অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
এক দুঃখী সম্রাটের শেষ শয্যার পাশে – চিরঞ্জীব সরকার

দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন শেষ মুঘল সম্রাট। বৃটিশরা তাকে তৎকালীন বার্মা যা এটা আজকের মায়ানমার সেখানে নির্বাসনে পাঠায়। সেসময়কার রেঙ্গুন যা আজকের ইয়াংগুন সেখানেই তিনি মৃত্যুবরন করেন। বাহাদুর শাহ রাজা হয়েও রাজ্য শাসন করতে পারেনি। রাজ্য জয়তো দূরের কথা নিঠুর ভাগ্যের নিষ্ঠুর আঘাতে তার কপালে জুটেছে নির্বাসন। তার রাজত্বটুকু কেবলমাত্র পুরাতন দিল্লির প্রাচীরঘেরা জায়গাটুকুর ভিতর সীমাবদ্ধ ছিল। তার জন্ম ২৪ অক্টোবর ১৭৭৫। ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর তিনি মৃত্যু বরন করেন। ওই রেঙ্গুনেই তাকে সমাহিত করা হয়। ১৮৫৭ সনে সংঘঠিত ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহের পর ইংরেজরা এ ঘটনার  সাথে তার সংম্পৃক্ততা আছে এ অভিযোগ এনে তাকে প্রহসনের এক বিচারে দন্ডিত করে সুদূর রেঙ্গুনে পাঠায়। তিনি এমন একসময় সিংহাসনে ছিলেন যখন মুঘল সাম্রজ্যের সূর্য ডুবু ডুবু যায়। ইংরেজ বেনিয়ারা ১৭৫৭ সালে পাতানো এক ষড়যন্ত্রের যুদ্ধে পলাশীর আম্রকাননে সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত করে বনিকের মানদন্ড ছেড়ে ক্রমে ক্রমে শাসকের রাজদন্ড ধারন করছিল। এ যুদ্ধের একশত বছর পরে ঘটে ঐতিহাসিক সিপাহি বিদ্রোহ। এ সময় বৃটিশ সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত ভূমিপুত্র বা ভারতীয় সৈন্যরা তাদের প্রভু অর্থাৎ বৃটিশদের বিরুদ্ধে রাইফেলের মুখ ঘুরিয়ে দেয় বিভিন্ন ব্যারাকে। দিল্লিতেও সিপাহিরা বহু ইংরেজকে নিধন করেন। এ সময় সিপাহিরা লালকেল্লায় প্রবেশ করে নামেমাত্র সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতবর্ষের স্বাধীন সম্রাট বলে ঘোষনা করেন। ইংরেজরা এ বিদ্রোহ দমনে বড় নির্মমতার আশ্রয় নেয়। রাজপুত্রদ্বয়কে মস্কক বিছিন্ন করে হত্যা করা হয় এবং ৮২ বছরের বৃদ্ধ বাবার কাছে তা প্রদর্শন করা হয়। সম্রাট জাফর শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। ইংরেজ সেনাপতি হাডসন তাকে জানে না মারলেও তাকে অপমানে ও শোকের বানে একরকম মেরে ফেলেন।

বন্দী বাহাদুর শাহ জাফর ও তার পরিবারের কিছু সদস্যকে নিয়ে রেঙ্গুনের দিকে রওহনা হয় জাহাজ যেটি ১৮৫৭ সনের ৯ ডিসেম্বর গন্তব্যে নোঙ্গর করে। বৃটিশ ক্যাপ্টেন নেলসন ডেভিসের বাড়িটির ছোট্ট একটি গ্যারেজ হয় এ হতভাগা সম্রাটের নির্বাসনস্থল। ধুকে ধুকে তিনি এ ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে দিন অতিবাহিত করতে থাকেন। যে সম্রাটের প্রাপ্য ময়ূর তখত্ তার কিনা বন্দীদশায় ভাগ্যে ঘটেছে পাটের দড়ির একটি খাটিয়া শয্যা হিসেবে। যে পরাক্রমশালী মোঘল সম্রাটরা তাজমহলের মত স্মৃতিসৌধ গড়েছিলেন তাদেরি শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের কবরে জুটেনি তার জন্মস্থান দিল্লির এক টুকরো সোদা মাটি। বড় বেদনায় ভাগ্যবিড়ম্বিত এ সম্রাট হৃদয়বিদারক কিছু কবিতা লিখেন। রেঙ্গুনের বন্দীশালায় তার দাঁতমাজার কয়লা দিয়ে দেয়ালে লিখেছিলেন অমর কিছু পঙ্ক্তিমালা কেননা কাগজ কলম তার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষনা করে শাসক ইংরেজ।

তার বেদনগাথা শায়রীর এ ছ্ত্র ‘উমর দরাজ মাঙ্গকে লায়েথে চারদিন/ দো আরজুমে কাটগায়ে দো ইন্তেজার মেঁ’। যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় বিধাতার কাছ থেকে আমি পেয়েছিলাম মাত্র চারটি দিন যার দুদিন কেটে গেল আশা নামক কুহেলিকায় আর বাকী দুদিন কেটে গেল প্রতীক্ষার যন্ত্রনায়। অনেকটা এরকম ‘মা আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল’। কি গভীর জীবনবোধ। আসলে আমাদের সকলেরি জীবনে মনে হয় বাহাদুর শাহ জাফরের এ অমর বাক্যের মধ্যে লুকানো সত্য অগোচরে খেলা করে যায়। জীবনের পড়ন্ত বেলায় বহতা জীবনের বইয়ের ফেলে আসা পৃষ্ঠাগুলি যদি একটু গভীরভাবে পড়তে বসি তাহলে হয়ত আমরা সকলেই দেখতে পাব কি আশা করেছিলাম আর ঘটে গেল কি সব অদৃশ্যের ইচছায়। জীবনের হাটে বাহারী পন্যের সওদার নেশায় মন যখন খুবই আকুল তখন ভিতর থেকে কে যেন বলছে তুমি আর এ হাটে সওদা করতে পারবে না, তোমার জন্য বরাদ্দকৃত সময়টুকু শেষ। বাহাদুর শাহর সমাধিতে পাথর খোদিত স্মৃতিফলকে লেখা রয়েছে তারি লেখা মর্মবেদনার এ কথামালা ‘কিত্না হ্যায় বদ-নসিব জাফর দাফন কি লিয়ে/ দো’গজ জমিন ভি না মিলি কু-ই-ইয়ার মে’। অর্থাৎ এ জাফর এতই হতভাগ্য যে যার দাফনে মিলেনি স্বজন ভূমির সৃজিত দুগজ সমপরিমান জমিন।

দুবার আমি গিয়েছি সেদিনের রেঙ্গুন যা এখন বর্তমান মায়নমারে ইয়াঙ্গুন। প্রতিবারই গিয়েছি এ মরমী কবি যাকে এক অর্থে সুফী সাধকও বলা চলে তার এ শেষ শয্যার পাশে প্রবল এক আকর্ষনে। তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম মানুষের জীবনের নছিব বা ভাগ্যের কথা। ভাগ্যে না থাকলে সম্রাট হলেও সাম্রাজ্য ভোগ করা যায় না, আবার ভাগ্য অনুকুলে থাকলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনীর পেটি গাই লর্ড ক্লাইভ যখন ভারতবর্ষ থেকে লুন্ঠন শেষে ইংল্যান্ডে ফিরেছিলেন তখন নাকি তিনি পৃথিবীর অন্যতম ধনী ব্যাক্তি। আসলে ভাগ্যকে এড়াবার কোন  উপায় নেই। তাইতো দেখা যায় কেউ প্লেন দূর্ঘটনার পরও প্রানে বেঁচে যায় আবার দেখা যায় কেউ রিক্সা থেকে পড়েও মরে যাচ্ছে। ভাগ্যের লিখন, যায় না খন্ডন।

বাহাদুর শাহ জাফরের এ সমাধিতে দেখলাম আমাদের উপমহাদেশের বেশ কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী পরিদর্শন করেছেন এবং এ সম্রাটের জন্য তাদের অনুভূতির কথা পরিদর্শক বইয়ে লিখে গেছেন। তার ভিতর রাজীব গান্ধী লিখেছিলেন, ‘দু’গজ জমিন তো না মিলি হিন্দু্স্থান মে, /পার তেরী কোরবানী সে উঠি আজাদী কি আওয়াজ, বদনসীব তো নাহি জাফর, জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউর শওকত মে, আজাদী কি পয়গাম সে’। এর অর্থ মোটামুটি এ রকম তুমি তোমার প্রিয় জজ্মভূমির দু’গজ মাটি পাওনি এটি সত্য কিন্তু তোমার আত্মত্যাগে স্বাধীনতার আওয়াজ ধ্বনিত হয়েছিল আর দূর্ভাগ্য তোমার নয়, স্বাধীনতার গৌরবে ও সৌরভে তুমি চিরস্মরনীয় অনন্য সৌভাগ্যে।

চিরঞ্জীব সরকার। অটোয়া