অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
রোমাঞ্চ গাঁথা এক খণ্ডহর - অতনু প্রধান

বিস্তীর্ণ মরু প্রান্তর। কেল্লা, প্রাসাদ কিংবা দুর্গের বহু ছবি এখনো বিদ্যমান। যেখানে ইতিহাস আজও ফিসফিসিয়ে কথা বলে। রাজস্থানের সেই স্বর্ণ শহর জয়সালমের। নামটি শুনলেই বাঙালীর মনে জাগে নস্টালজিয়ার ছোঁয়া। সমগ্র জয়সালমের জুড়ে ইতিহাস ও রহস্য যেন একাত্ম হয়ে রয়েছে। ‘সোনার কেল্লা’ ছাড়াও মরু প্রদেশের সোনালী বালুরাশির মাঝে লুকিয়ে রয়েছে এমন কিছু রহস্য ও রোমাঞ্চ, যা সম্পূর্ণ ভাবে আমাদের অজানা। সেই সমস্ত ঐতিহাসিক স্থান গুলিকে ঘিরে রয়েছে কত অজানা কাহিনী ও জনশ্রুতি, এই দু-এর মেলবন্ধনে সৃষ্টি হতে থাকে সত্য ও মিথ্যার এক আলো আঁধারী কাহিনী। এমনই কিছু রহস্য ও রোমাঞ্চ ঘিরে রয়েছে জয়সালমেরের কাছে  কুলধরা ও খাবা দুর্গে।

কুলধরার ইতিহাস:
     জয়সালমের থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত কুলধরা (২৬˚৮১’ উঃ অঃ / ৭০˚৮০’ পূঃ  দ্রাঃ) নগরী। কুলধরা সহ ৮৩টি ছোট ছোট গ্রামগুলিকে নিয়ে ১২৯১ সাল নাগাদ পালিওয়াল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের দ্বারা গড়ে উঠেছিল এই বৃহৎ নগরী। এই নগরীতে প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার ছিল।  যাত্রাপথে মরু  অঞ্চলের মাঝে  সবুজ গাছপালার হাতছানি, যা হৃদয়কে  গভীর ভাবে আকর্ষণ করে। রাস্তার দুই ধারে মরুভূমির মাঝে অসংখ্য বায়ু কল চোখে পড়বে। পরিত্যক্ত এই নগরীটিকে নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত সত্য এযাবৎকাল পর্যন্ত সঠিক ভাবে উন্মোচিত হয়নি। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ কুলধরা নগরীকে জাতীয় সংরক্ষিত সৌধের মর্যাদা প্রদান করেছে। জনমানবহীন এই মরু প্রান্তরে মানুষের উপস্থিতি তেমন ভাবে চোখে পড়ে না। কিন্তু বর্তমানে পর্যটকদের নিয়মিত যাতায়াতের কারনে পার্শ্ববর্তী গ্রামের কিছু মানুষ ব্যবসায়িক প্রয়োজনে কেবলমাত্র দিনের বেলা কয়েক ঘন্টা এখানে অতিবাহিত করেন, কিন্তু রাত্রে এই স্থানে থাকার  দুঃসাহস কেউ দেখাতে ইচ্ছুক নন। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই অঞ্চলের  অত্যাচারী শাসক ছিল সেলিম সিং। সেলিম সিং কর আদায়ের জন্য হেন  কোন প্রকার দুর্নীতি ছিল না, যার  আশ্রয় সে নেয় নি। এই সেলিম সিং-এর  একদিন  কু-নজর পড়ল কুলধরার গ্রাম প্রধানের ১৮ বছর বয়সী বিদূষী কন্যার দিকে। সেলিম সিং সেই গ্রাম প্রধানের কন্যাকে জোরপূর্বক বিবাহ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে। সেলিম সিং লালসার বশবর্তী হয়ে ওই মেয়েটির জন্য খুবই বেপরোয়া হয়ে উঠে এবং ক্রুদ্ধ হয়ে কুলধরার নগরবাসীগণের উপর অকথ্য  অত্যাচার ও অস্বাভাবিক করের বোঝা চাপাতে থাকে।
     এইভাবেই কয়েক দিন অতিবাহিত হওয়ার পর, সেলিম সিং এর অত্যাচারের ভয়ে এবং কন্যাকে হারাবার আতঙ্কে ৮৪টি গ্রামের অধিবাসীরা সম্মিলিত ভাবে গোপন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। একদিন রাতেই ঘটে যায় সেই অদ্ভুত ঘটনা। মেয়ের সম্মান রক্ষার্থে রাতারাতি ৮৪টি  গ্রামের লোক অদৃশ্য হয়ে যায়। কেউ বলেন গ্রামবাসীরা দেওয়ানের অকথ্য নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান। আবার অনেকের মতে, কুলধরার অধিবাসীরা পরবর্তী সময়ে পশ্চিম রাজস্থানের যোধপুর শহরের কাছাকাছি কোনো একটি স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু এইসব মতামতের তেমন কোন সত্যতা এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় নি। কিন্তু সমগ্র রাজস্থানে  কুলধরার পালিওয়াল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের উপস্থিতির অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায় না। পরের দিন সেলিম সিং এসে দেখে গ্রামের পর গ্রাম ফাঁকা পড়ে রয়েছে। যা ছিল সব কিছুই রয়েছে যথাস্থানে। শুধু মানুষ নেই!
     পরবর্তী সময় সেলিম সিং নতুন করে গ্রাম স্থাপনের চেষ্টা করে। কিন্তু কোন ব্যাক্তি সেই গ্রামে রাত্রি যাপন করতে পারত না। তাদের মৃত্যু হত। মৃত্যুর প্রকৃত কারনও জানা যেত না। এরপর থেকে নানা  কাহিনী প্রচারিত হতে থাকে। তবে স্থানীয় লোকেরা মনে করেন কুলধরার অধিবাসীদের অভিশাপের কারনেই আর কেউ এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করতে পারেনি। অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগেই তারা  অভিশাপ ছড়িয়ে দিয়েছিলন নগরীর আকাশে বাতাসে। সেই থেকে কুলধরা এক পরিত্যক্ত নগরী হয়ে পড়ে রয়েছে আজও। এত বছর পরেও অবিকৃত থেকে  গেছে বাড়িগুলি। গ্রামের অভ্যন্তরে একটি মন্দির রয়েছে, কিন্তু সেই মন্দিরে কোন বিগ্রহ নেই। সেই ঘটনার পর কতগুলি  বছর কেটে গেছে, কিন্তু নতুন করে আর জনবসতি গড়ে উঠেনি কুলধরায়। জয়সালমেরের কুলধরায় এখনো পর্যন্ত রাত্রে কেউ পা-রাখতে সাহস করেন না। কুলধরায় যারা রাত কাটিয়েছেন, তারা কোন না কোন বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন, এমন উদাহরণও কম নয়।
     সোনালী বালুরাশির মাঝে মরূদ্যানের মতোই এক সময় মাথা তুলে সগৌরবে দাঁড়িয়ে ছিল কুলধরা। ৮৪টি ছোট ছোট গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছিল একটি বৃহৎ নগরী। সেই সময় এক সমৃদ্ধ জনপদ ছিল কুলধরা। চারপাশ মরু অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও কুলধরায় প্রকৃতি একটু ব্যতিক্রমই ছিল। খাদ্য ও পানীয় জলের কোন সমস্যাই ছিল না। তা না হলে এই সুবিশাল নগরী গড়ে ওঠা কোন ভাবেই সম্ভবপর নয়। কী ছিল না কুলধরায়! মন্দির থেকে শুরু করে, নিখুঁত পরিকল্পনায় তৈরি বিভিন্ন বাড়ি এখনও অক্ষত রয়েছে। টানা সাত শতক ধরে বসবাসের পর হঠাৎ এক রাতেই এই নগরী কিভাবে জন-মানবহীন হয়ে পড়ল তা আজও সকলের কাছে রোমাঞ্চকর বিষয়।
     স্থানীয় মানুষদের কাছ থেকে জানা যায় এই নগরটি নিয়ে বহু গবেষক গবেষণা চালিয়েছিলেন। সেই সব গবেষণায় উঠে আসা তথ্যের কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি। ২০১৩ সালে দিল্লির একটি সোসাইটির পক্ষ থেকে বেশ কিছু সদস্য রাত কাটাতে গিয়েছিলেন কুলধরায়। তাঁদের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিল না। কুলধরার বিভিন্ন স্থানে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে এরকম বেশ কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন গবেষকগণ। তাহলে কি বিজ্ঞানের যুগে অশরীরী উপস্থিতি আমাদের বিশ্বাস করতেই হবে? কালের নিয়মে বেশ কিছু বাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেলেও বেশ কিছু বাড়ি এখনও অক্ষত রয়েছে। এখনো অবিকল একই রকম অবস্থায় রয়েছে নগরটি।  কুলধরার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলির  উন্নতি হলেও কুলধরা যেন সেই সময়টিতে থমকে গেছে।

খাবা দুর্গের ইতিহাস:
     খাবা দুর্গ (২৬˚৮০’ উঃ অঃ / ৭০˚৬৭’ পূঃ দ্রাঃ) বর্তমানে জয়সালমের শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে (কুলধরা থেকে দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার) অবস্থিত একটি ছোট পরিত্যক্ত দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। এই দুর্গের ঐতিহ্যকে পুরানো মহিমায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে তার পুনরুদ্ধারের কাজ চলছে। এই দুর্গের সাথে সম্পর্কিত নানান ইতিহাস ও গল্প বেশ আকর্ষনীয়, যা বর্তমানে পর্যটকদের হৃদয়ে বিশেষ স্থান দখল করেছে।
     প্রায় ২০০ বছর আগে এই খাবা দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল। পরবর্তি সময়ে এই দুর্গের চারপাশে জনবসতিও গড়ে উঠেছিল। খাবা দুর্গটি ছিল একেবারে সীমান্তবর্তী দুর্গ। সিল্ক রুট ধরে ব্যবসা বানিজ্যের জন্য বহিরাগত  ব্যবসায়ীরা রাত্রে এই দুর্গে বিশ্রাম গ্রহণ করতেন। পরে উপযুক্ত কর প্রদানের পরই তাদের বানিজ্যের জন্য অনুমতি দেওয়া হতো।  কিন্তু ১৮২৫ সাল নাগাদ কুলধরার মতোই এই অঞ্চলের জনবসতিও রাতারাতি অদৃশ্য হয়ে যায়।
     স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই অঞ্চলের অধিবাসীগণ এই স্থান ত্যাগের পূর্বে, স্থানটিকে অভিশপ্ত করে বলে গিয়েছিলেন, যে ভাবে তারা এখানে বসবাস করতে পারলেন না, সেই ভাবেই কেউ কোন দিন এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করতে পারবে না। সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত এই অঞ্চলে কোন জনবসতি গড়েও ওঠেনি। এই দুর্গ থেকে অনতিদূরে রয়েছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্থানের সীমান্ত। বর্তমানে খাবা দুর্গটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি ভূতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা, যা পর্যটকদের কাছে বিশেষভাবে আকর্ষনীয়। খাবা দুর্গ থেকে নির্জন গ্রামের ধ্বংসাবশেষ দৃশ্যমান। শুধুই ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, সেখানে জীবনের চিহ্নমাত্র নেই!
     এ জগৎ চলছে তার আপন নিয়মে। আর যা কিছু ঘটছে তা অনিবার্য কারণে। যার ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ অজানা। হয়তো একেই বলে কালপ্রবাহ। আর আমরা সেই কালপ্রবাহের ভাসমান পর্যটকরূপে মরু শহরের সোনার কেল্লা দেখার পাশাপাশি প্রত্যন্ত মরু অঞ্চলে অবস্থিত রহস্যমন্ডিত কুলধরা ও খাবা দুর্গের ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখতে পারি। সূর্যাস্তের রক্তিম আভা যখন এই নগরীর বুকে এসে পড়ে, তখন সত্যিই মনে হয় এই নগরীর পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে কত  অজানা রহস্য ও রোমাঞ্চ!

যাত্রাপথের বিবরণ:
     স্বর্ণশহরে যেতে হলে প্রতি সোমবার হাওড়া স্টেশন থেকে জয়সালমের যাওয়ার ট্রেন রয়েছে। তাছাড়া দিল্লি, জয়পুর বা যোধপুর থেকে বহু ট্রেন জয়সালমের যায়। বিমানের মাধ্যমেও জয়সালমের যাওয়া যায়। তবে সরাসরি কলকাতা থেকে কোনো বিমান নেই,দিল্লি এবং জয়পুর থেকে বহু বিমান প্রতিদিন জয়সালমের যাতায়াত করে। জয়সালমের পৌঁছাবার পর ভাড়া গাড়ি নিয়ে অতি সহজেই কুলধরা ও খাবা দুর্গ ঘুরে আসা যায়।

থাকার স্থান: 
     কুলধরা ও খাবা দুর্গের আশেপাশে থাকার কোন হোটেল নেই। তবে জয়সালমের শহরে থাকার প্রচুর হোটেল রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে শহর ছাড়িয়ে মরু এলাকাগুলিতে থাকার জন্য কয়েকটি হোটেল নির্মিত হয়েছে। পর্যটকরা নিজেদের সুবিধা মতো অনলাইনে হোটেল বুকিং করতে পারেন। অ্যাডভেঞ্চারের জন্য থর মরুভূমির মাঝে তাঁবুতেও রাত্রি যাপন করতে পারেন।

অতনু প্রধান। কলকাতা