ধর্ষিতা হয়ে হিরামনির মর্মান্তিক মৃত্যু এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
ফরিদ তালুকদারঃ ঘটনাটি গত ১২ ই জুনের। ঘটনার বিবরণে জানা যায় যে, নবম শ্রেণীর ছাত্রী হিরামনির ক্যান্সার আক্রান্ত বাবা ঢাকায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। মা সহ পরিবারের অন্যরাও তখন তার পাশে। হিরামনি একা বাসায়। দিনের বেলা। কিন্তু তার এই একাকীত্বের সুযোগ নিয়ে কতিপয় (চারজন সন্দেহ করা হচ্ছে) বর্বর তাকে ধর্ষণ করে হত্যা করে রেখে যায়!
হিরামনির মৃত্যু, নুসরাত এর মৃত্যু, আবরারের মৃত্যু, বাতাস কাঁদছে, চাঁদ-সূর্য অসহায়, মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। আর আমরা মানুষ পশু (নৃশংসতায়, হিংস্রতায় অন্য আর কোন পশুর সাথে আমাদের তুলনা করে তাদেরকে ছোট করার অধিকার আমার নেই বলে মনে করি) দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করি, আমরাই হলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী। মেনে নিলাম। কিন্তু প্রশ্ন হলো কোন অর্থে? আমরা আমাদের মতো করে ঈশ্বর বানাই। আমরা মসজিদ, মন্দির, গির্জা, সিনেগগ, প্যাগোডায় যাই। আমরা সেখানে কাল্পনিক স্বর্গ নরকের কথা বলি। আমরা সেখানে বিভেদের শিক্ষা নেই, আমরা সেখানে আমাদের স্বার্থ আর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের দীক্ষা নিয়ে মানুষ নিধনে অবতীর্ণ হই। আমরা এক কাল্পনিক জগতের মোহাবিষ্ট হয়ে আমাদের বর্তমান পৃথিবীকে নরক বানাই। আমরা মাদ্রাসা অঙ্গনে নুসরাতকে ধর্ষণ করতে ব্যার্থ হয়ে তাকে জীবন্ত অগ্নিদাহ করি এবং তারপরেই আমরা মসজিদে আমাদের সৃষ্ট ঈশ্বরের কাছে গিয়ে সেজদায় অবনত হই। আমরা হিরামনির আপন গৃহে তাকে একাকী পেয়ে বলাৎকার করে তাকে হত্যা করি। তারপরও এই সমাজে মানুষের পরিচয়ে ঘুরে বেড়াই। আমরা ক্ষমতার শীর্ষ আসনে বসে এই সবের বিচার হবে বলে জনগনের কাছে কথা দেই এবং নিজেদেরকে দেব/দেবীর সমতুল্য করে তুলে ধরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। আবার অন্যদিকে বিচার ব্যবস্হায় নিজেরাই সীমাহীন দূর্নীতির বৃক্ষের বীজ রোপণ করে বসে থাকি। কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা নিজের গদিটাকেই ক্ষমতার জোরে অবৈধ ভাবে আঁকড়ে বসে থেকে দেশের সবচেয়ে বড় অপরাধটি করে থাকি! সুতরাং আমাদের গদির ছায়াতলে থেকে জনগন কি সুবিচার আশা করতে পারে? আমরা এমন সব ঘটনায় যে যার মত দায়সারা গোছের দু'একটি কবিতা বা এমন দু'একটি নিবন্ধ লিখে ভাবতে থাকি অনেক করেছি, আমাদের দায়িত্ব শেষ! এই হলো আমাদের যাবতীয় আমরাদের পরিচয়…! মানুষ(?) আমরাদের পরিচয়…! এর সাথে দারুণ ভাবে মিশ্রিত আছে গ্যাংগরিনের মতো আমাদের মস্তিস্কে ছড়িয়ে পড়া শতবছরের লালিত পুঁজিবাদী ক্ষত। সোনায় সোহাগা আর কি! এতক্ষণ যা যা বললাম তা হলো বর্তমান বিশ্বের মানচিত্রের এক ছবি। এরপরে আমরা যদি আমাদের বাংলাদেশের মানচিত্রের রক্তাক্ত ছবির দিকে তাকাই তাহলে নির্দিধায় মনে প্রশ্ন জাগে আমি এখনো কেন নিজের সাথে এই মানুষ শব্দটি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি? এ সমাজ ছেড়ে আমি এখনো কেন আফ্রিকার শিম্পাঞ্জি সমাজের কাছে চলে যাই না? তার মানে আমিও খারাপ।
করোনা শুরুর পর থেকে আমার প্রায় সবকটি নিবন্ধ আর কবিতায় ই বলার চেষ্টা করেছি যে করোনা এখনো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহামারীর নাম নয়। আমরা মানুষেরা বহাল তবিয়তে এখনও ঐ স্হানটি দখল করে বসে আছি। আমরাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহামারী, বড় প্লেগের নাম। এবং এটা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত। এখনো পর্যন্ত যে তথ্য উপাত্ত পাওয়া গেছে তাতে পৃথিবীর অনেক অণুজীববিজ্ঞানীই মনে করেন যে, চায়নার উহান প্রদেশের ঐ ল্যাবে সারস (SARS) এর ভাইরাসকে নিয়ে গবেষণা করে ওটাকে মিউটেট (Gain of function Mutation) করে আরও শক্তিশালী ভাইরাস তৈরী করতে গিয়েই কভিড-১৯ এর এই বিপর্যয়! তাহলে চায়না এটা কেন করতে গেল? আবারও সেই পুরনো উত্তর। দখলদারিত্বের লড়াই। তারা তাদের হাতে একটি শক্তিশালী বায়োলোজিকাল উইপন (Biological Weapon) রাখতে চেযেছিলো। সুতরাং করোনা নয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহামারীর নাম মানুষ এবং মানুষ এবং আবারও মানুষ। শুধু এই কারনেই বলছি তা নয়। সৃষ্টির আদি থেকে এখন পর্যন্ত মানুষ ই একমাত্র প্রাণী যে তার স্বজাতিকে সবচেয়ে বেশী হত্যা করেছে এবং করছে। হত্যা করছে অন্য প্রাণীদের ও।
হিরামনির বিভৎস হত্যা নিয়ে ভেবেছিলাম হৃদয়ের ক্ষোভ উগরে দিয়ে একটা কবিতা লিখবো। কিন্তু তা না করে আবারও আমি এ পথেই হাঁটলাম। কারণ, ফুলের মতো এই মেয়েটি, যে তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্নগুলো মাত্র দেখা শুরু করেছে, বিভৎসভাবে তার এই মৃত্যুর জন্যে যে বর্বর গুলো দায়ী তারা একটা ভুল সিস্টেমের প্রোডাক্ট। এটা কোন বিচ্ছিন্ন একটা ঘটনা নয়। এমন ঘটনা আমরা পূর্বেও দেখেছি এবং নিশ্চিত যে পরেও দেখবো। আমরা এমন একটা সিস্টেমের মধ্যে বাস করছি যেখানে চার বছরের একটা শিশু এক ফ্লাট থেকে আর এক ফ্লাটে যাওয়ার পথে এপার্টমেন্টের সিঁড়ি পথেই ধর্ষিতা হয়। এ সমাজ হিরামনিকেও তার গৃহের ভিতরে নিরাপত্তা দিতে পারে না। সময় এসেছে পুরো নগ্ন করে আমাদের অন্তর্গত স্বরূপটার দিকে চোখ খুলে তাকানোর। মানবতার গীত আমরা যতোই গাই, ধর্ম চর্চা আমরা যতোই করি না কেন, গত শতবছরে আমরা আমাদের অন্তর্গত শুদ্ধির উন্নতি বিন্দু মাত্র ঘটাতে পারিনি! এটাই সত্য। হিরামনিকে ধর্ষণকারীদের নাম এখনো জানতে পারিনি। কিন্ত এই সমাজে যে মাত্র এই চারজন তা ই তো নয়। এমন হাজার হাজার শিকারী প্রতিদিন ই তো আমাদের সামনে ঘুরে বেড়ায়। সুযোগ পেলেই যারা হিংস্র দাঁত বেড় করে ফেলে। এদের মনোজগত পাঠ করার কোন প্রযুক্তিই তো এখনো বেড় হয়নি। আইনের শাসনের দেশে তাও যা বিচারের কিছুটা ভয় আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মত দেশে যেখানে প্রশাসনের লোকেরাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খুনি সেখানে এই বর্বর গুলো এটা করে যাবে তাই ই তো স্বাভাবিক।
সময় তো আমরা কম পাড়ি দেইনি। কিন্তু গত শতবছরে আমরা নিজেদেরকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়েও যেকোন পশুর চেয়ে অধম হয়ে আছি। কেন?? কারন গুলো খোঁজা এখন খুব জরুরী। আমাদের সমাজ, ধর্ম বিশ্বাস, অর্থ বিন্যাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি সবকিছুর শেকড়ে পরিবর্তন আনা এখন খুব জরুরী। তা না করে আমরা শুধু পলেস্তারা খসে পড়া ভায়নক ভাবে ব্যার্থ একটা ইমারতের দেহে রং করে নিজেদেরকে এক মিথ্যা প্রবোধ দিয়ে চলেছি। হিপোক্রেসি নিজের সাথে, হিপোক্রেসি সমাজ জুড়ে, হিপোক্রেসি বিশ্ব জুড়ে!
এই হিপোক্রেসির মূল যদি আমরা উৎপাটন করতে ব্যার্থ হই তাহলে এমন হাজারো হিরামনিদের মর্মান্তিক মৃত্যু অনিবার্য। আর এ দেখে আমরা শুধু দুদিন হৈচৈ করবো, এমন দু’কলম লিখবো আর সাথে একটি দীর্ঘশ্বাস…! ব্যস্… হয়ে গেলো দায়িত্ব শেষ। একদিন অতিবাহিত হতে না হতেই আবার সেই নর্দমাময় জীবনের স্রোতে গা ভাসানো। এই ই তো চলছে…! কিন্তু আরও কতকাল…!?
ফরিদ তালুকদার। টরোন্টো, কানাডা
-
নিবন্ধ // মতামত
-
16-06-2020
-
-