অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
চালতা ফুল - সিরাজুল ইসলাম

     শ্রাবনের আকাশে এখন মেঘ-রোদ্দুরের খেলা চলছে। ব্রীড়ানবতঃ কিশোরীর মত লজ্জায় লাল হয়ে উঠে ফিক করে হেসে দিচ্ছে কখনোসখনো। তখন শরতের আকাশের মতই নীল আকাশ জুড়ে পেঁজা তুলোর মত সাদা মেঘের ছড়াছড়ি। দুষ্টু কিশোরের দুরন্ত মতিগতির মতই বোঝা যায় না শ্রাবনের আকাশের মনোভাব। এই ভালো, এই মন্দ।
     দুঃচিন্তায় পড়েছে ছোট্ট মেয়ে জরী। কাল তার স্কুল।  অথচ কেচে ধুয়ে দেয়া স্কুল ড্রেস শুকোতে পারছে না মোটেই। একটুখানী রোদ এলো তো আবার বৃষ্টি। এই অবেলায় আজ কাপড় না কাচলেই ভালো করতো মা, মনে মনে ভাবে জরী। কীইবা বয়স তার, তেরো কি চৌদ্দ।  সবেমাত্র অষ্টম শ্রেনীতে পড়ে। ওর চুপচাপ স্বভাব দেখে কেই ধরতেই পারেনা কী ভীষন যন্ত্রনা ওর বুকের মাঝে বয়ে বেড়াচ্ছে মাতামূহুরী নদীর জলের মতই তিরতির করে। জরীর যখন ভীষন কান্না পায়, চুপচাপ চলে আসে পুরনো বাড়ীর নড়বড়ে সিঁড়ি মাড়িয়ে শ্যাওলা জমানো ছাদের ধারে বুক অবধী উঁচু রেলিং এর ধারে চালতে গাছের নীচে। একাকি নিরব অভিমানে দু'চোখের জল ফেলে আর কষ্টের কথাগুলো বলে চালতে গাছটার সাথে। কেনই বা বলবে না?  এই চালতা গাছটা ছাড়া ওর তো আর কোন বন্ধুই নেই।

     সে বেশ কয়েক বছর আগে দূরের গাঁয়ে মামাবাড়ী থেকে জরী আর মৌরী দু'বোন মিলে অনেক যত্ন করে এই চালতা গাছটা নিয়ে এসেছিলো। দু'বোন মিলে গাছটা পুতে দিয়ে নিয়মিত দেখাশোনা করে আগলে রেখেছে শিশুর মত করে। মৌরী খুব চালতার আচার খেতে পছন্দ ভালোবাসে। মামাবাড়ী থেকে চালতা ফল এনে শিল-পাটাতে পিষে ঝাল নুনে মাখামাখি করে দু'বোন এই ছাদের নির্জনতায় চুকচুক করে চূষে চূষে খায় আর অনাবিল আনন্দে হেসে কুটিকুটি হয়।
     মৌরীর কথা মনে হতেই জরীর দু'চোখ বেয়ে কুলকুল করে জল গড়িয়ে পড়ে। দু'বোনের কত ভালোবাসা। অথচ আজ কতদিন হলো মৌরীর সাথে দেখা হয় না জরীর। শুধু জরী কেন! এ গ্রামের কারোর সাথেই আর মৌরীর দেখা হয় না। 

     তিন বছর আগের কথা। জরী সবেমাত্র ক্লাস সিক্সে আর মৌরী ক্লাস টেন উঠেছে। দু'বোন মিলে বেড়াতে গেছে শিমুলতলীর গাঁয়ে মামাবাড়ী। মামাতো ভাইবোনের সাথে হাসি আনন্দে কাটছে দিনগুলো। আরও একমাত্রা যোগ হয়েছে মামাদের দূর সম্পর্কের আত্বীয় 'মনি ' ভাইকে পেয়ে। কত যে গল্প জানে মনিভাই! ওর গল্প বলার ভঙিমাটা বড় অদ্ভুত! মুগ্ধ হয়ে যেতে হয় তার গল্প শুনে। সেই মনিভাইকে একদিন হুট করে ভালোবেসে ফেললো মৌরী। ব্যাপারটা আস্তে আস্তে এ কান সে কান হতে হতে বাবার কানেও পৌছুলো। রাশভারী বাবা শুনে রক্ত-রাঙা চোখে মৌরীকে শাসালো আর বলে গেলোঃ,
     'মনি-র বাবা দাদুরা বংশ পরম্পরায় আমাদের জমিতে কিষান খেটেছে! ওর এতোবড় আস্পর্ধা দু'কলম লেখাপড়া শিখে সেসব ভুলে যেয়ে মনিবের মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছে?"
     মৌরীর মা অবশ্য মৌরীর বাবাকে বোঝাতে চেয়েছেঃ-
     "দেখো! আমাদের এখন আর সে দিনকাল নেই। তাছাড়া মনি শিক্ষিত ছেলে, ভালো চাকরী বাকরি করে শহরেই থাকবে! আমাদের মৌরীর কোনই অসুবিধা হবে না!"
     বাঘের মত হুংকার দিয়ে ওঠে মৌরীর  বাবা। বলেছেঃ,
     "চাকর চারকই! চাকর আর মনিবের রক্ত কোনদিন এক হয় না। হতে পারে না! প্রয়োজনে মেয়েকে কেটে দু'টুকরো করে মাতামূহুরী নদীতে ভাসিয়ে দেবো, তবুও চাকরের ঘরে মেয়ে দেবো না!"

     সময় গড়িয়ে যায় আপন গতিতে। বাঁধ দেওয়া যায় না যেমন নদীর জলকে, তেমনিভাবে রোধ করা যায় না ভালোবাসার দীপশিখাকে। সে মানে না শাসন, মানে না বারণ। বরঞ্চ বাঁধা পেলেই আরো ফুঁসে ওঠে প্রমত্তা মেঘনার মতন। দু'কূল ছাপিয়ে ভাসিয়ে দেয় সবকিছু। মৌরী আর মনিও এগিয়েছে বহুদূর। বয়সে বড় হলেও মৌরী জরীকে জানিয়েছে সবকিছু। আর জরীও তার ছোট বুদ্ধি দিয়ে মৌরীকে সাহস দিতো।

     সেদিনও তেমনি ছিলো। আজকের মত নীল আকাশের বুকে সাদা মেঘের ছড়াছড়ি। বিকেল বেলা মৌরী আর জরী দু'বোন ছাদে এলো। মৌরীর আজ যেন কথার যাদুতে ধরেছে। কত কথা যে সে বলছে ছোটবোন জরীকে জড়িয়ে বুকের মাঝে। মা বাবা, মামাবাড়ী,  শান-বাঁধানো পুকুর ঘাটলা থেকে শুরু করে সব কিছুই! কোনটাই বাদ রাখেনি আজ সে। উদাস হয়ে আকাশের দিকে জরীকে বলেছেঃ-
     "দেখ! আমিও হয়তো ওই মেঘের মতই দূরে কোথাও চলে যাবো! হয়তো আর ফেরা-ই হবে না কোনদিনও।"
     শুনে ডুঁকরে কেঁদে ওঠে জরী। ছোট বোনটাকে বুকের মাঝে আরো আবেগে জড়িয়ে ধরে!  মৌরীর নিজের চোখ-ও ভিজে যায়! মৌরী বলেঃ-,
     "শোন জরী! যখনই তুই খুব একা হয়ে যাবি, অথবা মন ভীষন খারাব হবে, তুই এসে এই চালতা গাছটার সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলবি! যতদূরেই থাকি না কেন আমি তোর সব কথা শুনতে পাবো!"
     জরী অতশত বোঝে ন। বলেঃ-,
    "কেন তুমি হারিয়ে যাবে? আমরা দু'বোন মিলেমিশে এ বাড়ীতেই থাকবো,বাবা-মায়ের কাছে। তুমি দূরে চলে গেলে আমি কার সাথে কথা বলবো?  তোমাকে না পেলে আমিও হারিয়ে যাবো!"
     "দূর পাগলী! দু'বোন চলে গেলে বাবা-মা যে পাগল হয়ে যাবে! আমি না গেলে যে মনি-ভাই পাগল হয়ে যাবে! তাই আমাকে যেতেই হবে। আজ না হোক, দু'দিন পরে অন্য কারো ঘরে তো আমাকে যেতেই হবে! তার চে বরঞ্চ পরিচিত মানুষের কাছে চলে যাওয়াই ভালো।"
     "তুমি তাহলে আর আসবে না? যদি চলে যাও! "
     দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখের ওপর লুটিয়ে পড়া চুলের গোছা সরিয়ে মৌরী বলেঃ,
     "যেদিন দেখবি খুব নীল আকাশ, আর আমাদের দু'বোনের হাতে লাগানো চালতা গাছে প্রথম ফুল ফুটবে! সেদিন হয়তো আমি আসতে পারি!"
     বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। দু'বোনের কথার বান যেন শেষই হয় না। মায়ের বকবকানিতে দু'বোন নীচে নামে।
     পরদিন সকালে খোঁজ খোঁজ, না, মৌরী নেই! কোথায় গেছে কোন হদিশ কেউ পায়নি আজও। রাতের অন্ধকারে এক কাপড়েই চলে গেছে। তার ফেলে রেখে যাওয়া কাপড়-চোপড় ধরে মা অলক্ষে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। বাবার মুখ আরও বেশী থমথমে। জরী কাউকেই কিছু বলতেও পারে না, জানতেও পারে না।

     এরপর জরী বড় একা আর অসহায় হয়ে পড়েছে। কষ্টের কথা ভাগ করার মত ওর  আর কেউই নেই। এই চালতা গাছটাই যেন হঠাৎ করেই তার মৌরী হয়ে গেছে। যত কথা তার এই চালতা গাছটার সাথেই। প্রতিদিন নিয়ম করেই জরী এসে বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করে চালতা ফুল ফুটেছে কি না! না ফোঁটেনি, নিরাশ হয় জরী! মাঝেমাঝে সে বেশ বকা দেয় চালতে গাছটাকে, ফুল না ফোঁটানোর জন্যে। ফুল ফুটলেই যে মৌরী আসবে, কথা দিয়েছে।      ক'দিন ধরে জ্বরে পড়েছিলো বলে স্কুলে যাওয়া হয়নি জরীর। স্কুল-ড্রেস শুকোতে ছাদে এসেছে। আজ সারা আকাশটা বেশ নীলে নীলে ছেয়ে আছে শরতের আকাশের মতই। চালতা গাছটার সাথে কথা বলতে বলতে জরী এক সময় খেয়াল করলো তার ঠিক মাথার ওপরের ডালে একেবারে হাতের নাগালে, মাখন-সাদা আভায় একথোকা ফুল ফুটেছে! আনন্দে চিৎকার দিতে যেয়েও ওর কন্ঠে কোন আওয়াজ এলো না। শুধু দু'চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে গেলো। বোবায় ধরা মানুষের মত অস্ফুট গোঙানীর শব্দ বেরিয়ে এলো মুখ থেকে!
    কী যে খুশী লাগছে! চালতা-ফুল ফুটেছে! মৌরী কথা দিয়েছিলো, যেদিন ফুল ফুটবে সেদিন সে আসবে!
     সকাল থেকে দুপুর,দুপুর থেকে বিকেল- ছাদে দাঁড়িয়ে শূন্য পথের দিকে তাকিয়ে জরীর দু'চোখ ক্লান্ত! মৌরী আসবে!

     না, মৌরী আসে না!
     অপেক্ষার প্রহর কেটে যায়!
     মৌরী এখন কতদূরে?

সিরাজুল ইসলাম। বাংলাদেশ