কাবেরি কথা — রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়
ভদ্রেশ্বরের বনেদি বাড়ির মেয়ে কাবেরি সান্যাললের মনে পড়ে গেল অল্প বয়েসের কথা৷ নামেই বনেদি বাড়ি সত্তর দশকের বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত বাড়ি গুলোর ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা৷ শরিকি বাড়িতে বড় হওয়া৷ নিজেদের বনেদি ভাবাটাই আছে আর কিছু জীবনে নেই৷ তখনও টিভি আসেনি, আসেনি ফ্রিজ, ইণ্টার নেট মোবাইল তো মঙ্গল গ্রহের যন্ত্র আর কি৷ রেডিও থাকাটাই বিরাট সম্বল৷ একটা রেডিও বাড়ির সবার মনোরঞ্জন করে৷ বাবার খবর শোনা, ভাইয়ের খেলার ধারাভাষ্য শোনা, বিবিধ ভারতী সবাই মিলে শোনা৷ এটাই ছিল নিঃস্তরঙ্গ জীবন৷ কিছু না থাক বনেদি বাড়ির চেহারাটা ছিল৷ তার মধ্যেই মেজ পিসিমা ভালো পাত্রের খোঁজ আনল৷ আগেও কয়েক জন আত্মীয় খবর এনেছিল কিন্তু তারা যেন কেমন কেমন মতো৷ পাত্র মোটামুটি হলেও পাকা বাথরুম নেই৷ এই পাত্রটিও ভালো সেলট্যাক্সে কাজ করে৷ পিসিমা বাবাকে চুপিচুপি বলেছে উপুরি আয় আছে৷ যদিও কথাটা আর চুপিচুপি রইল না৷ যেরকম গোপন থাকে না সেরম আর কি৷ যাইহোক পাত্রি পছন্দ হলো৷ হবেই না বা কেন যা রূপের ছটা৷ শুধু খুব স্বচ্ছলতার ছাপের অভাব এই যা৷ সবাই বলল উপুরি আয়ওলা সরকারি চাকুরে পাত্র৷ দু-দিন বাদে সুখের ঘরে রূপের বাসা উথলে উঠবে৷ বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হলো৷ মনের ভেতর কাবেরির একটা উথাল-পাথাল ভালো লাগা কিন্তু তখনকার সময়ে মেয়েদের এগুলো খুব প্রকাশ করা পুরোনো পন্থি বনেদি বাড়িতে চলে না৷ বাচাল বলবে সবাই৷ সাধ্যমতো বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা৷ বিয়ে হলে একটা হিল্লেও হবে৷ (মেয়েদের অসম্মান করার প্রবণতা চিরকালই ছিল আজও আছে৷) পরে আবার ছোট দুই বোন আছে৷ ছেলের আশায় আশায় তিনটে মেয়ে আরকি৷ কাবেরির তখন উনিশ বছর বয়েস পূর্ণ যুবতীর দিকে দিনে দিনে জলছাপ ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে৷ পাত্রটিকেও দেখতে বেশ৷ মানাবেও ভালো৷ বিয়ের দিনক্ষণ এগিয়ে এল৷ সাধ্যমতো বিয়ের গয়না বাড়ির পুরোনো স্যাকরা কমলবাবুই তৈরি করলেন৷ কাবেরির একটা ব্যাপারে মনটা খুঁত খুঁত করছে কমলবাবুর গয়নার ডিজাইনটা একটু পুরোনো ধরনের৷ কি করা যাবে—কলকাতার বৌ-বাজার থেকে গয়না তো তৈরি করার সাধ্য পরিবারের নেই৷
সবই ঠিক ছিল কিন্তু আইবুড়ো ভাতের আগের দিন ঘটল সেই মর্মান্তিক ঘটনাটা৷ পাত্রপক্ষ সকাল সকাল নৈহাটি থেকে ছুটে এলো৷ এক পাড়ার ছেলে নাকি দাবি করেছে সে কাবেরির প্রেমিক৷ কে সে? বাড়িতে বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো৷ ক্রমশঃ প্রকাশ্য হলো পাড়ার সোমনাথদা কাবেরিকে অঙ্ক করাতো, সেই গিয়ে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে৷ পাত্রপক্ষ বলেছে এরকম সম্পর্ক থাকলে তো আমরা এই মেয়ে নেবনা৷ সে কি কথা এখন তো সবই তৈরি সে কি করে সম্ভব ! বাড়িতে সবাই কাবেরিকে চেপে ধরলো—নিশ্চয় কিছু করেছিস৷ চিঠি দিয়েছিস? কতদূর এগিয়ে ছিলো? বাড়ির এইভাবে মুখপোড়ালি কেন? সত্যিই কাবেরি কিছু করেনি৷ কিন্তু ঐ রূপের ছটায় কখন যে গোপনে মুগ্ধ হয়ে গেছে সোমনাথদা কাবেরি বুঝতেই পারিনি৷ হয়ত অজান্তেই চাহনিতে কোনো বার্তা চলে গিয়েছিল৷ জ্যাঠতুতো দাদার বন্ধু বলে অঙ্কটা দেখিয়ে দিত৷ সেজোপিসেমশাই ভীষণ দুর্মুখ৷ বাবাকে যাচ্ছেতাই করে বলল—আপনার কি বুদ্ধিনাশ হয়েছিল? দামড়া আইবুড়ো ব্যাটাছেলে কে দিয়ে অঙ্ক কষাচ্ছেন৷ ওতো প্রেমে পড়বেই৷ দামড়া ব্যাটা সুন্দরীর মেয়ের প্রেমে পড়বে নাকি কীর্তন করবে৷ অঙ্ক করাতে এসে প্রেমের অঙ্ক কষেছে৷ সত্যিই কাবেরির দোষ ছিল না৷ দোষ মেয়ে হয়ে জন্মানোর৷ জন্মের সময় ঠাকুমা বলেছিল—একে মেয়ে হলো তাও আবার অম্বুবাচিতে৷ ও মেয়ের ভাগ্য ভালো হবে না৷ দূর ওসব কথা কেউ মানে নাকি আজকের দিনে৷ বাবা-কাকা কথাটা আমল দেয়নি ওরা যে একটু যুগের হাওয়ায় নাস্তিক বামপন্থী ছিল৷ যদিও কোনোদিন পার্টি করেনি সেভাবে৷ চল্লিশের দশক হলে যা হতো সত্তরের দশকে তা হলো না৷ যুগটা তো পাল্টেছে৷ ছোটো মেসোমশাই পুলিশে ছিলেন৷ তিনি বললেন, এখন এরকম হলে তো পুলিশ কেশ হবেই৷ যাইহোক পাত্রপক্ষ নিমরাজি হয়েও বিয়েতে রাজি হয়ে গেল৷
এই ঘটনাটা পাড়াতে ছড়াতেই পাড়ার ক্লাবের সমস্ত ছেলেরা বেরিয়ে পড়লো৷ সোমনাথকে ধরতেই হবে এবং ওকে উচিত শাস্তি দেওয়া দরকার৷ হ্যাঁ, ধরা পড়েও গেল৷ সোমনাথদা তো পাগল প্রেমিক ছিল৷ শাস্তির ভয়ে লালুবাবুদের গোয়াল ঘরে খড়ের গাদার পেছনে লুকিয়ে ছিল৷ চণ্ডীর ঠাকুমা গরুকে জাব দেবে বলে গোয়াল ঘরে যেতে গিয়ে দেখতে পেয়ে চিৎকার করতেই সোমনাথদা ভয়ে পালাতে গেল কিন্তু পাঁচিল টপকাতেই একেবারে পাড়ার ছেলেদের মুখোমুখি৷ প্রচণ্ড মারতে মারতে সবুজ সংঘের ক্লাব ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে সোমনাথদাকে আটকে রাখল৷ পরে ভুবনবাবুদের একতলা বাথরুম সমেত একটি ঘরে স্থানান্তরিত করা হলো বৌভাত পর্যন্ত৷ এখনকার দিন হলে কেউ ঠিক মিডিয়া বা থানায় ভিডিও তুলে পাঠিয়ে দিত৷ তখনকার দিনে তা হতো না৷ পুরো আনন্দ অনুষ্ঠানটাই তিক্ততার মধ্যেই শেষ হলো৷ নতুন বৌ শ্বশুর বাড়িতে গেল, শাশুড়ি, স্বামী মেনে নিল কিন্তু মনে নিল না৷ কথায় কথায় বলে না তুমি কিছু করোনি ধোয়া তুলসি পাতা৷ বিয়ের কয়েক বছর পর কোল আলো করে কন্যা সন্তান এলো৷ কয়েক মাস পরে বোঝা গেল ডান পা-টা কুশ-পা মানে পায়ের পাতাটা ব্যাঁকা৷ ওফ্ বিয়েটা কাবেরির কাছে আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দেখা দিল৷ সত্যি কি ঠাকুমা যে বলেছিল অম্বুবাচিতে জন্মালে তার ভাগ্য ভাল হয় না৷ কি জানি শিক্ষিত মন দোলা চলে ভোগে৷ শাশুড়ি-স্বামীর সাথে তিক্ত সম্পর্ক আরও বক্র আকার নিল৷ সবসময় কথা কাটাকাটি, কিছু একটা হলেই ঐ সোমনাথদার প্রসঙ্গ উঠে এক চরম অশান্তি৷ মেয়েটা একটু একটু করে বড়ো হচ্ছে৷ কাবেরির মনে হয় একে মেয়ে জন্ম পাপের তায় আবার পা-টায় সমস্যা৷ বেঁচে থাকার সব আনন্দই যেন নষ্ট৷ তাও মনকে শক্ত করে চলে, বাপের বাড়ির লোক বলে কি করবি মেনে নে৷ সংসারে চরম অশান্তি, এখন সে মনকে শক্ত করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্যে আবার এডুকেশনের দিকে মন দিল এবং প্রাইভেটে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করলো৷ এরপর বাপের বাড়ির সূত্রধরে একটা স্কুলে শিক্ষিকার চাকরিও জুটিয়ে ফেলল৷ শ্বশুড় বাড়ির আপত্তি সত্ত্বেও চাকরিটা করতে লাগলো৷ শাশুড়ি বলল তোমার বাচ্চা আমার ঘাড়ে ফেলে বেড়াতে বেরিয়ে যাচ্ছ৷ হ্যাঁ, এবার কাবেরির একটু অন্য জীবন হলো৷ বাঁচারও একটা মানে আছে তার মনে হলো৷ এইভাবেই দিন গড়ায়৷ মেয়েটা স্কুলে যায়৷ দেখতে দেখতে চাকররি জীবনেরও তিরিশ বছর হয়ে গেল৷ চুলে পাক ধরেছে৷ মেয়েদের স্কুলে সব টিচাররা ঠিক করলো পুরী যাবে৷ হ্যাঁ অনেক তো হলো৷ কয়েক দিন পুরীতে জীবনের দুঃখের কথা ভুলে কাটছিল৷ এক মেঘলা দিনে পরন্ত বিকেলে কাবেরি সমুদ্রের ধারে একা এসে বসলো নিজের সাথে কথা বলতে৷ ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে, না এবার হোটেলে ফেরা যাক৷ পেছন ফিরতেই যেন চেনা মুখ দেখে বজ্রাঘাত৷ এ সোমনাথদা না ! হ্যাঁ কত বুড়ো হয়ে গেছে৷ কিরকম আছো কাবেরি? কাবেরি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ এ লোকটার জন্যই জ্বলেপুড়ে মরল সারাজীবন৷ আমাকে তুমি ক্ষমা করো কাবেরি৷ ক্ষমা চাইলেই কি ফিরে আসে সেই দিনগুলো? সমুদ্রের ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকে দুটো মানুষ৷ মনে হয় একচড় দি৷ আমার ছেলেটা মারা গেছে কাবেরি৷ চমকে উঠলো কাবেরি৷ অজানা জ্বরে পনেরো বছরের ছেলেটা মারা গেল৷ দুটো অসুখি মানুষ সমুদ্রের পারে দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে৷ বাতাসে ঝোড়ো হাওয়া থেমে যাবে৷ মনের ঝড় চলে সারাজীবন৷ কাবেরি ধীর পায়ে হোটেলের দিকে হাঁটে৷ মনে হয় যদি জন্মান্তর থাকে হয়ত পরজন্মে ভালো জীবন হতেও পারে৷ হোটেলের বিছানায় এসে চুপ করে বসে পড়ে৷ মোবাইলে স্বামীর ফোন কলটা বেজে ওঠে ……. ৷
রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
-
গল্প//উপন্যাস
-
16-06-2020
-
-