম করতেই অন্যরকম অনুভূতি। প্রবেশদ্বারটির ভাস্কর্যও মন ছুঁয়ে যায়। বীরগঞ্জ থেকেই গাড়ি করে রওনা দিলাম সবুজ অরণ্যের দেশে পাহাড় ঘেরা উপত্যকা চিতওয়ানে। হোটেলে পৌঁছে গরম কফিতে চুমুক দিয়ে রাপ্তী নদীর তীরে সূর্যাস্ত দেখতে ছুটলাম। রাপ্তী নদীর তীরে তখন বিদেশি পর্যটকদের ভীড়। এমনিতেই নেপাল বিদেশি পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়। নদীর ওপারে গভীর জঙ্গল। ডিঙি নৌকো করে ওপারে যাওয়া যায়। সন্ধ্যা নেমে এলো। সুন্দর পরিচ্ছন্ন একটি শহর পথের দু'ধারে হস্তশিল্পের কত না দোকান। বিশেষত কাঠের কাজ। কাবাব, মোমো, মদের দোকান চোখে পড়বে খুব বেশি। বিদেশি পর্যটকেরা খুব বেশি আসেন এখানে। অসাধারণ সব কর্টেজ আছে। 

পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম জঙ্গল-সাফারিতে। গভীর অরণ্য। গাইড নিতে হবে। জঙ্গলে হরিণের দল চোখে পড়ল। কুমীর,ঈগল দেখতে পেয়ে খুশি ছোটরা। সন্ধেটা বড় মায়াময়। হঠাৎ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল গন্ডার। সকলেই অবাক। জঙ্গলে গন্ডার দেখতে না পেয়ে যে দুঃখ পেয়েছিল সবার সে দুঃখ সরে গেল।   

চিতওয়ানের পরে পোখরা। পুরো পথটার ছবির মতো দৃশ্য আপনার সমস্ত ক্লান্তিকে নিমেষেই দূরে সরিয়ে দেবে। পোখরাকে বলা হয় 'নেপালের রাণী'। পাহাড়ি এই উপত্যকার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে ফেওয়া লেক। স্বচ্ছ নির্মল জল। ছোট বড় প্রচুর নৌকা রয়েছে। প্যাডেল বোট আছে। ফেওয়া লেকে অবশ্যই বোটিং করবেন। বৈকালিক এই ভ্রমণ মন ছুঁয়ে যায়। লেকের ভিতর রয়েছে একটি মন্দির। 'বাহারি হিন্দু মন্দির'। কমপক্ষে এক ঘন্টা লেকে ভ্রমণ করে নেওয়া যায়। নৌকো করে মন্দিরে গিয়ে আবার ফিরে আসতে পারেন অথবা লেকের অনেকটা অংশে ঘুরতে পারেন। আয়তনে খুবই বড়। নেপালি দ্বিতীয় বৃহত্তম লেক এটি। প্রবেশের জন্য অনেকগুলি গেট আছে। পাহাড় ছুঁয়েছে লেকের জল। লেকের জলে অন্নপূর্ণার শিখরদেশ প্রতিবিম্বিত হয়। তুষারাবৃত শৃঙ্গ উঁকি দিচ্ছে। সন্ধের ছবিটা একেবারেই অন্যরকম। লেকের ধারের দোকানগুলোতে জ্বলে উঠেছে মৃদু আলো। পৃথিবীর নানা দেশের পর্যটকেরা তখন মেতে উঠেছে উল্লাসে। পরের দিন ভোরবেলাটা আমাদের কাছে ছিল স্বপ্নের মতো। আলো না ফুটতেই আমরা বেরিয়ে পরলাম পোখারার সবচেয়ে উঁচু স্থান সারাংকোটে। সারাংকোট থেকে অন্নপূর্ণা যেন ছুঁয়ে ফেলা যায়। সূর্যোদয় দেখার আদর্শ স্থান এটি। সূর্যের আলো ক্রমশ রাঙিয়ে দিল অন্নপূর্ণার শিখরদেশকে। বদলাতে থাকলো রং। আমাদের চোখ সাক্ষী থাকল এক মোহনীয় দৃশ্যের। আজিজুল কাদিরের লেখা থেকে উল্লেখ করছি- "নেপাল পর্যটন বিভাগের একটি শ্লোগান আছে, ‘তোমার নেপাল দেখা পূর্ণ হবে না, যদি না তুমি পোখরা দেখো।’ বিশ্বের দীর্ঘতম অর্থাৎ ১৪০ কিলোমিটার সারিবদ্ধ হিমালয়ের পাহাড়ের সারি দেখা যায় এই পোখরা থেকে। পোখরাকে, ‘মাউন্টেন ভিউ’ এর শহরও বলা হয়। এখান থেকে ‘অন্নপূর্ণা’ ও মাছের লেজের মতো দেখতে মচ্ছপুছরে (৬,৯৭৭ মিটার) পর্বতশৃঙ্গ দেখা যায়। যা বিশ্বখ্যাত চারটি পর্বতশৃঙ্গের একটি।" দুর্লভ দৃশ্য মিস করতে চাইবেন না কেউ। সারাংকোটে প্রচুর পর্যটক ভোররাতেই হাজির হন। এখানে একটি জায়গার কথা না বললে নয়, ১০০ টাকায় যতবার খুশি চা খেতে পারেন, তার সাথে চেয়ারে বসে প্রত্যক্ষ করতে পারেন সূর্যোদয় এবং অন্নপূর্ণার অপরূপ দৃশ্যাবলী। আসলে এটি একটি ভিউ পয়েন্ট। ভোরবেলায় যেহেতু প্রচুর পর্যটক এর আগমন ঘটে এখানে, তাই বাড়ির মালিক এরকম একটি ব্যবস্থা করে রেখেছেন। একদিকে পর্বতশ্রেণি এবং উপত্যকা অন্যদিকে ফেওয়া লেকের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘ, যেন মেঘসমুদ্র। সারাংকোট থেকে ফিরে আমরা চললাম অন্যান্য স্থান ঘুরে দেখবার জন্য। পোখরাতে আছে মহেন্দ্র কেভ, ব্যাট কেভ, ডেভিস ফলস, গুপ্তেশ্বর কেভ, উঁচু পাহাড়ের উপর শান্তি স্তুপ, আছে গুরখা মেমোরিয়াল মিউজিয়াম। মহেন্দ্র কেভের ভিতরে শিবের মূর্তি আছে। চুনাপাথরের গুহাটি  বেশ সুন্দর। ব্যাট কেভে ঢুকতে বেশ ভয় ভয় করবে। খুব পিছল সিঁড়ি। অন্ধকারও বটে। বেরোনোর মুখটা খুবই ছোট। কষ্ট হবে কিন্তু রোমাঞ্চ আছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি পোখরাকে বেস করে পর্বতারোহীরা পৌঁছান অন্নপূর্ণা শৃঙ্গ জয় করতে। তাছাড়া যাঁরা ট্রেক করতে ভালোবাসেন, তাঁরা পোখরা থেকেই যান মুক্তিনাথ। যদিও গাড়িতেও যেতে পারেন। পোখরাতে এসে অবশ্যই দর্শন করবেন বিন্ধ্যবাসিনী মন্দির। অসাধারণ দেবী মূর্তি এবং অপূর্ব পরিবেশ। দূরের পর্বতশ্রেণি আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে। 

পোখরা থেকে আমাদের গন্তব্য নগরকোট। মাঝপথে অবশ্য দেখে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল মনোকামনা মন্দির। রোপওয়ে করে নদী ও তিনটে পাহাড় পেরিয়ে পৌঁছতে হয় মন্দিরে। ইচ্ছে থাকলেও পূর্ণ হল না আমাদের মনস্কামনা। দশেরা চলছিল বলে বিরাট ভিড়। তাছাড়া আমাদের অনেকটা পথ যেতে হবে, টা টা বাই বাই করে চললাম নগরকোটের পথে। আপনারা কিন্তু মিস করবেন না। কাঠমান্ডু শহর পেরিয়ে পাহাড়ের উপরে নগরকোট। নির্জন শান্ত প্রকৃতির মাঝে একটা দিন অবশ্যই কাটিয়ে আসবেন। বেশিরভাগ পর্যটকই কাঠমান্ডু থেকে নগরকোটে সূর্যাস্ত দেখতে চান কিন্তু আমার মনে হয় নগরকোট একটা দিন কাটানোর আনন্দটাই আলাদা। জানালার পর্দা সরাতেই সবুজ উপত্যকা। দূরে পর্বতমালা। ছোট্ট একটি পাহাড়ি গ্রাম নগরকোট। সকালে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে পারেন পাহাড়ি গ্রামে। পাইনের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যেতে পারেন ভিউ পয়েন্টে। উঁচু টাওয়ার করা আছে। টাওয়ারের উপর থেকে ৩৬০ ডিগ্রী উন্মুক্ত উপত্যকা ও বরফাবৃত তুষারশৃঙ্গ দেখে নিজেকে রাজা বলে মনে হবে।

নগরকোট থেকে কাঠমান্ডু ফেরার পথে দেখে নিলাম ভক্তপুর দরবার স্কোয়ার। ভক্তপুর সম্পর্কে বলা হয়, The cultural capital of Nepal, Bhaktapur's history goes back to the early 8th century and it used to be the capital city of whole Nepal till 12th to the 15th century. অসাধারণ একটি জায়গা ভক্তপুর। স্থাপত্য ভাস্কর্য মুগ্ধ করে। প্রাচীন নেপালকে চিনতে জানতে, নেপালের সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করতে ভক্তপুর আসতেই হবে। E.A.Powell লিখেছেন- 'were there nothing else in Nepal, save the Durbar Square of Bhaktagaun, it would still be amply worth making a journey half way round the globe to see.' ভক্তপুর থেকে চললাম কাঠমান্ডু, নেপালের রাজধানী। প্রচুর দর্শনীয় স্থান রয়েছে কাঠমান্ডুতে। আছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কাঠমান্ডু দরবার স্কোয়ার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। এখানে রয়েছে সাদা ভৈরব বা সেতো ভৈরব মন্দির, জগন্নাথ মন্দির, তেলেজু মন্দির, ইন্দ্রপুর মন্দির, মহেন্দ্রশ্বর মন্দির। কাঠমান্ডুকে এমনিতেই বলা হয় 'মন্দিরের শহর', স্বাভাবিকভাবেই মন্দিরগুলি ঘুরে দেখতেই হবে। উল্লেখ্য কাঠমান্ডুতে রয়েছে বিখ্যাত হিন্দু মন্দির পশুপতিনাথ মন্দির। অসংখ্য দর্শনার্থী পশুপতিনাথকে দর্শন করতে আসেন। পঞ্চ কেদার যাঁরা তীর্থ করেন, তাঁরা ষষ্ঠ কেদার হিসেবে পশুপতিনাথ দর্শন করতে আসেন অবশ্যই। পশুপতিনাথ দর্শন খুবই সৌভাগ্যের। বাগমতি নদীর তীরে রয়েছে শ্মশান। প্রচুর সাধুর ভীড়। কাঠমান্ডুতেই রয়েছে স্বয়ম্ভুনাথ মন্দির। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত একটি বৌদ্ধ মন্দির এটি। মন্দির চত্বর থেকে কাঠমান্ডু শহরকে ছবির মতো মনে হবে। কাঠমান্ডুতে অবস্থিত বৌদ্ধ শান্তিস্তূপটিও মন তৃপ্ত করবে। কাঠমান্ডুতে পাটন দরবার স্কোয়ার দেখতেই হবে। এখানকার স্থাপত্যকলাও মুগ্ধ করে। পাটনের সংস্কৃত নাম ললিতপুর বা নাওয়ারি। এই দরবার স্কয়ারে প্রচুর মন্দির আছে। 'বুধনীলকন্ঠ স্ট্যাচু' কাঠমান্ডু শহরের বিশেষ আকর্ষণ। 'স্লিপিং বিষ্ণু'দেখতে পাবেন। জলের মধ্যে শায়িত রয়েছে বিষ্ণুমূর্তি। এটি নেপালের সবথেকে সুন্দর, বড়ো এবং আকর্ষণীয় প্রস্তরখোদিত স্থাপত্য।    
নেপাল বেড়াতে যাবেন অথচ ক্যাসিনো দেখবেন না তা কখনো হয়? একটা সন্ধে অবশ্যই ঘুরে আসবেন নেপালের পর্যটন শিল্পের পাশাপাশি অন্যতম অর্থ উপার্জনের ঠিকানা ক্যাসিনো থেকে।

কিভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে হাওড়া-রক্সৌল মিথিলা এক্সপ্রেস অথবা হাওড়া-রক্সৌল এক্সপ্রেসে রকসল্ট স্টেশনে নামুন সেখান থেকে টাঙ্গা করে বীরগঞ্জ পৌঁছান। বীরগঞ্জ থেকে গাড়ি নিয়ে সোজা কাঠমান্ডু চলে যেতে পারেন অথবা চিতওয়ানে নাইট স্টে করে পোখরা হয়েও কাঠমান্ডুতে যেতে পারেন। বীরগঞ্জ থেকে একেবারে গাড়ি বুক করে নেওয়াই ভালো।

কোথায় থাকবেন: চিতওয়ান-পোখরা-কাঠমান্ডুতে প্রচুর হোটেল আছে। অনলাইন বুকিং করে যেতে পারেন। সফরে চিতওয়ানে এক রাত, পোখরায় দুই রাত, নগরকোটে একরাত্রি, কাঠমান্ডুতে তিন রাত।

কখন যাবেন: শীতের সময় নেপাল খুব ভালো লাগবে। অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত নেপাল ঘোরার জন্য আদর্শ।

অমৃতাভ দে। নদিয়া, পশ্চিমবঙ্গ